রবীন্দ্রনাথও ভয় পেয়েছিলেন No ratings yet.

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথের বালক বয়সেই তাঁর মধ্যে বিশেষ প্রতিভার লক্ষণ দেখেছিলেন। তাই ১৮৭৩ সালে তাঁর হিমালয় ভ্রমণের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন ১২ বছরের ‘বিদ্যালয়-বিমুখ আত্মমগ্ন ভাবুক’ বালক রবীন্দ্রনাথকে। জোড়াসাঁকোর বদ্ধ গণ্ডির বাইরে পিতা দেবেন্দ্রনাথের মত মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য এবং হিমালয়ের বিপুল উন্মুক্ত পরিবেশ রবীন্দ্রনাথের জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন কঠোর অনুশাসন আর নিয়মের কড়াকড়ি শিশুদের বিকাশের প্রধান অন্তরায়। তাই নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথকেও স্কুলের পরিবর্তে উপযুক্ত  শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাড়িতেই পড়াবার ব্যবস্থাই করেছেন। আর যখনই সুযোগ পেয়েছেন তাঁকে নিয়ে বেরিয়েছেন নানা জায়গায়।

১৮৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ কাজে শিলাইদহ যেতে হয়েছিল। সেই ভ্রমণে তিনি সাত বছরের রথীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ।  আর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাই বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র বলেন্দ্রনাথ (১৮৭০-১৮৯৯), যার ডাকনাম বলু। বলুর বয়স তখন ২৪ বছর। শিলাইদহে তাঁরা থাকতেন পদ্মানদীর কোলে কবির প্রিয় পদ্মাবোটে। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ পাটের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। আসলে তিনি ব্যবসার টাকা দিয়ে কিছু মানুষের দুঃখ দূর করতে চেয়েছিলেন। যদিও বাস্তবে সেটা আর হয়ে ওঠে নি।

এই ব্যস্ততার মধ্যেই তাঁর মনে নেমে এল সুরের ধারা। পদ্মার নিস্তরঙ্গ শান্ত পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে সৃষ্টি হতে লাগল একের পর এক অসাধারণ গান। কিন্তু নদী একদিন (১ অক্টোবর) উত্তাল হয়ে উঠল। অবিরাম বৃষ্টি, বাতাসের হাহাকার, বিদ্যুতের চমকানি আর ব্জ্রপাতের হুংকারে নদী ভয়ঙ্কর রূপ নিল। নদীর বুকে বজরায় থাকাকালীন প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ রবীন্দ্রনাথ আগেও বহুবার দেখেছেন। তখন তিনিও ‘এই ঝড়-বৃষ্টি-বাদলের সুবিশাল গীতিনাট্যের’ একজন প্রধান কুশীলব হয়ে যেতেন। কিন্তু আজ পরিস্থিতি আলাদা। শুধু ঝড় নয়, এ যেন নদীর বুকে সাইক্লোন। বিশাল পদ্মাবোটে কবি একা। সঙ্গে শিশু রথী আর কিশোর বলু। দুজনের দায়িত্ব একাকী রবীন্দ্রনাথের উপরে। তিনি দুজনকে বুকে করে সারারাত জেগে কাটালেন।

এমন রাতে কবিত্ব আসে না, যুদ্ধ করে যেতে হয় কেবলমাত্র টিকে থাকবার জন্য। পরে ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘দিন দুয়েক রীতিমত ঝড়ের দাপটে পড়িয়াছি। কতকটা সাইক্লোনের মত।  – রথী এবং বলু স্কন্ধে থাকাতেই সমস্যা’। বলা যেতেই পারে সেদিন রবীন্দ্রনাথ রীতিমত ভয় পেয়েছিলেন।  অবশেষে একসময়ে এই দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হল। পরদিন সকালে ঝড় থামলে আকাশ পরিষ্কার হল, প্রভাত সূর্য্যের অরুণ আলো ছড়িয়ে পড়ল শান্ত পদ্মার জলে। রবীন্দ্রনাথ গিয়ে বসলেন তাঁর লেখার টেবিলে। লিখে ফেললেন আহা জাগি পোহালো বিভাবরী’।  নিজের উৎকণ্ঠা-নিরসনের স্বস্তির প্রকাশ যেন। যদিও গানটার মধ্যে প্রকৃতির দুর্যোগের কোনো উল্লেখ নেই, রয়েছে রাত্রি-জাগরণের ক্লান্তির আভাস। ক্ষিতিমোহন সেন এই ঘটনার কথা লিখেছেন, ‘… এরকম একবার একটি শিশু তাঁর কাছে রয়েছে, রাত্রে ভয়ঙ্কর ঝড় উঠল। পদ্মানদী পাগল হয়ে সারারাত মাতামাতি করল। ভীত শিশুটিকে কবি বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে তো রাতটি কাটালেন। ভোরের দিকে ঝড় শান্ত হয়ে এল, ছেঁড়া মেঘের মাঝে মাঝে অরুণের লোহিত আভা দেখা দিল, তিনি গান রচনা করলেন : আহা জাগি পোহালো বিভাবরী, ক্লান্ত নয়ন তব সুন্দরী’।

অন্যান্য তথ্য | রচনা ১ অক্টোবর ১৮৯৫ | রচনাস্থান শিলাইদহ | কবির বয়স ৩৪ বছর | প্রেম পর্যায় | স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর | কবিকৃত ইংরাজি অনুবাদ You have watched all night alone, your eyes are tiered, sweet one ! (POEM)

Please rate this

Join the Conversation

8 Comments

  1. Dr Purnendu Bikash Sarkar r ashadharan ei blog ti holo byaktigato gnaner bhandar samriddha kara r ak chabi kathi. Jara Rabindra bhandhara te dikhhito tara ei blog ti niyomito bhabe porle wriddha haben boi ki. Kobi kon samay kale kon porishthiti te ei mrityunjoi geetikabya rachana korechilen ta janle bismrito hote hoy.

  2. বাহ্। অজানা কে জানানোর জন্য এই ব্লগ টি অনন্য

  3. গানের প্রেক্ষিতের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্র দর্শন ও ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকেও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতি শনিবার আপনার ব্লগে আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

  4. রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে বহুল চর্চার মধ্যেও এই লেখাটি ভাবের নিজস্বতায় স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে ।খুব ভালো লাগলো পড়ে ।ধন্যবাদ ।

  5. Proti shanibar ei blog ti kholar age mon koutuholi hoye otthe…abar notun kore kobike janbo.protyekbari protyasar otirikto peye dhanyo hoi.apni shato byastotar modhyeo nirantar Rabindranath ke nie kaj kore jachhen.katokhani bhalobasa thakle ei abogaho sambhab bhebe bismito hoi..
    Apni bhalo thakun.ei mumursu charipash apner lekhay ujjibito hok prarthona kori.0

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *