একটি তারিখহীন চিঠি
‘আমি যখন কলিকাতায় পতিগৃহে, তখন পারিবারিক ও অন্যবিধ অশান্তিতে কাতর হয়ে সাহিত্যের আশ্রয় নিই। আমি বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলাম আমাদের পরিবারের মতের বিরুদ্ধে। এক সময়ে শ্রীবৃন্দাবন-দর্শনে যাবার অনুমতি পাবার জন্য বহু চেষ্টা করেও অনুমতি পেলাম না। সেই উপলক্ষ্যে একটা দারুণ বিক্ষোভ ও অশান্তি চলছিল। বিক্ষুব্ধ মনকে শান্ত করবার জন্য আমি অন্য পথ ধরলাম।
রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ, শেষের কবিতা ও সঞ্চয় পড়ি, তাঁর কবিতা ও গান কিছু কিছু পড়া ছিল— অকস্মাৎ তার একটি নূতন পরিচয় আমার কাছে উদ্ঘাটিত হয়, এবং আমার মানসিক অশান্তির সময় আমি তার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় উদ্বেল হয়ে তাঁকে একখানি পোস্টকার্ড লিখি – ‘যোগাযোগের গ্রন্থকারকে অজস্র নমস্কার’ নিজের নামঠিকানাহীন পত্র। তার পর তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি, নিজের ছদ্মনাম ‘জোনাকি’ নামে, অন্য একটা ঠিকানা দিই।’
চিঠিটি সম্ভবত ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেখা। রবীন্দ্রনাথ উত্তরে লিখেছেন, ‘কল্যাণীয়া জোনাকি, তুমি আমার অন্তরের আশীর্বাদ গ্রহণ কর। ইতি ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১. শুভাকাঙ্ক্ষী শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।‘
সেই শুরু। তার পরবর্তী দশ বছরে এই অচেনা ভক্তটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য পত্র বিনিময় হয়েছে। বস্তুত তাঁর ক্লান্তিহীন কলম নানাজনকে যত চিঠি লিখেছে, তার মধ্যে জোনাকিকে লেখা চিঠির সংখ্যা সবচেয়ে বেশী, মোট ২৬৪ টি। জোনাকির তরফ থেকেও কবি পেয়েছেন প্রায় ৩০০টি চিঠি।
কে এই জোনাকি ?
এক অসম পারিবারিক প্রেক্ষাপটে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখবার নারী বিদ্রোহের প্রতীক হেমন্তবালা দেবী, যিনি ‘জোনাকি’ ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখতেন।
জন্ম ১৮৯৪ সালে, মা অনন্তবালা দেবী। অত্যন্ত রক্ষণশীল অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্তঃপুরিকা হেমন্তবালা মাত্র দশ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের ভাগিনেয় ব্রজেন্দ্রকান্ত রায়চৌধুরীর সঙ্গে। বিবাহিত জীবনের শুরুতেই দেখা দিল অসন্তোষ। হেমন্তবালা বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে প্রভু শ্রীকৃষ্ণের চরণে আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন রায়চৌধুরী পরিবার। তখন মা অনন্তবালা দেবী মেয়েকে স্বামীর সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করে নিলেন। অনন্তবালা দেবীই ছিলেন হেমন্তবালার স্বামী-সান্নিধ্যের প্রধান অন্তরায়।
একদিকে পিত্রালয় অন্যদিকে শ্বশুরালয়ের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হেমন্তবালা হয়ে গেলেন একা, নিঃসঙ্গ। দুই সন্তানের জন্ম দিয়েও পারলেন না প্রকৃত সংসারী হতে। কোন প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও নিজের চেষ্টায় হেমন্তবালা নিজেকে শিক্ষিতা, আধুনিকা করে তুলেছিলেন। পরিচয় দিয়েছেন বাংলা, ইংরাজি, সংস্কৃত সাহিত্যে নিজস্ব দক্ষতার।
যখন বৈষ্ণব দীক্ষাগুরু শ্রীশ্রীঠাকুরের মৃত্যুর খবর পেয়েও স্বামী এবং পরিবারের আপত্তিতে হেমন্তবালা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য বৃন্দাবন যেতে পারেন নি, আটকে থাকতে হয়েছিল সংসারের অপ্রয়োজনীয় কাজে, তখন তাঁর মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। শুরু করেছিলেন নাটক নভেল পড়া, সিনেমা দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। ততদিনে পড়ে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথের অনেক উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ যা তাকে মুগ্ধ করেছিল।
সাংসারিক টানাপোড়েন আর ধর্মীয় অনুশাসনে দীর্ণ ক্লান্ত বিদ্রোহী হেমন্তবালা বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। রবীন্দ্রনাথের দর্শনই তার জীবনে এনে দেবে প্রশান্তি। কারণ কবি তো হেমন্তবালার মত মেয়েদের কথাই লিখেছেন তাঁর উপন্যাসে।
অনেক দ্বিধা নিয়ে পাঠানো প্রথম চিঠির উত্তরে কবির আশীর্বাদ আর প্রশ্রয় পেয়ে হেমন্তবালা নানা প্রশ্ন নিয়ে কবিকে নিয়মিত চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন। অভিভাবকদের ভয়ে তিনি বিভিন্ন ছদ্মনাম (জোনাকি, ‘খদ্যোৎবালা’ ‘দক্ষবালা’ ইত্যাদি) ব্যবহার করতেন। তাঁর প্রথমদিকের চিঠিগুলি ছিল মূলত অন্তর্মুখী নানা প্রশ্নের, নিজের অশান্ত জীবনে শান্তির খোঁজ পাওয়ার প্রচেষ্টা।
কবি উত্তরে লিখেছেন, ‘দুঃখবেদনার অনুভূতি থেকে তুমি নিজেকে বাঁচাতে চেয়েচ। ভক্তি বা হৃদয়াবেগের নেশা দিয়ে ফল পাবে না। তোমার ভালোবাসা যেখানে জ্ঞানে কর্মে ত্যাগে তপস্যায় ষোলো আনা পূর্ণ সেইখানেই তোমার পরিত্রাণ । মানুষের দেবতার কাছে তুমি নিজেকে উৎসর্গ করে দাও— তিনি যদি তোমাকে দুঃখের মালা পরিয়ে দেন তবে সেই মালা দিয়েই তিনি তোমাকে বরণ করে আপন করে নেবেন তার চেয়ে আর কি চাই?’
রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, ‘তোমার চিঠিতে তোমার কবিতার যে পরিচয় পেয়েছি তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। অত্যন্ত খাটি কবিতা, বানানো নয়, পরিণত লেখনীর সৃষ্টি।’
বস্তুত কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্র-হেমন্তবালার পত্রমিতালির সম্পর্ক। প্রথম চিঠিতেই ছিল একটি কবিতা যেটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে হেমন্তবালা তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘… পরিচয় না দিয়েই জোনাকি দেবী ছদ্মনামে একটি কবিতায় অভিনন্দন জানালাম তাঁকে। কবিতাটির পংক্তি ছিল “ওগো যোগাযোগ, শেষের কবিতা প্রণেতা”।’
রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা আর উৎসাহ হেমন্তবালাকে লেখার কাজে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেগুলি প্রায় সবই অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ছিল বৈচিত্র্যময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তার ইচ্ছা এবং স্বপ্নের কথা, দৈনন্দিন জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, লড়াই, দুঃখবেদনা এবং তা অতিক্রম করার জন্য অনুসন্ধানের ছবি ব্যক্ত হয়েছে তৎকালীন কবিতাগুলিতে। এমনকি কিছু রান্নার রেসিপির বর্ণনাও আছে কিছু কিছু কবিতায়!
১০ ফেব্রুয়ারিতে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে একটি শিরোনামহীন কবিতায় হেমন্তবালা কবিকে প্রণাম জানিয়েছেন। কবিতাটিতে আছে একটি নিবেদন, একটি ভিক্ষা। শ্রীশ্রীঠাকুরের সদ্য প্রয়াণ, মানসিক অস্থিরতা আর সংসারের টানপোড়েনে দিশাহারা হেমন্তবালা নিজের যন্ত্রণাকে তুলে ধরেছেন কবিতায়।
হেমন্তবালার মনে সংশয় ছিল, হয়ত তাঁর বিচিত্র প্রশ্নে ভরা চিঠিগুলি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হন। তাঁকে আশ্বাস দিয়ে কবি লিখেছেন, ‘তুমি নিজেকে অকারণ পরিতাপে কেন পীড়িত করচ আমি কিছুই বুঝতে পারচি নে। তোমার প্রতি বিরক্তির লেশমাত্র কারণ আমার ঘটে নি, তোমার চিঠি পড়তে আমার বিশেষ ভালো লাগে। তোমার জীবনের যা গভীরতম উপলব্ধি তার সৌন্দর্য ও সত্যতা আমি মনে বেশ বুঝতে পারি। নিজের পথ তোমার থেকে পৃথক বলেই তোমার অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনতে আমি এত ঔৎসুক্য অনুভব করি।’
হেমন্তবালা বেশীরভাগ চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথকে ‘দাদা’ বলে’ সম্বোধন করেছেন। প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি শুরু হয়েছে ‘কল্যাণীয়াসু’ দিয়ে।
একবার হেমন্তবালা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ যেন কখনো ঝগড়া না করেন। কবি জবাব দিলেন, ‘তুমি আমাকে পরামর্শ দিয়েছ আমি যেন ঝগড়া না করি। তোমার কথা রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব যেহেতু আমি ঝগড়া করিই নে। বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করে অবধি গালি ও নিন্দা আমি নিরন্তর পেয়েছি কিন্তু একবারও তার প্রত্যত্তর দিই নি, প্রতিবাদ করি নি। এই চুপ করে থাকার চেয়ে আরও বেশি কী করতে পারি সেই পরামর্শ আমাকে দিয়ো।’
রবীন্দ্রনাথ কেন ঠাকুরমন্দির থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন হেমন্তবালার এই প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন, ‘ঠাকুরঘরের নৈবেদ্যের মধ্যে আমরা ঠাকুরের সত্যকার প্রাপ্যকে প্রত্যহ নষ্ট করি। এর থেকে একটা কথা বুঝতে পারবে, আমার দেবতা মানুষের বাইরে নেই। নির্বিকার নিরঞ্জনের অবমাননা হচ্চে বলে আমি ঠাকুরঘর থেকে দূরে থাকি এ কথা সত্য নয়— মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে বলেই আমার নালিষ। যে সেবা যে প্রীতি মানুষের মধ্যে সত্য করে তোলবার সাধনাই হচ্চে ধর্মসাধনা তাকে আমরা খেলার মধ্যে ফাঁকি দিয়ে মেটাবার চেষ্টায় প্রভূত অপব্যয় ঘটাচ্চি। এই জন্যেই আমাদের দেশে ধার্মিকতার দ্বারা ঐ ঠাকুরঘরের মধ্যে যে পূজা পড়চে সমস্ত ক্ষুধিতের ক্ষুধাকে অবজ্ঞা করে সে আজ কোন্ শূন্যে গিয়ে জমা হচ্ছে?’
১৩৩৮ সালে হেমন্তবালা দেবীর জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ‘অপূর্ণ’ শিরোনামে কবিতাটি রচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে হেমন্তবালা যেসব কবিতা লিখতেন তার বেশীরভাগই স্তুতিমূলক, রবীন্দ্রভজনা। যেমন
অনেকদিন পরে রবীন্দ্রনাথ জোনাকির আসল পরিচয় জানতে পেরে তাঁর দেখা পেতে চেয়েছেন। ‘জোনাকি ও রবি‘ কবিতায় হেমন্তবালা সেটি সংলাপে ফুটিয়ে তুলেছেন
বয়সে অনেক ছোটো হয়েও, রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে হেমন্তবালার সখ্যতা এত গভীর ছিল যে নানা রসিকতা, অনুযোগ, শ্লেষ বা অভিমান করে চিঠি লিখতে তিনি সঙ্কোচ বোধ করতেন না। রবীন্দ্রনাথও সস্নেহে সেগুলি পড়তেন, উত্তর দিতেন।
রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালাকে শেষ চিঠি লিখেছেন ১৯৪১ সালের ১০ মে মৃত্যুর মাত্র তিন মাস আগে।
চমৎকার লেখা ।হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ।স্মরণ করালেন, পাঠ করালেন।ধন্যবাদ ।
আপনার পরিশ্রম এবং আগ্রহকে সেলাম।
আপনার প্রশংসাই আমার পারিশ্রমিক। – শুভেচ্ছা নেবেন।
এককথায় অপূর্ব, দুকথায় অপূর্ব ও অসাধারণ।
“এককথায় অপূর্ব, দুকথায় অপূর্ব ও অসাধারণ” – বাক্যবন্ধটিই আমার কাছে দুর্দান্ত !
ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
আপনার অনলস অনুসন্ধান যে অজানা সম্ভার তুলে দেয় হাতে তা আমার মত পাঠকের অসাধারণ প্রাপ্তি।
আপনাদের মত পাঠকের আগ্রহ আর প্রশংসাই আমার লেখার পুরস্কার। ধন্যবাদ। ভালো থকবেন।
আপনার পরিশ্রমে আমরা ঋদ্ধ হই প্রতিনিয়ত। ধন্যবাদ আপনাকে।