মৃত্যুর করাল ছায়া কবির সুদীর্ঘ জীবনে বারবার আঘাত হেনেছে। শোক যেন তাঁর নিত্য সহচর। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম শোকের ছবি এঁকেছিল, তারপর অসংখ্য পারিবারিক মৃত্যু ঢেউয়ের মত তাঁর জীবনে আছড়ে পড়েছে। প্রথম যৌবনে মৃত্যুর আঘাতগুলিতে তিনি উদ্ভ্রান্ত, অস্থির হয়ে উঠতেন, তাঁর জীবন হয়ে যেত এলোমেলো দিশাহীন। জীবনকে আটকে রাখা যাবে না, এই পরম সত্য উপলব্ধির পর তিনি মৃত্যুকে শান্ত চিত্তে গ্রহণ করতে শিখেছিলেন। তাই জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড়ো মনোহর’। এই নির্লিপ্ততার কারণেই রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছেন। শোকের বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও প্রতিটি মৃত্যু্তে রবীন্দ্রনাথের মনে গভীর প্রভাব পড়ত। মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে ভেবেছেন এবং সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে তা প্রকাশও করেছেন। শোকের আঘাত কবির সৃষ্টিকে দিয়েছে নতুন মহিমা, শিখিয়েছে মৃত্যুঞ্জয় হওয়ার মন্ত্র। তাই তো তিনি বলেছেন ‘দুখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে, যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় করিয়া ধরিব হে’। রবীন্দ্রনাথে ছিলেন দীর্ঘ জীবনের অধিকারী। অনিবার্যভাবে পারিবারিক মৃত্যু-আঘাত তাঁকেই সবচেয়ে বেশী সহ্য করতে হয়েছিল। তারমধ্যে কয়েকটির কথা এখানে লিপিবদ্ধ কার রইল।
বুধেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮১ – ১৮৬৩)
রবীন্দ্রনাথকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণিষ্ঠ পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্মের (১৮৬১) দু’বছর পরে (১৮৬৩) দেবেন্দ্রনাথের আর একটি পুত্র সন্তান জন্মেছিল। তার নাম বুধেন্দ্রনাথ ঠাকুর। লণ্ডন থেকে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্নী জ্ঞানদানন্দিনীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘রবির পরে আমার আর এক ভ্রাতা হইয়াছে শুনিলাম, তাহার নাম কি হইয়াছে’? কিন্তু জন্মের এক বছর পরেই তাঁর মৃত্যুর হয়। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। স্বাভাবিক ভাবেই সেই মৃত্যু-শোকের কোনো ছায়া রবীন্দ্রনাথের শিশুমনে রেখাপাত করেনি।
সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬ – ১০ মার্চ ১৮৭৫)
বুধেন্দ্রনাথের কোনো স্মৃতি না থাকলেও মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম মৃত্যু-শোক। ১৮৭৫ সালের ১০ মার্চ মাসে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে, সম্ভবত ‘হাতের দূষিত ঘা-জনিত ইনফেকশনে’ তাঁর মৃত্যু হয়। হয়ত অস্ত্রোপচারেরও প্রয়োজন হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন ১৪ বছরের বালক। ধীরে ধীরে প্রবেশ করছেন বাংলার সাহিত্য-আঙ্গিনায়। ইতিমধ্যে লিখে ফেলেছেন বেশ কিছু গান-কবিতা-প্রবন্ধ। একটু একটু করে বিকশিত হচ্ছে তাঁর কবিমনের অনুভূতিগুলি। শৈশবের দিনগুলি মধুর স্মৃতিতে ভরিয়ে রেখেছেন নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী। সেই আনন্দিত মুহূর্তে মায়ের মৃত্যু-অভিঘাত তাঁর কিশোর মনে যে আলোড়ন তুলেছিল সেটা তিনি প্রকাশ করেছেন জীবনস্মৃতিতে, ‘অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয় তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে’। তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন – পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল । স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল, কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না। সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর।… কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্নার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না’।
আগমনী পত্রিকায় (১৩২৬) প্রকাশিত গোটা ছয়েক ছোটো ছোটো কবিতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের রচনায় মায়ের উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। এর প্রধান কারণ মায়ের সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনে যোগাযোগের অভাব। কবির শৈশব কেটেছিল ভৃত্যদের অধীনে, মায়ের স্নেহ মমতা কোনোদিনই তেমনভাবে পান নি। উপরন্তু দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে বহুদিন মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। এই সময়ে মাতৃহীন বালকটিকে স্নেহ মমতা দিয়ে আগলিয়ে রেখেছিলেন ‘বাড়ির কনিষ্ঠা বধূ কাদম্বরী’।
সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩)
সারদা দেবীর মৃত্যুর আট বছর পরে আবার অঘটন। সেদিন ১৮৮৩ সালে ৯ ডিসেম্বর। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের দিন। সাদামাটা বিয়ের অনুষ্ঠানটা ছিল একান্তই অনাড়ম্বর। বাসরঘরের রাতজাগার ক্লান্তি কাটতে না কাটতেই টেলিগ্রাম মারফৎ আসা এক দুঃসংবাদে বিয়েবাড়ির সমস্ত আনন্দ এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের দিদি সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যু হয়েছে শিলাইদহে। জমিদারির কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি রবির বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সৌদামনী দেবী কারোয়ার থেকে জোড়াসাঁকোয় ফিরে আসেন। তবে ভগ্নীপতি সারদাপ্রসাদের মৃত্যু-শোক কবির জীবনের বিশেষ প্রভাব ফেলেনি, সেই দুঃখ ছিল নিতান্তই সাময়িক। কারণ সারদাপ্রসাদের মৃত্যুর তিন মাস পরেই হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে (মার্চ ১৮৮৪) উপলক্ষে আয়োজিত বিবাহ উৎসব নাটকের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রস্তুতি আর ২৮টি গান রচনার ব্যস্ততায় শোকের তাপ ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
কাদম্বরী দেবী (৫ জুলাই ১৮৫৯ – ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪)
রবীন্দ্রনাথের জীবনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, নতুন বউঠান, কাদম্বরী দেবীর প্রভাব ও অবদান সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলবার অবকাশ নেই। তিনি ছিলেন কবির ‘জীবনের ধ্রুবতারা’। কাদম্বরীর আকস্মিক আত্মহত্যা রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ উদ্ভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। দিনটা ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪, রবীন্দ্রনাথের বিয়ের মাত্র চার মাস পরের ঘটনা। বাড়ির এক কর্মচারিকে দিয়ে সংগ্রহ করা আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করলেন দেবেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ । ঝড় বয়ে গেল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উপর দিয়ে। কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন ? মনে করা হয় স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অবহেলা, তাঁর অন্য-মহিলাপ্রীতি, একাকীত্ব, পরিবারের অন্য মহিলাদের কুৎসা ইত্যাদি মানসিক জটিলতাই তাঁকে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। সামাজিক দুর্নামের ভয়ে মহর্ষি সেদিন তাঁর প্রভাব খাটিয়ে পুত্রবধূর পোষ্টমর্টেম অন্যান্য পুলিশি ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন । শুধু তাইই নয় কাদম্বরীর চিঠিপত্র সমেত যাবতীয় নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলে তাঁর স্মৃতি ঠাকুরবাড়ি থেকে চিরতরে মুছে ফেলের চেষ্টা করা হল।
কাদম্বরীর মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের মনোজগতের যে আলোড়ন তুলেছিল তার ব্যাপ্তি সীমাহীন। সবচেয়ে প্রিয়জনের চিরবিচ্ছেদ তিনি মেনে নিতে পারেন নি। প্রায় সারাজীবন বিভিন্ন ভাবে এই শোককে তিনি স্মরণ করেছেন গানে, কবিতা্ লেখায়, নানাজনের সঙ্গে কথোপকথনে। মায়ের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের বালক মনে তেমন ছায়াপাত করেনি। কিন্তু কাদম্বরীর যন্ত্রণাকাতর মৃত্যু হয়েছিল তাঁর চোখের সামনে। সেই মৃত্যু-অভিঘাতের তীব্রতা তাঁর অন্তরাত্মাকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। …কিন্তু আমার চব্বিশবছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে-পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ শোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশুবয়সের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায় কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল’।
কাদম্বরীর মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথের বিনিদ্র রাত কেটেছে দিনের পর দিন, গভীররাত পর্যন্ত তেতলার ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে নির্ণিমেশে তাকিয়ে থেকেছেন, এক অলীক আশা নিয়ে – যদি বউঠান একবার এসে দেখা দেন। সে সময়ে তাঁর বেশবাস খাওয়াদাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা ছিলনা। এক কঠিন কৃচ্ছসাধনায় নিজেকে দগ্ধ করেছেন প্রতিদিন। কাদম্বরীর মৃত্যুর পরে তাঁকে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য গান, কবিতা, স্মৃতিকথা লিখেছেন। সবচেয়ে বেশি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন নতুন বউঠানকেই। চব্বিশ বছর বয়স থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বহন করে গিয়েছেন সেই শোক-বেদনা।
এর পরে আগামী শনিবার