দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয়পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী নীপময়ীর সন্তানসংখ্যা এগারো। জ্যেষ্ঠা কন্যা প্রতিভা দেবীর জন্ম ১৮৬৫ সালের ৭ জানুয়ারি। বেথুন স্কুল এবং লরেটো হাউসে পড়াশুনা, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংগীত চর্চা, নাটক অভিনয়, পারিবারিক পত্রিকায় লেখালেখি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে বয়স একদিন চুপিচুপি একুশের কোটায় পা রেখেছে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সাধারণত খুব কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার চল ছিল। তাই প্রতিভার বয়স যখন একুশ, তখন সবার টনক নড়ল, চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে। তড়িঘড়ি শুরু হয়ে গেল পাত্রের খোঁজ। আমরা দেখেছি ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের প্রজন্ম পর্যন্ত ছেলেদের বিয়ের ক্ষেত্রে বধূ পছন্দের ব্যাপারে বিশেষ বাছবিচার ছিল না। যেমন তেমন একটি কন্যা হলেই চলে যেত। যদিও বিয়ের পরে সেই মেয়েকে শিক্ষায় দীক্ষায় গড়েপিঠে জোড়াসাঁকোর উপযুক্ত করে নেওয়া হত। মেয়েদের বেলায় উপযুক্ত পাত্র পাওয়া ছিল খুবই সমস্যার। কারণ ব্রাহ্ম পরিবারের সঙ্গে অনেকেই বিয়েতে রাজি হতেন না। হলেও ছেলেকে একঘরে করে দেওয়া হত এবং পাত্রকে জোড়াসাঁকোর ঘরজামাই হয়ে থাকতে হত।
কিন্তু প্রতিভার মত বিদুষী শিক্ষিতা মেয়ের জন্য যেকোনো একটা পাত্র হলেই তো চলবে না। চাই উপযুক্ত শিক্ষিত উদার পাত্র। খবর পাওয়া গেল ম্যাজিস্ট্রেট দূর্গাদাস চৌধুরীর বড়ছেলে আশুতোষ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ১৮৮১ সালে একই বছরে তিনি বি.এ এবং এম.এ পাশ করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে ওই বছরেই উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যাবার সময়ে একই জাহাজে সহযাত্রী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ। জাহাজেই আলাপ। আশুতোষের নম্র ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ। সেদিন থেকেই দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় বন্ধুত্ব।
১৮৮৫ সালে উচ্চশিক্ষা শেষ করে আশুতোষ দেশে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে ঠাকুর পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিভা দেবীর সঙ্গে আশুতোষের বিবাহের কথা উঠলো। আশুতোষ চৌধুরীর পরিবার তখন কৃষ্ণনগরে থাকতেন। এই বিয়ের ঘটকালির ভার পড়ল রবীন্দ্রনাথের উপরে।
এদিকে ১৮৮৬ সালের প্রথমদিকে বালক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ভারহীন মুক্তমন বন্ধুসঙ্গলাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। সুতরাং প্রিয় বন্ধু আশুতোষের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ যারপরনাই খুশি। একদিন পৌঁছে গেলেন কৃষ্ণনগরে। সত্যপ্রসাদ এবং রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায় (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ঊষাদেবীর স্বামী) পাত্রী পক্ষের হয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গ নিলেন। রমণীমোহন আবার আশুতোষের ছোটোবেলার বন্ধু। সুতরাং বলা যায় পাত্র দেখার অজুহাতে এই ঘটকালির দায়িত্ব প্রাণের বন্ধুদের মিলিত হবার এক সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছিল।
কৃষ্ণনগরে আশুতোষের ভাই প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দেখা। প্রথম সাক্ষাতেই প্রমথ রবীন্দ্রনাথের দৈহিক সৌন্দর্য ও ব্যবহারিক গুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে স্মৃতিচারণ করবার সময়ে লিখেছেন, ‘আমি এর পূর্বে রবীন্দ্রনাথের মত সুপুরুষ কখনও দেখিনি। .. তাঁর সর্বাঙ্গ ছিল প্রাণে ভরপুর, প্রাণ তাঁর দেহে ও মুখে টগবগ করিত। তিনি ছিলেন একটি জীবন্ত ছবি’। প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে পরবর্তীকালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীর বিয়ে হয়েছিল (১৮৯৯) এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় সম্পর্ক।
সমবয়সী চার বন্ধুর হাসি-ঠাট্টা আর গানে কৃষ্ণনগরের দিনগুলি আনন্দে উচ্ছল হয়ে থাকত। কিন্তু একদিন একটি ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। কৃষ্ণনগরে প্রসিদ্ধ রামতনু লাহিড়ীর ছেলে সত্য লাহিড়ীর উদ্দ্যোগে প্রায়ই উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসত। একবার উদ্দ্যোক্তারা রবীন্দ্রনাথকে ঐ আসরে আমন্ত্রণ জানালেন। যথাসময়ে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে গেলেন, সঙ্গে ছিলেন প্রমথ চৌধুরীও। সান্ধ্যকালীন চা-সহ জলযোগ, আড্ডা ও গানের সঙ্গে আসর জমে উঠল। একসময়ে সত্য লাহিড়ী রবীন্দ্রনাথকে একটি গান গাইতে অনুরোধ করলেন। যে কেউ অনুরোধ করলেই রবীন্দ্রনাথ সানন্দে তাকে গান গেয়ে শোনাতেন। সত্য লাহিড়ীর অনুরোধে তিনি গাইলেন নিজের লেখা একটি গান, বাঁশরি বাজাতে চাহি, বাঁশরি বাজিল কই।
শ্রোতাদের ভালো লাগে নি। রবীন্দ্রনাথের গান তাদের কেবল বিরক্তি ও অনীহার কারণ হয়ে উঠেছিল। তাদের কান এবং মন ছিল উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুরে বাঁধা। রবীন্দ্রনাথের গানের অন্যধরণের গায়কী ও সুর তারা উপভোগ করতে পারেন নি। উপরন্তু ছুঁড়ে দিয়েছেন তীক্ষ্ণ শ্লেষভরা নানা তির্যক মন্তব্য। যেমন ‘হ্যাঁ বাঁশরী অনেকে বাজাতে চায়, কিন্তু বাজাতে চাইলেই কি বাঁশরী বাজে’। ‘বাঁশরী বাজাতে হলে শিক্ষা চাই’ ইত্যাদি। সেদিন রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মনঃকষ্ট পেয়েছিলেন।
যাইহোক রবীন্দ্রনাথের ঘটকালি সফল হয়েছিল। প্রতিভা দেবীর রূপগুণের সুখ্যাতি জেনে আশুতোষের পিতা দূর্গাদাস চৌধুরী এই বিয়েতে সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন। যথাযতভাবে বিয়ে সম্পন্ন হল ১৮ আগস্ট ১৮৮৬ সালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। সেদিন ছিল রাখীপূর্ণিমা। আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা। দুর্ভাগ্যক্রমে, দিনাজপুরে বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকায় পাত্রের পিতা দূর্গাদাস চৌধুরী এই শুভ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। তবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘আশু আমার একটা অর্জন। অনেক সাধনায় প্রতিভা এমন পাত্রে পরিণীতা হয়েছে’।
অন্যকারণে এই বিয়ের একটি সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। ঠাকুর পরিবার মূলত রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। অন্যদিকে চৌধুরীরা বারেন্দ্র শ্রেণীভুক্ত। রাজা বল্লাল সেনের আমল থেকে এই দুই শ্রেণীর মধ্যে বিবাদ লেগেই ছিল আর বিয়ে এবং অন্যান্য সমস্ত সামাজিক কাজকর্ম ছিল নিষিদ্ধ। সেজন্য প্রতিভা দেবী এবং আশুতোষের বিয়েটিকে এক সামাজিক বিপ্লব বলা যায়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লেখা হল, ‘… ইনিই মহারাজ বল্লাল সেনের ৮০০ বৎসর পরে এই শ্রেণীবিভাগ ভাঙ্গিবার সুত্রপাত করিলেন। রাঢ় ও বারেন্দ্র ভূমির ভ্রাতারা সমস্ত ব্যবধান দূর করিয়া এত দিনের পর একহৃদয় একপ্রাণ হইল’।
সুতরাং বলা যেতেই পারে রবীন্দ্রনাথের সফল ঘটকালি বঙ্গজীবনে এক নূতন দিগন্তের সূচনা করেছিল।
Sanibarer Blog is all about Rabindranath Tagore and Rabindra Sangeet Recitation of poems and Tagore drama published by Purnendu Bikash Sarkart
Khub sundor. Samridhho holam.
সুন্দর
খুব ভালো লাগলো।
রবীন্দ্রনাথ যেন একটি রত্ন আকর। তাতে যে কত মণিমাণিক্য এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তাঁর লেখা, কবিতা, গান, একাধারে স্বাদেশিকতা ও বিশ্বমানবিকতা, জনশিক্ষা, জনহিতৈষীতা ইত্যাদি বহুমুখিতার বিষয় ছাড়াও আরও কত অজস্র তথ্য যে এখনও সাধারন্যে অজানা, তা অননুমেয়। ডাঃ সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁর অক্লান্ত রবীন্দ্রচর্চায় আমাদের এইগুলির সম্পর্কে অবহিত করার জন্য।