আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে আসবে যদি
১৯১৮ সালের প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের শরীর খুবই খারাপ। তারই মধ্যে শুরু হয়ে গেল মাঘোৎসবের প্রস্তুতি। আশ্রমের ছাত্রদের অসুবিধার কথা ভেবে এই বছরের উৎসব শান্তিনিকেতনেই অনুষ্ঠিত (২৪ জানুয়ারি) হয়েছিল। তাই অসুস্থতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও মাঘোৎসবে যোগ দেবার জন্য জানুয়ারি মাসের ২২ তারিখে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। এর মধ্যে প্রচুর লেখালেখি ও মাঘোৎসবের পরিশ্রমে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসকেরা কড়া নির্দেশ দিলেন পুরো বিশ্রাম নিতে হবে, একদম লেখাপড়া করা চলবে না। কবি বললেন, সে কী করে হবে। লেখালেখিতেই তো তাঁর বিশ্রাম। তখন বলাকার পর্ব চলছে। এডোয়ার্ড টমসনকে লিখলেন, doctors advise me to take rest. But doing nothing is not at all restful and therefore I am thinking of translating paragraphs from my Santiniketan papers.
এদিকে ১৯১৭ সাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের আদরের বেলা (জেষ্ঠ্যা কন্যা মাধুরিলতা) দুরারোগ্য যক্ষা রোগে আক্রান্ত, বলা যায় মৃত্যুর একেবারে দোরগোড়ায়। সেই মানসিক চাপে রবীন্দ্রনাথ উদ্ভ্রান্ত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু দৈনন্দিন কোনো কাজে তাঁর বিরাম নেই। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির বারান্দায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিত চক্রবর্তী, তেজেশচন্দ্র সেনকে বলাকার কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন। যোগ দিচ্ছেন গানের আসরে। এত দুঃখ বেদনার মধ্যেও তাঁর মনে নেমে এসেছে গানের ধারা, ঝর্নার মত রচনা করে চলেছেন একের পর এক গান।
সে বছর সরস্বতী পূজার দিন আশ্রমের ছেলেরা পূর্ণিমার রাতে এক বনভোজনের পরিকল্পনা করেছিল। তাঁর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির সান্নিদ্ধে এই ধরনের আনন্দ উপভোগে রবীন্দ্রনাথের সম্মতির অভাব হত না। সীতা দেবী সেই সময়ে শান্তিনিকেতনে, এই বনভোজনে তিনিও সামিল। তাঁর পূণ্যস্মৃতি গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন, ‘শ্রীপঞ্চমীর দিন (৩ ফাল্গুন শুক্র ১৫ ফেব্রুয়ারি) ছেলেরা যখন দল বেঁধে হৈ হৈ করে সুরুলে বনভোজন করতে গেল, তখন রবীন্দ্রনাথ জানালেন যে তিনিও যোগ দেবেন ছেলেদের আনন্দের বনভোজনে। গুরুদেবের মুখে এই কথা শুনে মেয়েরা মহা উৎসাহে সেজেগুজে তাঁর সঙ্গে চলল সুরুলের পথে। আর ছেলেরা রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে তো আনন্দে আত্মহারা। যথা সময়ে শুরু হল বনভোজনের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনালেন। তারপরে শুরু হল গানের পালা। পণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী, যিনি এই দলে ছিলেন, কিছু হিন্দি গান করলেন। অবশেষে সকলে মিলে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনী কাব্য উজাড় করে বসন্তের গানগুলি। ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে লাগল। অনুষ্ঠান শেষের আগে রবীন্দ্রনাথ গাইলেন তাঁর সেই দিনেই রচনা করা গান ‘আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে আসবে যদি শূন্য হাতে’। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া প্রান্তর ভরে উঠল সেই সুরের মুর্ছনায়। এই গানে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় কন্যা বেলার আসন্ন মৃত্যুর বেদনা যেন ফুটে উঠেছে।
২১ ফেব্রুয়ারি টেলিগ্রাম এল বেলার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। রবীন্দ্রনাথ দুপুরের ট্রেনেই ফিরে গেলেন কলকাতায়। তিনি বুঝ্তে পেরেছিলেন কী হতে চলেছে। যেন নিজের মনকে সান্তনা দিতে যাত্রাপথেই রচনা করলেন ‘কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়’।
অন্যান্য তথ্য | রচনা ফেব্রুয়ারি ১৯১৮ | রচনাস্থান শান্তিনিকেতন | কবির বয়স ৫৬ বছর | পর্যায় পূজা | স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর | ১৯৪১ সালে উত্তরায়ণ ছায়াছবির জন্য মেগাফোন রেকর্ড থেকে যূথিকা ঘোষ এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন।
এইভাবে মনে হয়,একের পর এক দুঃখভাবনাকে অতিক্রম করে কবি সুন্দরের আরাধনা করে গিয়েছেন।অসাধারণ লেখা।
Aji prothom porlam. Bhalo laglo. Likhte thakun.
Regards
Sudeshna
অনেক ধন্যবাদ। আমার এই ব্লগ প্রতি শনিবার সকাল ৯টায় পোষ্ট করা হয়। সঙ্গে থাকবেন আশা করি। লেখা ভালো লাগলে মতামত পোষ্ট করবেন।
রবীন্দ্রনাথ এমনিভাবেই আমাদের সুখে দুঃখে শোকে আনন্দে সাথে থাকেন। তাঁর গানে কবিতায়, সাহিত্যে আমাদের সঙ্গে থাকেন। আপনার হিরন্ময় লেখনী হ’তে ছড়িয়ে পড়ে এইসব জানা অজানা মণি মুক্তা। আমরা আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথকে আরও নিবিড় করে পাই। আমরা সমৃদ্ধ হই। আপনাকে ধন্যবাদ।
ব্যক্তিগত শোক কে সৃষ্টি তে পরিণত করে আমাদের শোকের মূহুর্ত গুলিতে স্বান্ত্বনার প্রলেপ দিয়ে গেছেন। ধন্যবাদ জানাই এই অজানা কে জানানোর জন্য।
দুঃখরাতের রাজা এভাবেই আমাদের ভরিয়ে দিয়ে গেছেন.. অসাধারণ পোস্ট।
ঠিক। রবীন্দ্রনাথের জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ অনেক বেশী। তাই দুঃখের মধ্যেই তিনি সুখের সন্ধান পেতেন গানের ভিতর দিয়েই।
Apnake abar dhanyabad janai.ganer tathya sutro jano ousodhir kaj kare.sritishil manan kibhabe nijekei atikram kore jan tar anubhav shokti jogay.
Kothao porechhilam akbar ak bayasko byakti kobike shraddha jananate esechhilen.karon tar sadyo bidhoba taruni kanya kichhudin bhison asthir thakar par dhire dhire shanto hoye otthe ‘ Gitanjali ‘pore.tathyasutro mone nei aj ar.apnar kalame hayto peye jabo abar.bhalo thakun . regards.
রবীন্দ্রনাথ যত কষ্ট পেয়েছেন তত সৃষ্টি হয়েছে অসাধারণ উচ্চাঙ্গের গান।তাই তো তিনি রবীন্দ্রনাথ।