য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমি স্বভাবতই ‘লেডি’ জাতিকে বড়ো ডরাই। তাঁদের কাছে ঘেষতে গেলে এত প্রকার বিপদের সম্ভাবনা যে, চাণক্য পণ্ডিত থাকলে লেডিদের কাছ থেকে দশ সহস্র হস্ত দূরে থাকতে পরামর্শ দিতেন। এক তো মনোরাজ্যে নানা- প্রকার শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা—তা ছাড়া সর্বদাই ভয় হয় পাছে কী কথা বলতে কী কথা বলে ফেলি, আর আমাদের অসহিষ্ণু, লেডি তাঁদের আদবকায়দার তিলমাত্র ব্যতিক্রম সইতে না পেরে দারুণ ঘৃণায় ও লজ্জায় একেবারে অভিভূত হন।’
প্রথম বিদেশ যাত্রা (২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ – ১৯ মার্চ ১৮৮০) : ১৮৭৮ সালে প্রথম বিদেশ যাত্রার সময় জাহাজে সী-সিকনেসের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পরে প্রথমদিন কেবিন থেকে বাইরে এসে রবীন্দ্রনাথ মহিলা সহযাত্রিণীদের থেকে দূরে দূরে থাকতেন। কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণের ১৭ বছরের রবির মনে ছিল কিছুটা জড়তা আর দ্বিধা। কিন্তু সৌন্দর্যের পূজারি চোখ অনিবার্যভাবেই সুন্দরের দিকে আকৃষ্ট হয়। চার-পাঁচ দিন পরে ইটালি পৌঁছে দেখলেন, ‘ইটালির মেয়েদের বড়ো সুন্দর দেখতে। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রঙ, কালো কালো চুল, কালো ভুরু, কালো চোখ, আর মুখের গড়ন চমৎকার।’
ব্রাইটন (অক্টোবর ১৭৭৮-জানুয়ারি ১৮৭৯) : যাত্রাপথে এডেন, সুয়েজ, ইতালি, প্যারিস অতিক্রম করে ১০ অক্টোবর লণ্ডনে পৌঁছিয়ে, সেখানে ঘণ্টা দু-এক থেকেই রবীন্দ্রনাথ ব্রাইটন শহরে জ্ঞনদানন্দিনীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রাইটনে কিছু ইংরাজ পরিবারের সঙ্গে আলাপ হওয়ার সুযোগে সেখানকার ‘মেয়েদের পিয়ানো বাজিয়ে গান গাওয়া, ফায়ারপ্লেসের ধারে আগুন পোহানো, দর্শনার্থীদের সঙ্গে অসংকোচে কথা বলে, এমন কি কম বয়সী যুবকদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে’ দেখে প্রথমে কিছুটা বিস্ময়াবিষ্ট হলেও ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথের মন্দ লাগেনি। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-হীন মেয়েদের সঙ্গে তুলনা করে তাদের জন্য করুণাই হয়েছিল। সেখানে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের কন্যা বলেন্দ্রবালার কথায় রবীন্দ্রনাথ জেনেছিলেন যে তাঁর বিদেশিনী সখীরা রবীন্দ্রনাথের চেহারার প্রশংসায় নাকি পঞ্চমুখ। দিলীপকুমার রায়কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আরে ছাই, আমার কাছেই বল, তাও না ! কি জানি হয়ত আমার লজ্জা দেখেই লজ্জাশীলারা লজ্জা পেতেন ; কে বলতে পারে ? এতই লাজুক ও মুখচোরা ছিলাম সেসময়ে যে তরুণীমহলে এরকম প্রতিষ্ঠার কানাঘুষা শুনেও ওদিকে ভিড়তে সাহস পাই নি।’ সেখানে কোনো এক ডাক্তারের বাড়ির সান্ধ্যনিমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ দুই রূপসীশ্রেষ্ঠের দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা ‘দুজনেই কেমন চুপচাপ, গম্ভীর। সেই আসরে গৃহকর্ত্রীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ একটি গান গেয়েছিলেন। কিন্তু সেই গান শুনে সভাস্থ সুন্দরী মহিলাদের তাচ্ছিল্লের হাসি আর বিদ্রুপে রবীন্দ্রনাথের ‘মুখ কান লাল হয়ে উঠেছিল’।
লণ্ডন (জানুয়ারি ১৮৭৯-জুন ১৮৭৯): রবীন্দ্রনাথকে লণ্ডনে পাঠানো হয়েছিল ব্যারিস্টারি পড়তে। তারকনাথ পালিতের তত্ত্বাবধানে ‘লণ্ডনের ভাড়াবাড়ি – মিঃ বার্কারের পরিবার – টনব্রিজ ওয়েলস – ডেভেনশিয়রের টর্কি’ প্রভৃতি অঞ্চলে কিছুদিন থাকবার পর জুন মাসে ইংলণ্ডে এসে রবীন্দ্রনাথ মিঃ স্কটের পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মিসেস স্কট রবীন্দ্রনাথকে নিজের ছেলের মতই স্নেহ করতেন। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর দুই সুন্দরী মেয়ে লুসি এবং তার বোনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ পরে লিখেছেন, ‘তাঁহার মেয়েরা আমাকে যেরূপ মনের সঙ্গে যত্ন করিত তাহা আত্মীয়দের কাছ হইতেও পাওয়া দুর্লভ। তাঁরা আমাকে ভুলিয়ে দিলেন যে বিদেশে এসেছি। আমার জন্য সকল সময়েই মায়ের মত ভাবনা ছিল তাঁর (মিসেস স্কট) মনে’। মিসেস স্কটের পতিভক্তি দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন, ‘আমরা বলিয়া থাকি এবং আমিও তাহা বিশ্বাস করতাম যে, আমাদের দেশে পতিভক্তির একটি বিশিষ্টতা আছে, য়ুরোপে তাহা নাই। কিন্তু আমাদের দেশের সাধ্বীগৃহিণীর সঙ্গে মিসেস স্কটের আমি তো বিশেষ পার্থক্য দেখি নাই। স্বামীর সেবায় তাঁহার সমস্ত মন ব্যাপৃত ছিল। স্বামীর প্রত্যেক ছোটোখাটো কাজটিও মিসেস স্কট নিজের হাতে করিতেন’। লণ্ডনে স্কট পরিবারের আতিথ্যে থাকবার সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্কট কন্যাদের যে অন্তরঙ্গতার সূত্রপাত হইয়েছিল, পরবর্তী জীবনে সে কথা স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বিলেত প্রথমে যে ডাক্তার পরিবারে অতিথি হয়ে ছিলাম তার দুটি মেয়েই যে আমাকে ভালবাসত একথা আজ আমার কাছে একটুও ঝাপসা নেই। – কিন্তু তখন যদি ছাই সেকথা বিশ্বাস করার এতটুকুও মরাল কারেজ থাকত।’
লণ্ডনে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ একবার একটা ইভনিং পার্টি বা বলডান্স-আসরে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেই পার্টির আদবকায়দা, বিশাল সুসজ্জিত হলঘরে গ্যাসের আলোয় শত শত সুন্দরী রূপসীর রূপের ঔজ্জ্বল্যে রবীন্দ্রনাথের চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। তিনিও একটি সুন্দরী মহিলার সঙ্গে নাচে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যদিও হইহুল্লোড় আর অবিশ্রান্ত নাচের দাপটে ক্লান্ত হয়ে একটু পরেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে লিখেছেন, ‘আমার নাচের সহচরী বোধহয় নাচবার সময় মনে মনে আমার মরণ কামনা করেছিলেন। নাচ ফুরিয়ে গেল, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, তিনিও নিস্তার পেলেন।’ অবশ্য এটাও অকপটে জানিয়েছেন ‘যাদের সঙ্গে বিশেষ আলাপ আছে তাদের সঙ্গে নাচতে মন্দ লাগে না’। রবীন্দ্রনাথ নিজেও খুব ভালো নাচতে পারতেন। সেই পার্টিতেই এক ‘ভারতবর্ষীয়া শ্যামাঙ্গিনী’কে দেখে কবির মন উতলা হয়ে তার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সেটা অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল, কারণ ‘পরিচিত বাঁধিগতের সীমা লঙ্ঘন করতে সাহস হয় নি।’
এরপরে ১৮৭৯ সালের ১৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ লণ্ডন য়ুনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ‘কত পাঠরত প্রতিবেশিনী ছাত্রীর নীল চক্ষুর নীরব ভর্ৎসনা-কটাক্ষ উপেক্ষা’ করে স্কুল-বিমুখ রবীন্দ্রনাথের সেখানে পড়াশুনোয় মনও বসেছিল। কিন্তু স্কট কন্যাদের সঙ্গে মেলামেশার খবর দেবেন্দ্রনাথের কানে পৌঁছালে, তিনি রবীন্দ্রনাথকে অবিলম্বে দেশে ফিরে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৮৮০ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে S S Oxus জাহাজে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসেন।
দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ (২২ আগস্ট -২ নভেম্বর ১৮৯০)
শ্যাম জাহাজ : প্রথম বিদেশ ভ্রমণে মহিলাদের সঙ্গে মেশবার দ্বিধা আর জড়তা কাটিয়ে এক উচ্ছ্বল সপ্রতিভ রবীন্দ্রনাথের দেখা পাওয়া গেল তাঁর দ্বিতীয়বার ইংল্যন্ড যাত্রায়। ১৮৯০ সালের ২২ আগস্ট বোম্বাই বন্দর থেকে রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ আর লোকেন্দ্রনাথ (পালিত) শ্যাম জাহাজে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আবার সেই সী-সিকনেস। ডেকে স্থির হয়ে থাকতে না পেরে, অন্ধকারের মধ্যে নিজের কেবিন খুঁজে না পেয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন। অবশেষে একটা আলোকোজ্জ্বল কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে দেখেন, ‘আলো জ্বলছে; কিন্তু মেজের উপর পরিত্যক্ত গাউন পেটিকোট প্রভৃতি স্ত্রীলোকের গাত্রাবরণ বিক্ষিপ্ত। আর অধিক কিছু দৃষ্টিপথে পড়বার পূর্বেই পলায়ন করলুম।’ হতাশ হয়ে আবার ফিরে গিয়েছেন উপরের ডেকে। নিজের কম্বলটি পেতে যখন বসতে গেলেন – দেখলেন সেটি তাঁর নয়, অন্য কারও। অগত্যা ডেকের একটা বেঞ্চে ‘তীব্র তাম্র-কূটবাসিত পরের কম্বলের উপর কাষ্ঠাসনে রাত্রি যাপন’ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সকালে একটু সুস্থ হলেও ডেকে ভ্রমণরত পুরুষ বা মহিলাদের দিকে মনোযোগ দেবার মত মানসিক চেতনা ছিল না। কিন্তু সেই রাত্রে জ্যোৎস্নালোকিত ডেকে রবীন্দ্রনাথ প্রিয়বন্ধু লোকেন্দ্রনাথের সঙ্গে যে রহস্যালাপ করেছিলেন – তিনি দিনলিপিতে তার বর্ণনা দিয়েছেন, ‘আমরা দুই যুবক গতকল্য রাত্রি দুটো পর্যন্ত কেবল ষড়চক্র-ভেদ চিত্তবৃত্তি-নিরোধ ত্রিগুণাত্মিকা-শক্তি সম্বন্ধে আলোচনা না করে সৌন্দর্য প্রেম এবং নারীজাতির পরম কমনীয়তা সম্বন্ধে পরস্পরের মতামত ব্যক্ত করছিলুম’।
ম্যাসীলিয়া জাহাজ : ২৯ আগস্ট রাত্রে জাহাজ বদল করতে হল । এবার জাহাজের নাম ম্যাসীলিয়া, যাত্রাপথ লোহিত সাগর। কবির ভাষায় ম্যাসীলিয়া জাহাজটা একটা কুঁড়েমির কেল্লা। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের উপর দিয়ে নীল জল কেটে অখণ্ড অবসরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে। ‘সমুদ্র এবং আকাশের অসীম স্তব্ধতার মধ্যের আশ্চর্য বর্ণের উদ্ভাসময় সন্ধ্যাটি’ কবির চোখের সামনে এক মনোহর মূর্তিতে ধরা দিয়েছিল।
সন্ধ্যায় তিন বাঙালি-যাত্রী ডিনার রুমে এসে টেবিল দখল করে বসলেন। পাশের টেবিলে বসেছিলেন দুই সুন্দরী যুবতী। রবীন্দ্রনাথ চেয়ে দেখলেন, ‘তাঁদের মধ্যে একটি যুবতী আপনার যৌবনশ্রী বহুলপরিমাণে উদঘাটিত করে দিয়ে সহাস্যমুখে আহার এবং আলাপে নিযুক্ত। তাঁর শুভ্র সুগোল চিক্কণ গ্রীবাবক্ষবাহুর উপর সমস্ত বিদ্যৎ-প্রদীপের অনিমেষ আলো এবং পুরুষমণ্ডলীর বিস্মিত সকৌতুক দৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছিল। একটা অনাবৃত আলোকশিখা দেখে দৃষ্টিগুলো যেন কালো পতঙ্গের মতো চারি দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লম্ফ দিয়ে পড়ছে।’ রবীন্দ্রনাথ তাদের সাজসজ্জা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘নৃত্যশালায় এরকম কিংবা এর চেয়ে অনাবৃত বেশে গেলে কারও বিস্ময় উদ্রেক করে না।’ তাঁর মতে পরিস্থিতি অনুযায়ী রুচিশিল পোষাক পরাই বাঞ্ছনীয়। পরদিন রবিবার সকালে জাহাজের ডেকে খৃষ্টানদের উপাসনায় যখন গম্ভীর বিনম্র প্রার্থনা হচ্ছিল কবি দেখলেন ‘গতরাত্রের ডিনার টেবিলের সেই নায়িকাটি উপাসনায় যোগ না দিয়ে তাঁরই একটি উপাসক যুবকের সঙ্গে কৌতুকালাপে নিমগ্ন। সে কখনো অট্টহাস্য, মাঝে মাঝে উচ্চহাস্য আবার কখনো গুন গুন স্বরে প্রার্থনা সংগীত গাইছেন।’ প্রণয় প্রার্থীদের স্তুতিবাক্য ও তাদের প্রতি সুন্দরী রমণীর করুণাভরা কৃপা রবীন্দ্রনাথ সকৌতুকে উপভোগ করেছিলেন।
পয়লা সেপ্টেম্বর রাত্রে লোহিত সমুদ্র যখন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছিল, জ্যোৎস্নার আলো জলের উপরে অলৌকিক মায়াময় সৌন্দর্যের আরবণ বিছিয়ে দিয়েছিল তখন জাহাজের ‘য়ুরোপীয় যাত্রী-যাত্রিনীরা পরস্পরকে জড়াজড়ি করে ধরে পাগলের মতো তীব্র আমোদে ঘুরপাক খাচ্ছে,হাঁপাচ্ছে, উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।’ প্রকৃতি যখন তার অকৃপণ সৌন্দর্যের নিশব্দ শান্তিতে ভরিয়ে তুলেছে তখন মানুষের এই স্থূল জাগতিক হুল্লোড় কবিকে অবাক করেছিল।
রেলগাড়ি : ৭ সেপ্টেম্বর বৃন্দিসি বন্দরে জাহাজ ছেড়ে মেলগাড়িতে যাত্রা। গাড়ি চলেছে সমুদ্রকে বামে রেখে, পাহাড়ের গা ঘেঁসে, চষা মাঠ, আঙুরের খেত, জলপাই বাগানের ভিতর দিয়ে। সন্ধ্যার সময়, ট্রেনের জানলার পাশে বসে এক থোলা আঙুর হাতে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছেন। মাথায় রঙিন রুমাল বেঁধে, একজন ইতালীয় মহিলাকে দেখে কবির মনে হল, ‘ইতালীয়ানীরা এখানকার আঙুরের গুচ্ছের মতো, অমনি একটি বৃন্তভরা অজস্র সুডোল সৌন্দর্য, যৌবনরসে অমনি উৎপর্ণ—এবং ঐ আঙুরেরই মতো তাদের মুখের রঙ।’
লণ্ডন : ১০ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ লণ্ডনে পৌঁছে Miss Mull নামক একজন ইংরাজ মহিলার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। ইনিও একজন রবি-অনুরাগিণী, কিন্তু ‘এই সম্পর্কে সম্ভবত flirtation এর ঊর্ধে ওঠেনি’। এই মহিলার কথা রবীন্দ্রনাথ আগেই শুনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দেবদূর্লভ সৌন্দর্য, আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আর গানের মোহে Miss Mull ধীরে ধীরে কবির অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলায় বসত গানের আসর। রবীন্দ্রনাথের গলায় ‘আলি বার বার ফিরে যায়’ গানটি তাঁকে এতই মোহিত করেছিল যে বারবার শুনেও Miss Mull এর যেন তৃপ্তি হত না। লণ্ডনের যে-ক’দিন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ নানা জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। প্রথমবার লণ্ডনের স্কট পরিবারের কথা, স্কট কন্যাদের কথা তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠেছিল- কিন্তু সেই বাড়িতে গিয়ে শুনলেন তাঁরা সেখানে আর থাকেন না। এছাড়া গিয়েছেন ন্যাশানাল গ্যালারিতে ছবি দেখতে, স্যাভয় থিয়েটারে গীতিনাট্য (গন্ডোলিয়র্স) দেখতে। গিয়েছিলেন Miss Oswald-এর বাড়িতে। এইসব জায়গা থেকে ফিরে আসলেই Miss Mull অনুযোগ করে বলতেন ‘কেন তুমি সারাদিন বাইরে কাটালে। ঘরে থাকলে আমরা বেশ গানবাজনা নিয়ে থাকতে পারতুম’।
২৭ সেপ্টেম্বর গিয়েছিলেন লাইসীয়ম রঙ্গমঞ্চে ‘ব্রাইড অফ লামারমূর’ অভিনয় দেখতে । কিন্তু সেখানে তাঁর মনোযোগ বিঘ্নিত বার বার হয়েছিল কারণ, ‘আমাদের সম্মুখবর্তী একটি বক্সে দুটি মেয়ে বসে ছিল। তার মধ্যে একটি মেয়ের মুখে রঙ্গভূমির সমস্ত দর্শকের চিত্ত এবং দুরবীন আকৃষ্ট করেছিল। নিখুত সুন্দর ছোটো মুখখানি, অল্প বয়স, দীর্ঘ বেণী পিঠে ঝুলছে, বেশভূষার আড়ম্বর নেই। অভিনয়ের সময় যখন সমস্ত আলো নিবিয়ে দিয়ে কেবল স্টেজের আলো জ্বলছিল এবং সেই আলো স্টেজের অনতিদূরবর্তী তার আধখানি মুখের উপর এসে পড়েছিল—তখন তার আলোকিত সুকুমার মুখের রেখা এবং সভঙ্গিম গ্রীবা অন্ধকারের উপর চমৎকার চিত্র রচনা করেছিল।’ রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন তাঁর দৃষ্টি বারবার নিবদ্ধ হচ্ছিল সেই সুন্দর মুখখানির উপর। ‘কিন্তু দুরবীন কষাটা আমার আসে না। নির্লজ্জ স্পর্ধার সহিত পরস্পরের প্রতি অসংকোচে দুরবীন প্রয়োগ করা নিতান্ত রূঢ় মনে হয়।’ এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এখানে রাস্তায় বেরিয়ে সুখ আছে। সুন্দর মুখ চোখে পড়বেই। নবনীর মতো সুকোমল শুভ্র রঙের উপরে একখানি পাতলা টকটকে ঠোঁট, সুগঠিত নাসিকা এবং দীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট নির্মল নীলনেত্র—দেখে প্রবাসদঃখ দূর হয়ে যায়। এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে সুন্দর মুখে আমার সুন্দর লাগে। সুন্দর হওয়া এবং মিষ্ট করে হাসা মানবীয় যেন একটি পরমাশ্চর্য ক্ষমতা।’
আগামী সপ্তাহে – ফিরতি পথে
খুব তথ্য সমৃদ্ধ। খুব ভাল লাগল।
অনেক অজানা কাহিনী জানতে পারলাম। রবীন্দ্রনাথ রে তাঁর কৈশোর, তারুণ্যের অনুভূতি সাবলীলভাবে বর্ণনা করেছেন, সেই তথ্য পরিবেশন করার জন্য ধন্যবাদ দাদা।
খুব সুন্দর। সুবিন্যস্ত। ধন্যবাদ।