ব্যথার বীণা
গুরুদেব বসে রয়েছেন তাঁর আরামকেদারায়। পিছনে লেখার টেবিলের স্তূপাকার বই, খাতাপত্র আর কলম। পায়ের কাছে এক তরুণ হাতে মোটা খাতা নিয়ে বিড়বিড় করে কবিকে পড়ে শোনাচ্ছে তার লেখা কবিতা। কিছুটা পড়বার পরেই মাঝে মাঝে সে খেই হারিয়ে ফেলছে। গুরুদেব গম্ভীর বিষন্নমুখে শুনছেন অচেনা সেই তরুণ কবির কবিতা। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে বলতে পারছেন না যে, আমার সময় নেই।
১৯২৬ এর মার্চ মাসে অসুস্থ হয়ে পড়লে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় প্রশান্ত মহলানবিশের আলিপুরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন নিরিবিলতে বিশ্রাম নেবার জন্য। সেখানেই একদিন এই তরুণ ছেলেটি আসে কবিকে নিজের লেখা কবিতা শোনাতে। কিন্তু সে ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন। বিধাতার পরিহাসে তার কবিত্বশক্তির পূর্ণতা পাবার অবকাশ ছিল না। এই বেদনা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ‘তোমার বীণা আমার মনোমাঝে কখনো শুনি’ গানটি রচনা করেছেন ।
নির্মলকুমারী মহলানবিশ নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এই গান রচনার পটভূমির বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বাইশে শ্রাবণ বইটিতে। ‘রোজই স্নানের বেলা হয়ে গেলে আমি গিয়ে তাগিদ দিয়ে লেখার টেবিল থেকে ওঠাই। সেদিনও সময়মত গিয়ে দেখি তখনও ছেলেটি বসে আছে। আরো একটু অপেক্ষা করে আবার যখন ফিরে গেলাম দেখি উনি গম্ভীর হয়ে একা বসে, আগন্তুক চলে গেছে। আমি ঘরে ঢুকতেই বলে উঠলেন, ‘জানো, ও পাগল? বেচারার জন্য আমার ভারি মন খারাপ হয়ে গেছে। মস্ত একটা কবিতার খাতা নিয়ে এসেছিল আমাকে শোনাবে বলে। এত কাজ হাতে জমে আছে, তবু বলতে পারলাম না যে, আমার সময় নেই। ওর যদি মাথা খারাপ না হত তাহলে একজন উঁচু দরের কবি হতে পারত। বেচারার কবিতাগুলোর আরম্ভ বেশ পাকা রকমেরই হয়, কয়েকটা লাইন লিখতে লিখতে সূত্র ছিঁড়ে যায়, আর শেষ করতে পারে না। ও নিজে জানে না যে ও পাগল, তাই ভেবে পায় না কেন যে শেষ পর্যন্ত ওর লেখা পৌঁছায় না। তাই এসেছিল আমার কাছে যদি কিছু সাহায্য করতে পারি। ও বেচারার জন্য আজ আমার এত কষ্ট হয়েছে যে, সমস্ত সকালটা কাজ ফেলে দিয়ে ওর অনুরোধ রক্ষা করে লেখাগুলো শুনলুম। হতভাগ্য একটুর জন্য বাণীর প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে’।
সেদিন দুপুরে রবীন্দ্রনাথ আর কোনো কাজ করতে পারলেন না। যে বেদনার সুর মনের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল সেটাই গান হয়ে ফুটে উঠল তাঁর কলমে। ‘তোমার বীণা আমার মনোমাঝে কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে‘।
এই গান সম্পর্কে একটি হাস্যকর ও মজাদার ঘটনার উল্লেখ আছে। নিজের বানানো কথা অন্যের মুখে বসিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচার করবার কুশ্রী বদভ্যাস ছিল দিলীপকুমার রায়ের। এবং তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একজন কট্টর সমালোচক। তিনি একবার রবীন্দ্রনাথের গানে সুরারোপ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তখন (২৯ মার্চ ১৯২৫) রবীন্দ্রনাথ দিলীপকুমারকে বলেছিলেন, ‘তুমি কি বলতে চাও আমার গান যার যেমন ইচ্ছা সে তেমনই ভাবে গাইবে? আমি তো নিজের রচনাকে সেরকম ভাবে খণ্ডবিখণ্ড করতে অনুমতি দেই নি। যে রূপ সৃষ্টিতে বাইরের লোকের হাত চালাবার পথ আছে তার এক নিয়ম, যার পথ নেই তার অন্য নিয়ম। .. আমার গানে আমি তো সেরকম ফাঁক রাখি নি যে, সেটা অপরে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব’।
তা সত্বেও একদিন দিলীপকুমার জানালেন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘তোমার বীণা আমার মনোমাঝে’ গানটিতে সুর দিতে অনুরোধ করেছেন। শুধু তাই নয় ভারতবর্ষ পত্রিকায় স্বরচিত সুর আর স্বরলিপি-সমেত তা ছাপিয়ে দিলেন। এবং এটাও লিখে দিলেন, ‘গত ১২ এপ্রিল তারিখে কবিবর শান্তিনিকেতনে আমাকে তাঁর এই স্বরচিত গানটিতে সুর দিতে বলেন। তার পর দিন গানটিতে এই সুরটি সংযোজিত করে তাঁকে শোনাই … তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন ও বলেছিলেন ….যে তাঁর গানে কেউ সম্পূর্ণ নতুন সুর দিয়ে গাইলে সেটা অনুচিত হয় না’। নিজের গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ এতই অনুভূতি-প্রবণ ছিলেন যে, নিজের গানে অন্যকে সুর দিতে বলবেন, এর চেয়ে অবিশ্বাস্য কথা আর কিছুই হতে পারেনা। দিলীপকুমারের স্পর্ধিত লেখাটি প্রকাশের সময়ে রবীন্দ্রনাথ বিদেশে ছিলেন। এই অর্বাচীন মূর্খের সঙ্গে তর্ক করাকে তিনি অবান্তর ও অশ্রদ্ধেয় মনে করে নীরব ছিলেন।
অন্যান্য তথ্য | রচনা ১৬ মার্চ ১৯২৬ | রচনাস্থান কলকাতা | কবির বয়স ৬৪ বছর | পর্যায় পূজা | স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
তথ্যসূত্র | রবিজীবনী(৯) প্রশান্তকুমার পাল। বাইশে শ্রাবণ নির্মলকুমারী মহলানবিশ | ভারতবর্ষ (জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩) | গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
অসম্ভব তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।অনেক অজানা কথা পাঠক জানতে পারছেন।ভালো লাগছে।শুধু শেষে দিনেন্দ্রনাথের স্পর্ধিত লেখা হবে না মনে হয়।দিলীপকুমারের হবে।
একদম ঠিক, তবে দিলীপকুমার রায়ের স্বরলিপি সে অর্থে কোনও মান্যতা কোনও দিন পায় নিl নমস্কার
Gantir utso jene valo laglo
Apnar ei parber blog khub bhalo lagchhe.ajkal Rabindranath jahkan ‘shudhu 25she baishakh r 22she shrabon ‘ sei samaye apnar lekha aneker madhye byakti Rabindranath o tnar bichitra karmakaando samparke agroher sanchaar korbe.gabesakeder proti shroddha rekhei bollcchi apni apner kajke ei je sarbosadhroner sange bhag kore nichhen e atulonio dristanto.stuti noi amar moner kotha.
শনিবারের ব্লগের লেখাগুলি সম্বন্ধে আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ব্লগের এই পর্বের বিষয়বস্তু ‘রবীন্দ্রনাথের গানের গল্প’, কিন্তু একই সঙ্গে গান রচনার সময়ে রবীন্দ্রনাথের মানসিকতা ও সমসাময়িক রাজনৈতিক এবং সামাজিক পটভূমিকার ছবিটিও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আপনার লেখা পড়ে অনুভব করছি, আমার সেই প্রচেষ্টা কিছুটা সার্থক হচ্চে।
চমৎকার একটা কাজ করছেন। প্রতি রবিবার সমৃদ্ধ হচ্ছি। আপনাকে কুর্নিশ। ভালো থাকুন।
শনিবারের ব্লগটি নিয়মিত পড়বার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। সঙ্গে থাকবেন এবং আপনার সমমনস্ক বন্ধুদেরও জানাবেন এই ব্লগের কথা ।