জলের খোঁজে রবীন্দ্রনাথ 3.67/5 (6)

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে রায়পুরের জমিদার প্রতাপনারায়ন সিংহের কাছ থেকে বোলপুরের ভুবনডাঙায় কুড়ি বিঘে জমির পাট্টা নিয়ে শান্তিনিকেতন পত্তন করেছিলেন। সেই অনন্ত আকাশের নীচে দিগন্ত প্রসারিত প্রান্তরে ছিল কেবল দুটি ছাতিমগাছ, গুটিকয়েক তালগাছ আর চারিদিকে তরঙ্গায়িত ধূসর রুক্ষ মাঠ। কোথাও সবুজের আভাসমাত্র ছিল না। ধীরে ধীরে সেখানে মানুষের আনাগোনা বাড়ল, বসতি স্থাপন হল, বসানো হল নানারকম গাছপালা। ফুলে ফলে সবুজ হয়ে উঠল শান্তিনিকেতন। ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যা বিদ্যালয়ে ছাত্র সমাগম। কবির স্বপ্ন একটু একটু করে বাস্তব রূপ পেতে শুরু করেছে।

সেই সময় শান্তিনিকেতনের বাসিন্দাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পানীয়জলের অভাব। গ্রীষ্মকালে রুক্ষভূমি বোলপুর এবং আশেপাশের সব নদীনালা মাঠঘাট শুকিয়ে যেত। সামান্য পানের জলটুকুও পাওয়া যেত না। আশ্রমবাসীদের কষ্টে কাতর রবীন্দ্রনাথ সবসময়ে চিন্তা করতেন কিভাবে এর সমাধান করা যায়। জানা গেল মাটির নীচের জল টিউবওয়েলের সাহায্যে উপরে তুলে আনতে পারলেই মানুষের তৃষ্ণা দূর করা সম্ভব। কিন্তু কিভাবে? ১৯১৩ সালে আমেরিকায় থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের আলাপ হল অখিলচন্দ্র চক্রবর্তী নামে এক তরুণ এঞ্জিনিয়ার ছাত্রের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন বিদেশ থেকে টিউবওয়েল বসানোর পদ্ধতি আর কলাকৌশল শিখে আসেন। ১৯১৬ সালের আমেরিকা ভ্রমণের সময়েও রবীন্দ্রনাথ অনেক খরচ করে টিউবওয়েল বসাবার কিছু যন্ত্রপাতি কিনে এনেছিলেন। কিন্তু এদেশের কোন ইঞ্জিনিয়ারই সেগুলি ব্যবহার করতে পারেন নি। 

১৯২২ সালে টিউবওয়েল বসাবার কারিগরি জ্ঞানার্জন করে অখিলচন্দ্র দেশে ফিরে এলেন। রবীন্দ্রনাথকে জানালেন যে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে মাটির নীচের জল তুলে আনবার কাজটির দায়িত্ব নিতে চান। রবীন্দ্রনাথ সানন্দে রাজি হলেন। কবি কল্পনা করলেন তাঁর এতদিনের বাসনা এবার পূর্ণ হবে, মাটির নীচের অমৃতবারি ধরাতল সিক্ত করবে, জুড়াবে মানুষের তৃষিত হৃদয়। সেই অমৃতবারিকে রবীন্দ্রনাথ বন্দনা করলেন সেদিনের লেখা ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জ’ গানের মধ্য দিয়ে। 

এসো এসো হে তৃষ্ণার জল

শান্তিনিকেতন তথা সমস্ত বোলপুরে তখন একটিই মাত্র আলোচনার বিষয়- নলকূপ বসিয়ে মাটির নীচের জল উপরে তুলে আনা হবে, মিটবে মানুষের পিপাসা। ঠিক হল ১৩২৯ এর বৈশাখেই বসানো হবে প্রথম নলকূপটি। যে-কোনো শুভকাজে শান্তিনিকেতনে উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। নলকূপ খোঁড়ার জায়গাটিকে মঙ্গলঘট, আম্রপল্লব আর ফুল দিয়ে সাজানো হল- যেন অনুষ্ঠান মঞ্চ। আশ্রমবাসী ছাড়াও সারা বোলপুরের মানুষ জড়ো হয়েছেন। এসেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বিধুশেখর শাস্ত্রী আর ক্ষিতিমোহন সেন মন্ত্রপাঠের জন্য প্রস্তুত। ছাত্রীরা গাইলেন গান, ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল’। মন্ত্রপাঠ আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হল যন্ত্র দিয়ে মাটির বুকে ছিদ্র করা। অখিলচন্দ্র আর আশ্রমের মানুষজন প্রায় ১৫ দিন ধরে অসম্ভব পরিশ্রম করলেন। কিন্তু পাথরের মত শক্ত মাটি ভেদ করে নলকূপের পাইপটিকে কিছুতেই নীচের জলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হল না। দেবতা মুখ তুলে চাইলেন না।

১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মে উত্তরভারত ভ্রমণ শেষে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ফিরে এসেছেন। সেবার বীরভূমে তীব্র জলাভাব আর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। খরাপিড়ীত অসহায় মানুষের দূর্দশা দূর করবার চিন্তায় রবীন্দ্রনাথ কাতর। বহু বছর আগে রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহ বীরভূমের ভুবনডাঙায় একটি বিশাল জলাশয় তৈরি করেছিলেন যা আশেপাশের বহু গ্রামের তৃষ্ণা নিবারণ করত। কিন্তু কালের নিয়মে আর অবহেলায় ক্রমেই সেটি শুকিয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের উদ্দ্যোগে ভুবনডাঙা জলাশয় সংস্কারের কাজ শুরু হল। অসংখ্য মানুষের অর্থসাহায্য, সমবায় ব্যংকের ঋণ আর সকলের সমবেত কায়িক শ্রমের ফলে জলাশয়টি একদিন পুনর্জীবিত হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। শান্তিনিকেতনের জলের সমস্যার কিছুটা সমাধান হল। 

শান্তিনিকেতনের নলকূপ-ইতিহাসের সঙ্গে অমূল্য বিশ্বাসের নাম ওতপ্রেতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। না, তিনি ইঞ্জিনিয়ার নন। তাঁর ছিল না কোনো প্রথাগত শিক্ষা কিম্বা কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শংসাপত্র। ছিল বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, অনুসন্ধিৎসা আর নতুন কিছু করে দেখবার অদম্য বাসনা। তিনি জানতেন মানুষের জলকষ্ট লাঘবের জন্য রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ আর প্রায় ১৪ বছর আগেকার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথা। এটাও জানতেন যে সেই কাজের জন্য বিদেশ থেকে আনা অনেক যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে শান্তিনিকেতনের কোনো গুদাম ঘরে। অমূল্যবাবু একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে বললেন, তাঁকে একবার সুযোগ দিলে তিনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন অকেজো যন্ত্রপাতিগুলির সাহায্যে মাটির নীচের জল তুলে আনা যায় কিনা। এটাও জানাতে ভুললেন না যে এই ধরণের কাজে তাঁর তথাকথিত কোনো কারিগরি শিক্ষা নেই। যে-কোনো নতুন প্রচেষ্টা আর পরীক্ষা নিরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের ছিল অসীম আগ্রহ আর উৎসাহ। অনেক সময়ই সেই প্রচেষ্টা সফল হত না, অনর্থক কিছু পরিশ্রম আর অর্থের অপচয় হত। তবুও কবি নিরাশ হননি কোনোদিন। 

রবীন্দ্রনাথ অমূল্যবাবুকে টিউবওয়েল বসানোর পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন, জানালেন শুভেচ্ছাও। গুরুদেবের নির্দেশ আর আশীর্বাদ পেয়ে অমূল্যবাবু পুরোনো বতিল যন্ত্রপাতিগুলি নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে এসে তাঁর কাজ দেখে উৎসাহ দিয়ে যেতেন। আর অবাক কাণ্ড, কিছুদিনের মধ্যেই অমূল্যবাবু শক্ত পাথুরে মাটি ভেদ করে টিউবের সাহায্যে মাটির নীচে সঞ্চিত জল তুলে আনলেন উপরে। সেই অমৃতবারি পান করে, স্বপ্নেপুরণের আনন্দে আত্মহারা কবি রচনা করলেন গান ‘হে আকাশবিহারী নীরদবাহন জল’। কবির বয়স তখন ৭৫ বছর।

হে আকাশবিহারী নীরদবাহন জল

রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা হল এই কৃতিত্বের জন্য অমূল্যবাবুকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এজন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান মঞ্চটি সাজানো হয়েছিল ফুল আর আলপনা দিয়ে। কবি উপস্থিত, অতিথিরা এসে গিয়েছেন। কিন্তু অমূল্যবাবুর দেখা নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে জানা গেল তিনি এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে রয়েছেন। তখন লাজুক মানুষটিকে ধরে আনা হল অনুষ্ঠান মঞ্চে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মালাচন্দনে বরণ করে নিয়ে গাইলেন তাঁর সদ্যরচিত গান ‘হে আকাশবিহারী নীরদবাহন জল’।

সমাপ্ত হল রবীন্দ্রনাথের জল-অন্বেষণের অভিযান

Please rate this

Join the Conversation

1 Comment

  1. Apurba tothho jeri age janle natun rupe bistro vabe jana gelo DR.SARKAR er ae prochestay amra samridhho hoye cholechi pronam janai

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *