গ্রীষ্মকালে শান্তিনিকেতনে অসম্ভব জলকষ্ট হত। নদীনালা মাঠঘাট শুকিয়ে, এমনকি সামান্য পানের জলটুকুও পাওয়া যেত না। আশ্রমবাসীদের কষ্টে কাতর রবীন্দ্রনাথ সবসময়ে চিন্তা করতেন কিভাবে এর সমাধান করা যায়। নানা সূত্র থেকে তিনি জানতে পারলেন যে, একমাত্র টিউবওয়েলের সাহায্যেই মাটির নীচ থেকে জল তুলে আনা সম্ভব। আর সেই জলই মানুষের তৃষ্ণা দূর করতে পারবে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে টিউবওয়েল সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না।

১৯১৩ সালে আমেরিকায় থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের আলাপ হল অখিলচন্দ্র চক্রবর্তী নামে এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ছাত্রের সঙ্গে। অখিলচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন বিদেশ থেকে টিউবওয়েল বসানোর পদ্ধতি ও কলাকৌশল শিখে আসেন। অখিলচন্দ্র গুরুদেবের কথা রেখেছিলেন। ১৯১৬ সালের আমেরিকা ভ্রমণের সময়েও রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে জলকষ্টের কথা ভুলতে পারেননি। নানা শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে অনেক খরচ করে টিউবওয়েল বসাবার কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনে এনেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এদেশের কোন ইঞ্জিনিয়ারই সেগুলি ব্যবহার করতে সক্ষম হন নি। ফলে বহুদিন মাটিতে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে যন্ত্রপাতিগুলি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে ১৯২২ সালে শিক্ষা সমাপ্ত করে অখিলচন্দ্র দেশে ফিরে এলেন। রবীন্দ্রনাথের কথামত তিনি টিউবওয়েল বসানোর কারিগরি শিক্ষা রপ্ত করে এসেছেন। শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানালেন সেকথা। এবার হাতে কলমে পরীক্ষার পালা সেই বিদ্যার। গুরুদেবের কাছে নিবেদন করলেন যে, তিনি বিনা পারিশ্রমিকে টিউবওয়েল বসানোর কাজটির দায়িত্ব নিতে চান। রবীন্দ্রনাথ সানন্দে রাজি হলেন। শান্তিনিকেতনে নলকূপ বসবে, মাটির বুকে জমে থাকা জল শান্তির বারি হয়ে উঠে আসবে ধরাতলে, সিক্ত করবে মানুষের তৃষিত হৃদয় । রবীন্দ্রনাথ সদ্যরচিত গানে আহ্বান করলেন সেই অমৃতবারিকে – এসো এসো হে তৃষ্ণার জল।

১৩২৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস। নলকূপের সাহায্যে মাটির নীচের জল উপরে তুলে আনা হবে। আলোড়ন পড়ে গেল শান্তিনিকেতন তথা সমস্ত বোলপুরে। যেকোনো শুভকাজে শান্তিনিকেতনে উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। যেদিন খননের কাজ শুরু হবে, সেদিন স্থানটি আলপনা ফুল আম্রপল্লব আর মঙ্গল ঘট দিয়ে সাজানো হল। আশ্রমবাসী সবাই এসে জড়ো হলেন। রবীন্দ্রনাথের পাশে বিধুশেখর শাস্ত্রী আর ক্ষিতিমোহন সেন মন্ত্রপাঠের জন্য প্রস্তুত। শিল্পী নন্দলাল অঙ্গন সাজিয়ে দিয়েছেন। গান, মাঙ্গলিক অর্ঘ্য, মন্ত্রপাঠ আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে মাটির বুকে ছিদ্র করা শুরু হল।

অখিলচন্দ্র আর আশ্রমবাসীরা প্রায় দুই সপ্তাহ অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন এসে সবাইকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বিধাতা বিরূপ। পাথরের মত শক্ত মাটি ভেদ করে কিছুতেই জলের স্তরে পৌছানো গেল না। এতগুলি মানুষের আশা ও পরিশ্রম বৃথা হয়ে গেল। দেবতা মুখ তুলে চাইলেন না।

১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মে উত্তরভারত ভ্রমণ শেষে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ফিরে এসেছেন। সে বছর বীরভূমে তীব্র জলাভাব ও অন্নাভাব। খরাপীড়িত অসহায় মানুষের দূর্দশা দূর করবার চিন্তায় রবীন্দ্রনাথ কাতর। বহু বছর আগে রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহ বীরভূমের ভুবনডাঙায় একটি বিশাল জলাশয় তৈরি করেছিলেন যা আশেপাশের বহু গ্রামের তৃষ্ণা নিবারণ করত। কিন্তু কালের নিয়মে আর অবহেলায় ক্রমেই সেটি শুকিয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের উদ্দ্যোগে ভুবনডাঙা জলাশয় সংস্কারের কাজ শুরু হল। অসংখ্য মানুষের অর্থ-সাহায্য, সমবায় ব্যংকের ঋণ এবং সকলের সমবেত কায়িক শ্রমের ফলে জলাশয়টি একদিন পুনর্জীবিত হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। সেবারের বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান এই জলাশয়ের পাড়েই উদযাপন করা হয়েছিল। শান্তিনিকেতনের জলের সমস্যার কিছুটা সমাধান হল।

এই কর্মকাণ্ডের কিছুদিন পরে অমূল্য বিশ্বাস নামে এক ভদ্রলোক কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি জানতেন যে প্রায় ১৪ বছর আগে একবার শান্তিনিকেতনে টিউবওয়েল বসানোর ব্যার্থ প্রচেষ্টা হয়েছিল। তিনি এটাও জানতেন যে সেই কাজের জন্য বিদেশ থেকে আনা অনেক যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। অমূল্য বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথকে বললেন, তাকে একবার সুযোগ দিলে তিনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন টিউবওয়েলের সাহায্যে মাটির নীচের জল তুলে আনা যায় কিনা। অমূল্যবাবুর ইঞ্জিনিয়ারিংএ কোন টেকনিক্যাল শিক্ষা ছিল না। কেবল ছিল সাধারণ ব্যবহারিক জ্ঞান এবং নতুন কিছু করবার শখ।
নিজে নতুন কিছু করে দেখবার প্রচেষ্টা কিম্বা অন্যকে উৎসাহ দেওয়া ছিল রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ঠ। সেই কাজে সফল না হলেও তিনি হতাশ হতেন না। রবীন্দ্রনাথ অমূল্যবাবুকে টিউবওয়েল বসানোর পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন, সেই সঙ্গে শুভেচ্ছাও। অমূল্যবাবু অল্পদিনের চেষ্টায়, পুরোনো বতিল যন্ত্রপাতিগুলির সাহায্যে টিউবওয়েল বসিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। মাটির তলা থেকে বহু আকাঙ্ক্ষিত জল ঝর্নার মত ঝরে পড়ল টিউবওয়েলের মুখ থেকে। এতদিনের অধরা অমৃতধারা, তৃষ্ণার জল পান করে রবীন্দ্রনাথ-সহ আশ্রমবাসীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। স্বপ্নপুরণের গৌরবে রবীন্দ্রনাথ সেদিনই লিখে ফেললেন আর একটি গান ‘হে আকাশবিহারী নীরদবাহন জল’।

রবীন্দ্রনাথ ঠিক করলেন এই কৃতিত্বের জন্য অমূল্যবাবুকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আলপনা ফুল দিয়ে সাজানো হল অনুষ্ঠানমঞ্চ, অতিথিরা একে একে চলে এসেছেন কিন্তু অমূল্যবাবু অনুপস্থিত। কোথাও তাঁর দেখা নেই। অবশেষে, অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তাঁকে ধরে আনা হল গোপন জায়গা থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মালাচন্দনে বরণ করে নিয়ে গাইলেন তাঁর সদ্যরচিত গান ‘হে আকাশবিহারী নীরদবাহন জল’। আসলে অমূল্যবাবু ছিলেন অত্যন্ত লাজুক মানুষ। তাই তিনি জনসমক্ষে আসতে চাইছিলেন না। যাইহোক অবশেষে শান্তিনিকেতনে জলের সমস্যার যথাযত সমাধান হল।
১৩২৯ এর ৩১ শ্রাবণ কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরি হলে বর্ষামঙ্গলের অনুষ্ঠানে ‘এসো এসো তৃষ্ণার জল’ গানটি গাওয়া হয়েছিল। আর সেই উপলক্ষে প্রচারিত বর্ষা-মঙ্গল পুস্তকাতেও গানটি মুদ্রিত ছিল। এছাড়াও বিশ্বভারতী দুর্গতি সহায়ক সঙ্ঘ আয়োজিত ম্যাডান থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত গীতোৎসব-এর আমন্ত্রণপত্রীতেও গানটির উল্লেখ রয়েছে। শাপমোচন নাটকের বিভিন্ন মঞ্চায়নের সময়ে এসো এসো তৃষ্ণার জল গানটি নানা সময়ে ব্যবহৃত হয়েছিল।


এসো এসো হে তৃষ্ণার জল রচনা ১৭ এপ্রিল ১৯২২ | রচনাস্থান শান্তিনিকেতন | কবির বয়স ৬০ বছর | স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর | শান্তিনিকেতন পত্রিকার আষাঢ় ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত | কবিকৃত ইংরাজি অনুবাদ Pitiless darts of fire strike a thirst pang in the heart of sky (POEMS)
হে আকাশবিহারী নীরদবাহন জল অন্যান্য তথ্য | রচনা আষাঢ় ১৩৪৩ | রচনাস্থান অনুল্লিখিত | কবির বয়স ৭৫ বছর | পর্যায় বিচিত্র | স্বরলিপিকার অনাদিকুমার দস্তিদার

সমৃদ্ধ হলাম।গানগুলো চিনি তবে এতোখানি নেপথ্য ইতিহাস জানতাম না।সুন্দর এবং প্রাঞ্জল লেখা।
লেখাটা পড়বার জন্য ধন্যবাদ। রবীন্দ্রনাথের লেখা বহু গানের গল্পগুলি বেশ চিত্তাকর্ষক। আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরে ভালো লাগছে।
যখন বিশ্বভারতীর ছাত্র ছিলাম আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকমশায়ের নিকট কিছুটা শুনেছিলাম এই বিষয়ে। এই প্রতিবেদন পাঠ করে আবার তা স্মরণে এল। তবে এত বিস্তারিতভাবে হয়ত জানা ছিল না। সমৃদ্ধ হলাম। আপনাকে ধন্যবাদ। শুভ বিজয়া।
বড় চমৎকার সুপেয় লেখা । মন ভাল হয় । মানষের মঙ্গল সাধন এর ইতিহাস সব সময় তৃষ্ণা মেটায় ।
অভিনন্দন রইল এমন মিশন এ ।
নমস্কারন্তে । শুভ বিজয়া সুভেচ্ছা সহ ।
অনেক ধন্যবাদ। শনিবারের লেখাগুলি আপনার ভালো লাগছে জেনে তৃপ্তি পেলাম। শনিবারের ব্লগের কথা আপনার সমমনষ্ক বন্ধুদের জানালে উৎসাহিত হব। বিজয়ার শুভেচ্ছা নেবেন।