যশোরের ফুলতলি গ্রামের মেয়ে দশবছরের ভবতারিনীর ডাকনাম ফুলির বিবাহ হল ১২৯০ বঙ্গাব্দে ২২ বছরের তরুণ কবি বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। অসাধারণ রূপবান, য়ুরোপ ঘুরে এসেছেন এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিশীল স্বদেশী ও বিদেশী সুন্দরীদের সান্নিধ্যও হয়েছে। বনফুল, ভগ্নহৃদয়, য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ। ভানুসিংহের পদাবলী রচনাও সমাপ্ত।
ভবতারিনীর সামান্য শিক্ষা গ্রামের পাঠশালায়। বিয়ের সময়েই হল নাম পরিবর্তন। নাম হল মৃণালিনী। রবির আলোকে পদ্মফুল ফুটে ওঠে। এই মৃণালিনীকে প্রস্তুত হতে হয়েছিল স্বামীর জন্য। সারাজীবনই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়েছিল এই আলোকসামান্য পুরুষের জন্য। বিবাহের পর মহর্ষির পরিবারে মৃণালিনীর বিদ্যাশিক্ষার ভার প্রথম পড়েছিল হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নীপময়ীর ওপর। সেখানে হত যশোরের বাঙাল টান সংশোধন করার কাজ। মহর্ষির নির্দেশে হেমেন্দ্রনাথের কন্যাদের সঙ্গে তিনি গেলেন পড়তে Loreto Convent এ। মৃণালিনী ঠাকুর পরিবারে এসেও তার পুতুলের খেলাঘর সাজিয়ে পরিতৃপ্ত থাকতেন। খেয়া কবিতার বালিকাবধূ কবিতায় কবি এঁকেছেন নিজের বালিকাবধুরই ছবি।
এই বালিকাবধূর Loreto তে চর্চা শুরু হল ইংরাজী ভাষা শক্ষা, পিয়ানো বাজানো আর সংগীত চর্চা। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ, অভিজাত পরিবারের আদবকায়দা ও গৃহস্থালী শিক্ষা। Loreto তে শিক্ষা বেশিদিন চলেনি। একবছর সেখানে ছিলেন। সন্তানসম্ভবা হওয়ায় পড়া ছাড়তে হল। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য বাড়িতে এলেন হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে তিনি রামায়ণের গল্পংশের শ্লোকের বাংলা ব্যাখ্যা করতেন এবং মৃণালিনী সেই ব্যাখ্যা শুনে শুনে তার বাংলায় অনুবাদ লিপিবদ্ধ করতেন। এইভাবে রামায়ণের গল্পংশের অনুবাদ শেষ হয়েছিল।
সংস্কৃত অনুরাগী ভাতুপুত্র বলেন্দ্রনাথ তাঁর কাকিমা মৃণালিনীকে বুঝিয়ে দিনে সংস্কৃত কাব্য নাটকের শ্লোক, গদ্যাংশ – সরল বাংলায়। এভাবে সংস্কৃতে কিছুটা পারদর্শিতা তাঁর হয়েছিল। রামায়ণের অনুবাদের খাতাটি পাওয়া যায়নি। কিন্তু শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে রাখা একটি খাতায় মৃণালিনীর পেন্সিলে লেখা মহাভারত, মনুসংহিতা, ঈশাপোনিষদ ও কঠোপনিষদের কিছু কিছু অনুবাদ আছে। মীরাদেবীর স্মৃতি থেকে জানা যায় যে তিনি ইংরাজী নভেল পড়তেও পছন্দ করতেন। প্রিয়নাথ সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে জানা যায় যে মৃণালিনী মার্ক টোয়েনের লেখায় বিশেষ আমোদ পান। রবীন্দ্রনাথের আর একটি চিঠি থেকেও মৃণালিনীর পড়ার অভ্যাসের আভাস পাওয়া যায়। কবিপত্নী হয়ত সুস্থ ছিলেন না আর কবি জমিদারী পরিদর্শনে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। সাজাদপুর থেকে কলকাতায় লিখছেন — “আজকাল তুমি দুবেলা খানিকটা করে ছাদে পায়চারি করে বেড়াচ্ছ কিনা আমায় বল দেখি। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে সেই কেদারাটার ওপর পা ছড়িয়ে বসে একটু একটু করে পা দোলাতে দোলাতে দিব্যি আরামে নভেল পড়চ।” আমরা আভাস পাই ভবতারিনী থেকে মৃণালিনী হয়ে ওঠার।
মৃণালিনীকে কিশোরী বয়সেই একটি গুরুদায়িত্ব নিতে হয়েছিল। পরপর সন্তান হওয়ায় সংসারে জড়িয়ে পড়লেন ঠিকই, তার সঙ্গে এসে পড়ল বিশাল জোড়াসাঁকো বাড়ির গৃহিণীর দায়িত্ব। এর কারণও ছিল। বড় জা সর্বসুন্দরী অকালে প্রয়াতা। মেজ জ্ঞানদানন্দিনী বহুকাল জোড়াসাঁকোর বাইরে থাকেন। সেজ জা নীপময়ী বিধবা ও তাঁর পুত্র কন্যা নিয়ে ব্যস্ত। কাদম্বরী মৃতা, প্রফুল্লময়ীর স্বামী বিকৃত মস্তিক, তিনি তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। মহর্ষির জ্যেষ্ঠা কন্যা সৌদামিনী যিনি ছিলেন বাড়ির গৃহিণী তিনি চলে গেলেন পিতার সঙ্গে পার্কস্ট্রীটে। অতএব এই বড় সংসারের দায়িত্বভার এসে পড়ল তরুণী ছোটো বৌ-এর ওপর।
শিলাইদহ কুঠিবাড়িরও তিনি ছিলেন গৃহিণী। রন্ধনপটিয়সী, অতিথিসৎকারে নিপুণা এই নারীর সংসারে গেছেন সিস্টার নিবেদিতা। তাঁর সঙ্গে একটি সখ্য গড়ে উঠেছিল মৃণালিনীর। গেছেন জগদীশচন্দ্র বসু, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনারায়ণ রায়, অমলা দাশ এবং জোড়াসাঁকো বাড়ির কবির ভাইপো, ভাইঝিরা। মৃণালিনী সকলকে ভালবাসতেন। তাঁর ছিল বাগানের শখ। কুঠিবাড়িতে তিনি যেমন শাকসজীর বাগান করেছিলেন তেমনি করেছিলেন ফুলের বাগান। অবসর সময়ে মেয়েদের নিয়েও তিনি বাগানের কাজকর্ম করেছেন। মৃণালিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকেও মৃণালিনীর এই উদ্যান প্রীতির কথা জানা যায়। তিনি লিখছেন “তোমাদের বাগান এখন কি রকম? কড়াইশুটি কতদিনে ধরবে’? আরেকটি চিঠিতে কলকাতায় স্ত্রীকে জানাচ্ছেন — “তোমার শাকের ক্ষেত ভরে গেছে কিন্তু ডাঁটা গাছগুলো বড্ড বেশি ঘন হয়ে যাওয়াতে বাড়তে পারছেনা। – কুমড়ো অনেকগুলো পেড়ে রাখা হয়েছে। রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, মালতী, ঝুমকো, মেদি খুব ফুটছে হাসনু হানা ফুটছে কিন্তু গন্ধ দিচ্ছে না’ – এই চিঠির শেষে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা দিচ্ছেন বর্ষার পরে পুকুর জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে আখের ক্ষেত বেড়ে উঠেছে, মাঠ শষ্যে পরিপূর্ণ — কোথাও সবুজের বিচ্ছেদ নেই৷ সবাই রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করছে ‘মা কবে আসবেন। এ চিঠি ১৯০১ এ লেখা। কবিপত্নীর বয়স তখন আঠাশ এবং তাদের প্রথমা কন্যা মাধুরীলতার বিবাহ হয়ে গেছে। এই চিঠি লেখার মাত্র দু বছর আগে মৃণালিনীর সমবয়সী রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভাইঝি ইন্দিরার বিয়ে হয় ছাব্বিশ বছর বয়সে।
সংসারজীবনে গৃহিনীর কতৃশক্তিকে কবি বরাবর সম্মান করেছেন। আত্মীয় পরিজনদের লেখা ঘরোয়া চিঠিপত্রেও তাঁর কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। স্বামীর সমবয়সী ভাগ্নে সত্যপ্রসাদকে ‘সত্য’ সম্বোধনে চিঠি লিখছেন মৃণালিনী “সত্য, আগেকার যে পঞ্চাশ টাকা আমার নামে সরকারীতে হাওলাত আছে আর সেদিন যে চল্লিশ টাকা নিয়েছি এই নব্বই টাকা এ মাসে কেটে নিও না। এ মাসে কেটে নিলে আমার খরচ চলা অসম্ভব“।
বোলপুরে আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ৭ই পৌষ ১৩০৮ (২২ ডিসেম্বর ১৯০১) বৃহৎ কর্মযজ্ঞের সূচনা হল৷ জগদীশ ভট্টাচাৰ্য্য একে বিশ্বজিৎ যজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিশ্বজিৎ যজ্ঞের দক্ষিণা হল যজমানের সর্বস্ব। কবির প্রথম আহুতি তার সংসার জীবন। ঠিক এগার মাস পরে ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর প্রয়াণ হল মৃণালিনী দেবীর। এই আশ্রম বিদ্যালয়ের আশ্রমজননী ছিলেন মৃণালিনী। স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন যথাসর্বস্ব অলঙ্কার। বিক্রী করে দিতে হল পুরীর বাংলো। হস্টেলের ছাত্রদের মায়ের স্নেহ দিয়ে ভরে দিলেন মৃণালিনী। মৃণালিনীর প্রয়াণ হল জোড়াসাঁকোর লালবাড়ির দোতলায়। সাতেরো দিন কম উনিশ বছরের দাম্পত্য জীবন। সংযমপ্রবণ কবির সুসংযত সুসংহত শোক প্রকাশ পেয়েছিল স্মরণের ২৭টি কবিতার মধ্যে। সেই বছর ৭ই পৌষ এর ব্রহ্ম উৎসব মহা সমারোহে পালিত হয়। বিদ্যালয়ের কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন কবি। সেই বছর মহর্ষিভবনে যে ২৩টি গান গাওয়া হয় তার অনেকগুলিতে কবির এই শোক এবং শোক থেকে উত্তরণ প্রকাশ পায়।
স্বপন যদি ভাঙিলে রজনী প্রভাতে | আছে দুঃখ আছে মৃত্যুর | দুঃখরাতে হে নাথ | সংসার যবে মন কেড়ে লয় | অল্প লইয়া থাকি তাই | শূন্যহাতে ফিরি হে নাথ
শ্রীমতী সবুজকলি সেন
Email : sabujsathi@gmail.com
বিশিষ্ট বন্ধু সবুজকলির লেখা অসাধারণ লাগল। রবীন্দ্রনাথের ওপর এত তথ্য জানা মানুষ কম আছেন। ভবিষ্যতে আশা রাখব, লেখিকা’র আরো অনেক রচনায়, কবির জীবনের নানা দিক সম্বন্ধে সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাব 🙏🙏🙏
সমৃদ্ধ হলাম।কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত জানতে চাই ।
শনিবারের ব্লগের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করি এই ব্লগটি আপনার প্রত্যাশা কিছুটা পুরণ করতে পারবে। ডা. সরকার।
সংক্ষেপে খুব সুন্দরভাবে মৃণালিনী দেবীকে তুলে ধরেছেন মাননীয়া সবুজকলি সেন। লেখাটি সংক্ষিপ্ত হলেও মৃণালিনী দেবীর সমস্ত দিকটিই ধরা হয়েছে। কৌতূহলী পাঠক এখান থেকেই তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হবেন। লেখিকার মুন্সীয়ানা এখানেই। ধন্যবাদ।
সবুজকলি সেনের লেখাটি পড়বার জন্য ধন্যবাদ। আমিও বিশ্বাস করি মৃণালিনী দেবীকে তিনি সার্থকভাবে উপস্থাপন করেছেন। লেখিকার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
sotyi i…ato sangkhhepe aneker koutuhol metano lekhatir jonyo shrodhheya srimati sabujkoli sen mohashayake amar pronam janai. onar namtir jonyo anekdin dhorei akta valo laga achhe amar. Sabujkoli…..eirakom nam bodhhoy dwitiyo karo achhe kina sandeho. onar lekhar modhyo diye kobipotnir proti ak mamotwobodh jagroto hoyechhe pathoker mone…eta amar biswas. aro anek sundor , tothyosamridhho lekha pabonischoi agamidine…dhonyobad.
Shrimati Sabujkoli Sen ke dhanyabaad ,amon manogno ekti lekha upohar debar janya.swalpo parisare Mrinalini devir choritrer nirjasti tini jathartho bhabe prokash korechhen.kabir jibanbyapi aganito loker chahidapuran,sansarik o prothisthaner gurudayitwa bahan nribhitocharini kobipatni anektai halka kore diechhilen.tai bodhhay ‘bhai chhuti’ sambodhan.kobir kritagnata r sohag er sakshar ei namti.asha kori abar apner lekha amader riddho korbe.shraddhaa o shubhechha.