দেশ দেশ নন্দিত করি No ratings yet.

অ্যানি বেসান্ত (১৮৪৭-১৯৩৩) ব্রিটিশ সমাজতান্ত্রিক, থিওসফিস্ট,  নারী অধিকার  আন্দোলনকারী, লেখক, বাগ্মী  এবং আইরিশ ও ভারতীয় স্বায়ত্ত শাসনের সমর্থক।  ব্রহ্মচর্চা সম্পর্কিত কাজের অংশ হিসাবে, ১৮৯৮ সালে তিনি ভারতে আসেন এবং ধীরে ধীরে  ভারতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারকে যুদ্ধে সাহায্য করবার প্রশ্নে জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধা বিভক্ত। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ শাসক ভারতরক্ষা আইনের বলে হাজার হাজার যুবককে বিনা বিচারে জেলে আটক করেছেন। তখন ভারতীয় রাজনীতিকে জন-আন্দোলনের রূপ দেবার উদ্দেশে ১৯১৬ সালে অ্যানি বেসান্ত এবং বালগঙ্গাধর তিলক (১৮৫৬-১৯২০) দুটি হোমরুল লীগ (স্বায়ত্তশাসনার্থে গঠিত রাজনৈতিক সংস্থা) স্থাপন করেন। হোমরুল লীগের কল্যাণে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে সারা ভারত উত্তাল হয়ে উঠল। আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা দেখে সরকার দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেন।  শ্রীমতী বেসান্তের এইসমস্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ রাজদ্রোহী-মূলক ঘোষনা করে ১৬ জুন ১৯১৭ মাদ্রাজে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল।

১৯১৭ সালে আমেরিকার ভ্রমণ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে এসেছেন। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও এই আন্দোলনের অনেক নেতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল। তাই অ্যানি বেসান্তের গ্রেপ্তারের খবর তাঁকে ক্ষুব্ধ ও বিচলিত করেছিল। New India পত্রিকায় তিনি তাঁর কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। এদিকে বেসান্তের গ্রেপ্তার তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তাঁকে রাতারাতি জননেত্রীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করল। কলকাতা কংগ্রেসের নেতা  ভূপেন্দ্রনাথ বসুর আহ্বানে বেসান্তের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে টাউন হলে একটা জনসভা করবার আবেদন জানানো হলে অনিবার্যভাবে কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে দিলেন। অগত্যা ঠিক হল রামমোহন লাইব্রেরি হলে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুষ্ঠান করা হবে। বেসান্তের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সহানুভূতির কথা জেনে তাঁকেও আমন্ত্রণ জানানো হল কিছু বলবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে পূণ্যাহ উপলক্ষে শিলাইদহের রয়েছেন। সেখানেই রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত ভাষণ ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ যার ছত্রে ছত্রে  প্রকাশ পেয়েছে সমকালীন রাজনৈতিক পটভূমিকার ছবি আর দেড়শো বছরের ইংরেজ শাসনের সমালোচনার কথা। শিলাইদহ থেকে ২৪ জুলাই কলকাতায় ফিরে এই প্রতিবাদ সভায় গাইবার জন্য তিনি রচনা করলেন দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী গানটি।

কালিদাস নাগ আর প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে একদল ছেলে কবির অনুমতি নিয়ে কোরাসে গাইবার জন্য জোরদার রিহার্সাল শুরু করে দিল। আগস্ট মাসের ৪ তারিখে রামমোহন লাইব্রেরি হলে প্রতিবাদ সভায় রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার (কর্তার ইচ্ছায় কর্ম) পরে গানটি কোরাসে গাওয়া হলে উপস্থিত শ্রোতারা উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন।  

এরপরে আরও বৃহত্তর আকারে সভাটি করবার জন্য চেষ্টা করেও কোনো বড় হল পাওয়া গেল না। অবশেষে ম্যাডান সাহেবের আনুকূল্যে অ্যালফ্রেড থিয়েটারের ১১ আগস্ট সভাটি অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল। রবীন্দ্রনাথ এখানেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন  যেহেতু তাঁর বক্তব্য হোমরুল আন্দোলনের সমর্থক, তাই রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, ‘আমাকে পুলিশ আজ নিশ্চয়ই গ্রেপ্তার করবে’।  অবশ্য বৃটিশ সরকার ‘নাইট’ রবীন্দ্রনাথকে ধরবার সাহস দেখাতে পারে নি।   

কলকাতায় প্রায় একমাস থাকবার পরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ফিরে যান। ১৬ আগস্ট বীথিকায় একটি প্রবন্ধপাঠ অনুষ্ঠানে ‘দেশ দেশ নন্দিত করি’ গানটি গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এত ভীড় হয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে নির্ধারিত  কর্তার ইচ্ছায় কর্ম প্রবন্ধটির বদলে গান্ধারীর আবেদন কবিতাটি পড়ে শোনান।

ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখে কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে মহাত্মা গান্ধী, লোকমান্য তিলক, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে কংগ্রেসের ৩২ তম অধিবেশনের সমাপ্তি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ দেশ নন্দিত করি গানটি গেয়েই।   

অন্যান্য তথ্য  |  রচনা ভাদ্র ১৩২৪ | রচনাস্থান কলকাতা | কবির বয়স ৫৬ বছর | পর্যায় স্বদেশ স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিকৃত ইংরাজি অনুবাদ : Thy call has sped over all countries of the world (POEMS)

Please rate this

Join the Conversation

3 Comments

  1. সমৃদ্ধ হলাম। অপেক্ষায় থাকি…. শনিবারের ব্লগের জন্য

  2. তথ‍্যসমৃদ্ধ রচনা। প্রতিবারের ব্লগে এক মুগ্ধতা নিয়ে সমৃদ্ধ হই। এবারেও তার ব‍্যতিক্রম হলো না।

  3. কথা ছবি আন্তরিক ইতিহাস ও চেষ্টা সব প্রনম্য ।
    কলহন সান্যাল
    7-11-2020

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *