পদ্মাবোট No ratings yet.

পদ্মার বুকে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে সূর্যাস্তের রঙিন আভা পশ্চিমের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। শান্ত জলে মৃদু ঢেউ তুলে তরতর করে এগিয়ে চলেছে সুদৃশ্য বজরাটা। নদীর একদিকের বালুচর দিগন্তে মিশেছে, অন্যদিকে অন্ধকার ঘনজঙ্গল। ডেকচেয়ারে পশ্চিমের সূর্যাস্তের দিকে চেয়ে রয়েছেন বছর তিরিশের দীর্ঘদেহী এক যুবক। কোলের উপরে রাখা ছোট খাতাটায় সদ্য লেখা একটি গানের কলি। যুবকের নাম রবীন্দ্রনাথ আর বজরাটি পদ্মাবোট, রবীন্দ্রনাথের ভাসমান আবাস। পদ্মাবোট রবীন্দ্রনাথের জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষী। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত জমিদারির কাজে শিলাইদহ-বাসের বেশীরভাগ সময়টাই তাঁর কেটেছে  পদ্মানদীর বুকে, এই পদ্মাবোটে।

পদ্মাবোট তৈরি করেছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, সম্ভবত উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে। তখন যাতায়াতের জন্য নদীপথই ছিল রাজপথ। সম্ভ্রান্ত ধনী লোকেরা নিজেদের জন্য ব্যবহার করতেন নৌকা, বজরা ইত্যাদি নানা ধরণের জলযান। এই নিয়ে রেষারেষি চলত সম্ভ্রান্ত উচ্চবিত্তদের মধ্যে। বজরাকে বলা হত বোট। কার কটা বোট, কেমন তাদের আকার, ভিতর বাইরের সাজসজ্জার কত বাহার এই সব ছিল প্রতিযোগীতার বিষয়। দ্বারকানাথের আকর্ষনীয় বজরাটি ছিল এদের মধ্যে অন্যতম। একবার ১৮৪৬ সালে স্ত্রী সারদাসুন্দরী দেবীকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ এই বোটে চড়ে যখন বারানসীর দিকে চলেছেন, তখন যাত্রাপথেই পিতা দ্বারকানাথের মৃত্যুর সংবাদ (১ আগস্ট ১৮৪৬) পেয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।

বজরা বা বোট তৈরিতে ঢাকার কারিগরেরা ছিলেন ওস্তাদ। বাংলাদেশের অগভীর নদীপথে চলবার জন্য বজরার তলাটা হত চ্যাপ্টা। থাকত খোলামেলা বড় কামরা। চেয়ার টেবিল, খাট আলমারি জানলা দরজার পর্দা সবকিছু। এছাড়া রান্নাঘর, স্নানঘর, বারান্দা, ডেক আর উপরের ছাদ তো থাকতই। এককথায় স্থবির বাসস্থানের সবটুকু আরাম আর সুবিধাযুক্ত চলন্ত জলযান। খিদমৎ খাটবার জন্য হাজির থাকত মাঝিমাল্লা, ফটিক, পুঁটে, বিপিন, আর অন্যান্য কর্মচারীর দল। এরা বেশীরভাগই থাকত নদীর চরে অস্থায়ী চালঘর বেঁধে।

পদ্মাবোটের সঙ্গে বাঁধা থাকত একটি নৌকা বা জালিবোট। রবীন্দ্রনাথ এটির নাম রেখেছিলেন চপলা। এতে চড়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই দাঁড় টেনে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন। আবার অতিথিরা আসলে এই জালিবোটেই আড্ডা আর গানের আসর বসত। জগদীশচন্দ্র বোস, লোকেন পালিত, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত বহু মানুষ পদ্মাবোটের অতিথি হয়ে এসেছেন বারবার।

ঠাকুরবাড়ির ছিল অনেকগুলি বজরা। তাদের নাম পদ্মা, চিত্রা, দুর্গা, আত্রেই আর নাগর। সবচেয়ে বড় আর সুন্দরী বজরাটি পদ্মা। সে ছিল পদ্মা নদীর মতই রবীন্দ্রনাথের প্রিয়। তিনিই এটির নাম রেখেছিলেন পদ্মাবোট। দ্বারকানাথের পরে দেবেন্দ্রনাথ কিছুদিন এই বোটটি ব্যবহার করেছেন। তারপরে এটিকে শিলাইদহে রেখে দেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে এলেন, তখন উত্তরাধিকার সূত্রে পদ্মাবোট এসে পড়ল তাঁর হাতে। এবং তারপরের দীর্ঘ দশ-এগারো বছর পদ্মাবোটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল। বাড়ির চাইতে বোটে চড়ে পদ্মায় বাস করতে তাঁর বেশী ভালো লাগত। পদ্মা ছাড়াও যমুনা গোরাই, ইছামতী, নাগর ইত্যাদি নদীপথেও পদ্মাবোটের চলাচল ছিল।

পদ্মাবোট রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষী। এই বোটেই লেখা হয়েছে সোনার তরী, উর্বশী, মানসীর মত কবিতা। চিত্রা, চৈতালি, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, গীতাঞ্জলির বহু কবিতার জন্ম এই বোটে। কত গান রচিত হয়েছে এখানে! গল্পগুচ্ছের বেশীরভাগই ছোট গল্প লিখেছেন এই বোটে। ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর অধিকাংশ চিঠিই লিখেছেন এই বোটে বসেই, যেখানে আমরা পদ্মা নদী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক দৃষ্টিনন্দন চিত্ররূপ পাই।

পদ্মাবোটে কবির দিন শুরু হত খুব ভোরে। স্নানঘরের কাজ শেষ হলে ফটিকের রেখে যাওয়া একবাটি ডাল খেয়ে বসে যেতেন লেখালেখি নিয়ে। মাঝে মাঝে জলে নেমে পড়তেন সাঁতার কাটবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ খুব ভালো সাঁতার জানতেন। চুঁচুড়ায় থাকবার সময়ে প্রায়ই সাঁতরে গঙ্গা এপার ওপার করতেন। দুপুরে বিশেষ ঘুমাতেন না। হয় লিখতেন নতুবা জানলা দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতেন তীরের শস্যক্ষেত, পদ্মার চর, ঘাটের চলমান জীবন-ছবি। সন্ধ্যা হলে ডেকের আরাম কেদারায় পা ছড়িয়ে বসতেন। মনের কথা প্রকাশ করেছেন ছিন্নপত্রাবলীতে, …সেই জ্যোৎস্না, সেই জলের কল্লোল স্বর্গসুখ বহন করে আনে। মুখের উপর মাথার উপর জ্যোৎস্নার শুভ্রহস্ত আদরের স্পর্শ করতে থাকে। আকাশে চকোর পাখি ডেকে চলে যায়, আকাশব্যাপী স্নিগ্ধ রাত্রি আমার রোমে রোমে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে শরীরের উত্তাপ জুড়িয়ে দেয়। – চোখ বুজে, কান পেতে, দেহ প্রসারিত করে প্রকৃতির একমাত্র যত্নের জিনিসের মত পড়ে থাকি। তার সহস্র সহচরী আমার সেবা করে। মনের কল্পনার কোনো বাঁধ থাকে না

কত ঘটনার সাক্ষী এই পদ্মাবোট। সেবার বোট চলেছে মাঝপদ্মা দিয়ে। ডেকচেয়ারে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বই পড়তে পড়তে আনমনে পা নাচাচ্ছেন। পাশে পুত্র রথীন্দ্রনাথ। একটা ‘ঝুপ’ শব্দ শুনে চেয়ে দেখলেন বাবার পায়ের একপাটি কটকি চটি জলে পড়ে দূরে ভেসে চলেছে। কিছু বোঝবার আগেই আবার শব্দ ‘ঝপাং’। রবীন্দ্রনাথ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে চটিটা ধরবার চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি জল থেকে উঠে এলেন। মুখে তৃপ্তির হাসি, হাতে চটি।

আর একবার কবির প্রাণসংশয় ঘটেছিল পদ্মাবোটে। ঘোর বর্ষাকাল, উত্তাল নদী বেয়ে পদ্মাবোট চলেছে শিলাইদহের দিকে। পথে গোরাই ব্রিজে বোটের মাস্তুল আটকে গেল। ধীরে ধীরে কাত হয়ে বোট ডুবে যাওয়ার মত অবস্থা। কোনো মতে একটা নৌকা করে কবিকে নিরাপদে ডাঙায় নিয়ে আসা হল। মাঝিমাল্লা আর স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় কোনোমতে খাঁড়া করা হয়েছিল কবির সাধের পদ্মাবোটকে।

নদীপথে এই ধরণের বিপদ ঘটেছে বারবার  আর একবার কালীগ্রাম থেকে সাজাদপুর যাওয়ার পথে পদ্মার ভয়ংকর স্রোত পদ্মাবোটকে মারাত্মক বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায়, ওরে বাস রে ! কী তুমুল ব্যাপার। এইমাত্র একটা মস্ত ফাঁড়া কেটে গেল। এ জায়গাটা একটা সংকীর্ণ খালের মত, আঁকাবাঁকা। এইটুকুর ভিতর দিয়ে বিপুল জলস্রোত ফেনিয়ে ফুলে একেবারে যেন ঝর্নার মত ঝরে পড়ছে। ক্রুদ্ধ জল সমস্ত বোটটাকে একেবারে ফেড়ে-ছিঁড়ে ঝুঁটি ধরে টেনে  নিয়ে চলল। কী হল কী হচ্ছে কিছু বোঝবার অবসর পাওয়া যায় না। – বুকের মধ্যে প্রাণটা নিশ্বাস রুদ্ধ করে স্তম্ভিত হয়ে থাকে

আরও একবার। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন উত্তাল পদ্মায় ভেসে যাচ্ছে এক যুবতী। মাঝিদের বললেন জালিবোট নিয়ে তাকে উদ্ধার করতে। কিন্তু নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে মাঝিরা ইতস্তত করছে দেখে কবি নিজেই নেমে পড়লেন বোট নিয়ে। শেষে গফুর মিঞা তাঁকে নিরস্ত করে অন্য মাঝিদের নিয়ে মেয়েটিকে তুলে আনলেন সাক্ষাত মৃত্যুর মুখ থেকে। জানা গেল স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে সে জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। শেষে রবীন্দ্রনাথের মধ্যস্থতায় সবকিছু মিটমাট হয়েছিল।

পদ্মাবোটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রথীন্দ্রনাথের অনেক সুখস্মৃতি। বলেছেন, মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা আমাকে খুব অল্প বয়স থেকেই তাঁর সঙ্গে বোটে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সেই জন্য তিনি বোটে কীভাবে থাকতেন, সেখানে তাঁর সময় কী করে কাটত, আমার কিছুটা জানা হয়ে গিয়েছিল আবার বিদেশে কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার শেষে শিলাইদহে পদ্মাবোটে বাবাকে পেয়েছিলেন একান্ত আপন করে। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের কথাবার্তা,  উপদেশ আর জীবনদর্শন রথীন্দ্রনাথের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

তারপরে একদিন কালের নিয়মে চালু হল রেলপথ, এসে গেল যোগাযোগের নানা উপায়। যাতায়াতের জন্য নদীপথের গুরুত্ব কমে গেল। ধীরে ধীরে অন্যদের মত বিলীন হয়ে গেল পদ্মাবোটের অতীত গৌরব। রথীন্দ্রনাথ পদ্মাবোটকে নিয়ে এলেন উত্তরপাড়ার গঙ্গায়। ততদিনে  শুরু হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানি বোমার ভয়ে নদীপথের সমস্ত জলযানগুলি ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। রথীন্দ্রনাথ খুব ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে পদ্মাবোটকে নিয়ে এলেন পতিসরে। তারপর অযত্নে অবহেলায় একদিন নিশ্চিহ্ন গেল কবির স্মৃতিবিজড়িত ভালোবাসার পদ্মাবোট।

রেপ্লিকা   

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের অঙ্গ হিসেবে পদ্মাবোটের একটি রেপ্লিকা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে উপহার দিয়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। চম্বল টিককাঠের চার ফুট বাই এক ফুট তিন ইঞ্চির রেপ্লিকাটি এখন রাখা আছে বিচিত্রা ভবনে রবীন্দ্রভারতী সংগ্রহশালায়।
শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতেও সংরক্ষিত রয়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে উপহার হিসাবে প্রাপ্ত পদ্মাবোট  এবং চপলা জালিবোটের রেপ্লিকা

Padmaboat is Rabindranath Tagores Bajra in Selidaha Posted in Sanibarer Blog of Purnendu Bikash Sarkar. Tagore wrote many Rabindra Sangeet, Poems, at Jorasanko Thakurbari

Please rate this

Join the Conversation

5 Comments

  1. অসাধারণ l বক্তব্যের সরসতা সহজেই সম্পূর্ণ পাঠের দিকে আকর্ষণ করে!

  2. সমৃদ্ধ হচ্ছি। কিছুটা জানতাম। সবটা নয়। ধন‍্যবাদ আপনাকে। আপনার মত একজন রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।

  3. আজ অনেক নতুন তথ‍্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম ও সমৃদ্ধ হলাম। দারুন লেখা হচ্ছে।

  4. অনেক নতুন নতুন ঘটনাবলির দ্বারা নিজেকে সমৃদ্ধ করলাম। ধন্যবাদ।

  5. Khub valo laglo. Porte porte amio oituku samoyer jonyo chole gechhilam. ..jali boat. .
    Podmaboat e. Apurbo. ..dal Lake e shikara chora r house boat. …er kathao mone elo.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *