রুষ্ট কবির গান
১৯১৪ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ। রবীন্দ্রনাথের গীতালি কাব্যগ্রন্থের রচনাগুলির কাজ চলছে। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে এসেছেন গীতালির কবিতাগুলি কপি করে নেবার জন্য। চিত্রশিল্পী অসিতকুমার হালদারও রয়েছেন শান্তিনিকেতনে। একদিন গল্পচ্ছলে অসিতবাবু বললেন, ‘চলো গয়া বেড়িয়ে আসি’। প্রস্তাবটা মনে ধরল চারুচন্দ্রের, রাজি হয়ে গেলেন সাথেসাথে। কথাটা কানে যেতেই রবীন্দ্রনাথের জামাতা নগেন্দ্রনাথ জানালেন তিনিও যাবেন। শুনে হেমলতা দেবী আর মীরাদেবীও নাম লেখালেন যাবার দলে।
এদিকে গীতালি শেষ করে রবীন্দ্রনাথ সবে ফিরে এসেছেন শান্তিনিকেতনে। হয়ত বা একটু শ্রান্তও। তাঁর সুদূর পিয়াসী মন চাইছে নিত্যদিনের পরিচিতের গণ্ডি ছাড়িয়ে একটু দূরে কোথাও ঘুরে আসতে। অসিতবাবুদের গয়া ভ্রমণের পরিকল্পনায় উৎফুল্ল হয়ে তিনিও যোগ দিলেন এই অভিযানে।
৯ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ সদলবলে গয়া পৌছালেন। দলে ছিলেন চারুচন্দ্র, অসিতকুমার, সতীশচন্দ্র, ত্রিগুণানন্দ, মীত্রাদেবী, নীতীন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ। বাস্তবিকই ‘বেশ পুষ্ট দল’। সকলে আতিথ্য গ্রহণ করলেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক-ব্যারিস্টার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সেই সময়ে কবি বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ও গয়ায় ছিলেন। গানে গল্পে আড্ডায় জমে ওঠা কয়েকটা দিনে কবির মন আনন্দে ভরে উঠলো।
গয়া থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে বেলা স্টেশনের কাছে বরাবর পাহাড়ের কয়েকটি গুহা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এক আকর্ষনীয় দ্রষ্টব্য স্থান। বরাবর-গুহা ভারতের থাকা টিকে প্রাচীনতম পাথর-কাটা গুহাগুলির অন্যতম।
সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে গ্রানাইট পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছিল এই গুহাগুলি। গুহার দেওয়ালে বিভিন্ন সমকালীন ঘটনার ছবি মূর্ত রয়েছে। সম্রাট অশোকের কিছু শিলালিপির সন্ধানও এখানে পাওয়া যায় এখানে। যদিও কালের কবলে তার অনেকটাই আজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এদের মধ্যে সাতটি গুহা আজও প্রত্নতত্ব বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত। বর্তমানে আজীবক সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা এই গুহাগুলি তত্ত্বাবধান করেন।
একদিন নন্দলাল নামের এক ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের আড্ডায় এসে কবিকে উৎসাহিত করবার জন্য বরাবর পাহাড়ের সৌন্দর্য নানাভাবে বর্ণনা করে সকলকে সেই অপূর্ব গুহাগুলি দেখবার আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা জানি যা কিছু নতুন তা দেখবার জন্য রবীন্দ্রনাথের মন সদাই ব্যাকুল হয়ে থাকে। বরাবর পাহাড়ের আকর্ষণ তিনি অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। কথা হল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যরা পরদিন সকালে ট্রেনপথে দু’ স্টেশন দূরে বেলা-স্টেশন পৌছাবেন। নন্দলাল পালকি, হাতি, খাবারদাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা রাখবেন। সম্মতি ও আশ্বাস দিয়ে নন্দলাল বিদায় নিলেন।
গয়া থেকে বেলাগামী প্রথম ট্রেন রাত সড়ে চারটায়। ঠিক হল ওই ট্রেনেই যাওয়া হবে যাতে অনেকটা সময় নিয়ে সবকিছু দেখে ওঠা যায়। রবীন্দ্রনাথ রাত থাকতেই সবাইকে ডেকে তুলে গয়া স্টেশনে পৌঁছে গেলেন। এই যাত্রায় সাথি হলেন চারুচন্দ্র, অসিতকুমার, সতীশচন্দ্র আর ত্রিগুণানন্দ। মীরাদেবী আর নীতীন্দ্রনাথের অসুস্থতার জন্য নগেন্দ্রনাথ আসতে পারলেন না। নতুন কিছু দেখবার কল্পনায় রবীন্দ্রনাথ রেলগাড়িতেই রচনা করলেন গীতালির একটা নতুন কবিতা, পথে পথেই বাসা বাঁধি । ভোরবেলায় যথাসময়ে ট্রেন বেলা স্টেশনে এসে পৌঁছাল। কিন্তু হা হতোস্মি ! কোথায় নন্দলাল, কোথায় পালকি, কোথায়ই বা হাতি। বরাবর-অভিযানের যিনি উদ্যোগী তারই দেখা নেই। অভিযাত্রীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। শুরু হল দুর্দশার। নন্দলালের আশ্বাসে যাত্রীদল কোনো খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে আনেন নি। এদিকে রাত জেগে ট্রেন ধরবার ধকল আর ক্ষুধা তৃষ্ণায় সকলেই অবস্থা কাহিল। রবীন্দ্রনাথও একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। অগত্যা সকলে স্টেশনের ওয়েটিংরুমে আশ্রয় নিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্য কলা কিনে আনা হল, অন্যেরা স্টেশন সংলগ্ন দোকান থেকে কচুরি দই ইত্যাদিতেই পেট ভরালেন।
সময় গড়িয়ে চলল। সহযাত্রীদের বিরক্তি দূর করবার জন্য রবীন্দ্রনাথ নানা সুখ দুঃখের কথা, দার্শনিক আলোচনা আর গল্প শুরু করলেন। এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও কবির সজাগ সৃষ্টিশীল কলমে রচিত হল পূজা পর্যায়ের পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা হে গানটি। বেলা স্টেশনেই বেলা পড়ে গেল। কিছু পরে নন্দলালের এক বন্ধু কোথা থেকে একটা হাতি নিয়ে হাজির হলেন। বেলা স্টেশন থেকে বরাবর পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় সাড়ে বারো কিলোমিটার। চারুচন্দ্র, অসিতকুমার, আর ত্রিগুণানন্দ পালা করে হাতির পিঠে চড়ে আর কিছুটা পথ হেঁটে রওনা দিলেন বরাবর গুহার দিকে। কিন্তু কবির জন্য পালকি কৈ? তিনি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছেন। আবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সতীশচন্দ্র দুটি পালকি জোগাড় করে একটিতে নিজে এবং অন্যটিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাত্রা করলেন গন্তব্যের দিকে। সঙ্গে না আছে খাবার, না জল, না অন্যকিছু। দূরত্ব অনেক। গ্রামের পরে গ্রাম পেরিয়ে গেল। আর কতদূর জিজ্ঞাসা করলেই বাহকেরা বলে ‘আর একটু আগেই সব ব্যবস্থা আছে’। প্রায় ১টার সময়ে বরাবর পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছিয়ে পাল্কী নেমে রবীন্দ্রনাথ গাছের ছায়ায় একটা পাথরের উপর বসে হতাশ ভাবে পড়লেন। অন্যান্যরা ইতিমধ্যে গুহাগুলি দেখে নীচে নেমে এসেছেন। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়েছে। সকলকে দেখে ক্ষুব্ধ কবির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। জানালেন তিনি আর পাহাড়ে চড়বেন না। পাল্কী ফিরে চলল বেলা স্টেশনের দিকে। কিন্তু কী আর্শ্চয্য,এই চূড়ান্ত অব্যবস্থার মধ্যেও ক্লান্ত, বিক্ষুদ্ধ কবির কলম সৃষ্টি করে ফেলল একটি অসাধারণ গান যার সঙ্গে সেদিনের তাঁর মানসিক অবস্থার কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যায়না।
সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি,
দুঃখে তোমায় পেয়েছি প্রাণ ভ’রে।
হারিয়ে তোমায় গোপন রেখেছি,
পেয়ে আবার হারাই মিলনঘোরে।।
চিরজীবন আমার বীণা-তারে
তোমার আঘাত লাগল বারে বারে,
তাইতে আমার নানা সুরের তানে
প্রাণে তোমার পরশ নিলেম ধ’রে।।
আজ তো আমি ভয় করি নে আর
লীলা যদি ফুরায় হেথাকার।
নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে
লও যদি বা নূতন সিন্ধুপারে
তবু তুমি সেই তো আমার তুমি—
আবার তোমায় চিনব নূতন ক’রে।।
জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত, আনন্দ, বিরহযন্ত্রণা, প্রিয়জনের মৃত্যু, এমনকি অতি তুচ্ছ ঘটনাও শিল্পীর সৃজনপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, তৈরি করে কালজয়ী সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় আমারা তার প্রমাণ পাই। কিন্তু এই গানের কোথাও নেই সেদিনের ব্যর্থ অভিযানের কোনো অভিযোগ বা তাঁর বিক্ষিপ্ত মনের বিরক্তির কোনো প্রতিফলন।
সূর্য-ঢলেপড়া সন্ধ্যায় পাল্কী এসে পৌছাল বেলা স্টেশনে। চারুচন্দ্র লিখেছেন, ‘কবির সমস্ত দিন স্নান হয় নি, রৌদ্রে পথে যাতায়াতে ও বিরক্তিতে তাঁর চেহারা অত্যন্ত ম্লান ও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। …. তিনি স্টেশনের একধার থেকে আর একধার পর্যন্ত প্লাটফর্মের উপর পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন । …. বললেন “জীবনে দুঃখ পাওয়ার দরকার আছে”। এই যে দার্শনিকতা তা কেবল নিজের বিরক্ত মনকে সান্ত্বনা দেবার ও রুষ্ট মনকে শান্ত করবার উপায় মাত্র’।
ফিরতি ট্রেন এসে পৌঁছাল বেলা স্টেশনে। বিদ্ধস্ত যাত্রীদল উঠে বসলেন গয়া ফিরবার জন্য। সকলের শরীরমন ক্লান্তিতে অবশ। একমাত্র ব্যতিক্রম চিরতরুণ রবি। রেলের মৃদু দোলানির মধ্যেই তাঁর অক্লান্ত কলম লিখে চলল
পথের সাথি, নমি বারংবার।
পথিকজনের লহ নমস্কার।
ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি,
ওগো দিন-শেষের পতি,
ভাঙা-বাসার লহ নমস্কার।
ওগো নব প্রভাত-জ্যোতি,
ওগো চিরদিনের গতি,
নূতন আশার লহ নমস্কার।
জীবন-রথের হে সারথি,
আমি নিত্য পথের পথী,
পথে চলার লহ নমস্কার।।