পূর্বকথন
আনুমানিক খৃস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যশোহর জেলার চেংগুটিয়া পরগণার জমিদার ছিলেন দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরী। তাঁর চার পুত্রের প্রথম দুইজন কামদেব ও জয়দেব ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং তাঁদের সংস্পর্শে অপর দুই পুত্র রতিদেব ও শুকদেব সমাজচ্যুত হন। এই সমাজচ্যুতির পুর্নবাসনের তাগিদে শুকদেবের ভগ্নী রত্নমালার সঙ্গে মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায় নামে একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণের বিবাহ দেওয়া হয়। এবং শুকদেবের কন্যা সুন্দরীকে বিবাহ করেন পিঠাভাগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী।
এই জগন্নাথ কুশারীকেই ঠাকুর বংশের আদিপুরুষ বলে মনে করা হয়।
জগন্নাথ কুশারীর চার পুত্র। প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম, হৃষীকেশ এবং মনোহর। পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র রমানন্দ। তার দুই ছেলে, নাম মহেশ্বর এবং শুকদেব।
মহেশ্বরের পুত্র পঞ্চানন। কামদেব জয়দেব রতিদেব শুকদেব রত্নমালা
তখন সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। জব চার্ণকের কলকাতা পত্তনের সুবাদে ব্যবসাবাণিজ্য প্রাধান্য বিস্তার করছিল। সেই সময়ে ভাগ্য অন্বেষণে শুকদেব ও ভ্রাতুষ্পুত্র পঞ্চানন দেশত্যাগ করে কলকাতায় এসে গবিন্দপুরে গঙ্গার তীরে বসবাস এবং জাহাজের মাল সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। ব্রাহ্মণ হবার সুবাদে নিন্মশেণীর প্রতিবেশীরা পঞ্চাননকে ঠাকুর বলে সম্বোধন করতেন। দেখাদেখি সাহেবরাও তাকে ঠাকুর বা Tagore বলতে আরম্ভ করলেন। এইভাবে একদিন তিনি সকলের কাছে পঞ্চানন ঠাকুর নামে পরিচিত হলেন।
পঞ্চানন ঠাকুরের দুই পুত্র জয়রাম এবং রামসন্তোষ নানা প্রকার ব্যবসা করে ধীরে ধীরে বিত্তশালী হয়ে উঠলেন। জয়রামের চার পুত্র। আনন্দীরাম নীলমণি দর্পনারায়ণ ও গোবন্দরাম। ১৮৫৬ সালে জয়রামের মৃত্যু হয়। তার আগেই জ্যেষ্ঠপুত্র আনন্দীরাম মারা গিয়েছিলেন। সেই বছরেই নীলমণি ও দর্পনারায়ণ কলকাতার পাথুরিয়াঘাটায় জমি কিনে বসবাস শুরু করেন। ইংরাজের অধীনে চাকুরিরত নীলমনির কর্মস্থান তখন ওড়িশায়। উপার্জিত অর্থ তিনি ভাই দর্পনারায়ণের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। কিছুদিনের মধ্যেই জয়রামের কণিষ্ঠপুত্র গোবিন্দরামের মৃত্যু হয়। এই সময়ে টাকাকড়ি ও সম্পত্তি নিয়ে নীলমনি ও দর্পনারায়ণ দুই ভাইয়ের মধ্যে গোলযোগ শুরু হয়। যদিও সেটা আপসে মিটিয়ে নেওয়া হয়েছিল। দর্পনারায়ণ পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি এবং রাধাকান্ত জীউর সেবার ভার গ্রহণ করেন। নীলমণি গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন শিলা ও নিজ উপার্জনের একলক্ষ টাকা নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। ফলে পঞ্চানন ঠাকুরের ঠাকুর বংশ দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে গেল।
এদিকে গৃহত্যাগী নীলমনি হাঁটতে হাঁটতে শ্রান্ত হয়ে চিতপুরের কাছে এক পুকুরপাড়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই সময়ে বিখ্যাত ব্যাবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠ, নীলমনির দুরবস্থা দেখে তাকে মেছুয়াবাজার অঞ্চলে একবিঘা জমি দান করলেন। যদিও নীলমনি প্রথমে এই দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। ওই জমিতে নীলমনির গড়ে তোলা প্রথমে একটি কাঁচা ও পরে পাকাবাড়িই আজকের ঠাকুরবাড়ীর ভিত্তি।
নীলমনির (স্ত্রী ললিতা) তিন পুত্র ও এক কন্যা। রামলোচন | রামমনি | রামবল্লভ | কমলমনি। রামলোচন অলোকাকে এবং রামমনি মেনকাকে বিবাহ করেন। আলোকা আর মেনকা দুই বোন।
রামলোচনের একমাত্র কন্যা শৈশবেই মারা যায়। রামমনির ও মেনকার চার সন্তানের মধ্যে কণিষ্ঠ পুত্রের নাম দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথের জন্মের পরেই মাতা মেনকা মারা যান। সেই সময়ে ১৭৯৯ সালে রামলোচন ও অলোকা দ্বারকানাথকে দত্তক গ্রহণ করেন। 12 Dec 1807 সালে রামলোচনের মৃত্যুর পরে দ্বারকানাথ পালকপিতার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ বছর। তীক্ষ্ণ বাস্তববুদ্ধি, অসাধারণ দূরদর্শীতা ও পরিশ্রমের দ্বারা দ্বারকানাথ দেশেবিদেশে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ঠ শিল্পপতি, সমাজ-সংস্কারক, বাংলার নবযুগের পথপ্রদর্শক। ইংরাজেরা তাঁকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ বলে সম্বোধন করতেন। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার ইংল্যাণ্ড ভ্রমেণের সময়ে 1 Aug 1847 তারিখে এই মহাপ্রাণের মৃত্যু হয়।