ভরসামঙ্গল No ratings yet.

ভরসামঙ্গল

শ্রাবণ মাসের ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষামঙ্গল উৎসব, শান্তিনিকেতনে। সেবার কবির শরীর বেশ খারাপ। কিন্তু প্রিয় বর্ষা ঋতুর আগমনে কবির চাতক-হৃদয় বিমুখ থাকতে পারে না, জেগে ওঠে গানের সুর। আর বর্ষামঙ্গল উৎসবের সার্থকতা তো তাঁর গানের নিবেদনেই। তাই অসুস্থতার মধ্যেও রচনা করে ফেললেন চারটি গান। শুরু হয়ে গেল বর্ষামঙ্গলের রিহার্সাল। উদয়নের পশ্চিম বারান্দা প্রতিদিন সন্ধ্যায় জমে উঠত উৎসবের কুশীলবদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে।

রিহার্সালের পাশের একটা ঘরে কয়েকজনের তাসের আড্ডা বসত। এঁরা না পারতেন গান গাইতে না পারতেন নাচ। এই সুরহীন লোকেদের রবীন্দ্রনাথ বলতেন ‘অ-সুরের দল’। এই দলে ছিলেন আশ্রমের কিছু অধ্যাপক আর কর্মী।  সেই ১৩২৮ সালে বর্ষামঙ্গল উৎসবের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলার চারুকলার ইতিহাসে নূতন দিগন্তের সূচনা করবার পরে কোনোদিনই তারা এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারন নি। পাশের ঘরের আনন্দ কোলাহল শুনতে শুনতে একদিন প্রতিজ্ঞা করে বসলেন যে তারাও নাচগানের একটা অনুষ্ঠান করবেন। সকলকে দেখিয়ে দেবেন যে তাঁরাও হেলাফেলার নন। সকলে মিটিং এ বসলেন। দলের নাম ঠিক হল হৈ হৈ সংঘ। বর্ষামঙ্গলের অনুকরণে জলসার নামকরণ হল ভরসামঙ্গল।  নিজেদেরই লেখা কিছু গান আর নাটকের খসড়া নিয়ে জোরকদমে শুরু হল ভরসামঙ্গলের রিহার্সাল। সে এক মজার ব্যাপার। রোজ সন্ধ্যায় কোনার্কের সামনে চালে রিহার্সাল, আর তা দেখে সামনে জড়ো হওয়া ছাত্রছাত্রীরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। কথাটা রবীন্দ্রনাথের কানে গেলে তিনি যুবকদের এই চপলতাকে সানন্দে অনুমোদন করলেন, এমনকি তাদের উৎসাহ দেবার জন্য লিখে দিলেন গোটাচারেক হাসির গান।

আমরা না গান গাওয়ার দল | ও ভাই কানাই কারে জানাই | পায়ে পড়ি শোনো ভাই গাইয়ে | কাঁটাবনবিহারিণী সবকটি গান ১৩৪২ ভাদ্রের ৪ থেকে ৬ তারিখের ভিতরে লেখা।

ও ভাই কানাই কারে জানাই
পায়ে পড়ি শোনো ভাই গাইয়ে
কাঁটাবনবিহারিনী

রবীন্দ্রনাথের গান আর আশীর্বাদ হৈ হৈ সংঘের সদস্যদের উৎসাহ আর রিহার্সালের ধূম বেড়ে গেল শতগুণ।

ইতিমধ্যে বর্ধমানের দামোদরে ভীষণ বন্যা দেখা দিলে অনাহারক্লিষ্ট হাজার হজার গৃহহীন মানুষের দুর্দশার সীমা রইল না। মানুষদের দুঃখে কাতর রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ঠিক হল ভরসামঙ্গল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বন্যাপীড়িতদের সাহায্য করা হবে। নিছক বিনোদন ছাড়াও ভরসামঙ্গল মানুষের সেবার কাজে লাগবে জেনে পেয়ে হৈ চৈ সংঘের সদস্যদের আনন্দের সীমা রইল না।

৭ ভাদ্র সন্ধ্যায়  ভরসামঙ্গল জলসা অনুষ্ঠিত হবে সিংহসদনে। রানি চন্দ সেই স্মৃতি ধরে রেখেছেন তাঁর লেখায়, ‘ ভরসামঙ্গলের আগের দিন বিকেলে গরুর গাড়ি করে ছাপানো বিজ্ঞাপন বিলি করল হৈ হৈ সংঘের দল সারা আশ্রম ঘুরে। ঢোল করতাল হারমোনিয়াম বাঁশি শিঙা শঙ্খ কিছুই বাদ ছিল না সেদিন সেই গোরুর গাড়ির উপরে। পরদিন শান্তিনিকেতনের শ্রীনিকেতনের যে যেখানে ছিল সবাই এসে জড়ো হল সন্ধে হতে-না-হতেই সিংহসদনে’।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সংঘের সদস্যরা অবাক হয়ে দেখলেন, যা তারা ভাবতেও পারেন নি, মঞ্চের সামনের আসনে এসে বসেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ, সচ্চিদানন্দ রায়, অনিল চন্দ প্রমুখেরা। জলসা শুরু হল। সে এক লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। যে যার খুশিমত স্টেজে ঢুকছে বেরোচ্ছে। রানী চন্দ এর অসাধারণ বর্ণনা করেছেন ‘গাংগুলীমশায় (প্রমোদলাল গাংগুলী) ডুগডুগি বাজিয়ে গান ধরলেন। গৌরদা (গৌরগোপাল ঘোষ) ভীমের বেশে গদা ঘোরাতে ঘোরাতে স্টেজে চক্কর দিয়ে গেলেন। সরোজদারা (সরোজরঞ্জন চৌধুরী) নাচলেন বাল্মীকিপ্রতিভার নাচ। তাঁদের পায়ের দাপটে স্টেজ ভাঙে আর-কি। ক্ষিতীশ (ক্ষিতীশ রায়), ডাক্তারবাবু (শচীন্দ্র মুখোপাধ্যায়), সন্তোষবাবু (সন্তোষকুমার ভঞ্জ)  শাপমোচনের নকল করে নেচে নেচে গাইলেন ও ভাই কানাই কারে জানাই দুঃসহ মোর দুখ। নন্দদা (নন্দলাল বসু) সাদা সালোয়ার পাঞ্জাবি চিকনের টুপি মাথায় দিয়ে কালো চাপদাড়ি লাগিয়ে খালিফার সাজে সেলাম করতে করতে স্টেজ ভরে তুললেন। নন্দদা যেতে-না-যেতেই গোঁসাইজি (নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী) দুই হাতে দুই জোড়া কাঠের বাজনা বাজারে বাজাতে এমাথা ওমাথা বিদ্যুৎগতিতে নেচে দিয়ে গেলেন’।

পাঠক, বুঝতে পারছেন কী অসাধারণভাবে জমে উঠেছিল হল হৈ হৈ সংঘের ভরসামঙ্গল জলসা। রবীন্দ্রনাথসহ  দর্শকেরা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন যুবকদের চপলতায় সৃষ্টি একট ব্যতিক্রমী আনন্দসন্ধ্যা। তবে অনুষ্ঠান শেষে রবীন্দ্রনাথকে একটি একশ টাকার চেক দান করতে হয়েছিল হৈ হৈ সংঘকে।

Please rate this

Join the Conversation

3 Comments

  1. এই তথ্যগুলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়ে আপনি কাজের মত কাজ করছেন।তারা বই পড়ার থেকে নেট বা মোবাইলেই বেশি অভ্যস্ত।তারা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে।আমাদেরও ভালো লাগছে।

  2. খুবই সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সেকালের এই ঘটনা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *