‘গলানো সোনা আঠাশ টাকা’ – কয়েক দশক আগে তেলের বিজ্ঞাপনের এই চারটি বাক্য সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। বিজ্ঞাপনের মুনশিয়ানাই যেকোনো পণ্যের বাজার-সাফল্যের চাবিকাঠি। পণ্য উৎপাদকেরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলেছেন বিজ্ঞাপন-গবেষণায়। তাই আজ বিজ্ঞাপনের মুখ হয়ে উঠেছে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, বিনোদন জগতের নায়ক নায়িকা, খেলোয়াড়, এমনকি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও। তাদের মুখের পণ্যের গুণাগুণ বাজারের চাহিদাকে আকাশচুম্বী করে তুলতে পারে।
এই সারকথাটাই উপলব্ধি করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগেকার ব্যবসায়ীরা। পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় তারকা। সেই সময় থেকেই তাঁকে দেখা গিয়েছে অসংখ্য পণ্যের বিজ্ঞাপনে। কী নেই সেখানে? তেল, ঘি, কালি, হারমোনিয়াম, কাজল, চা, সাবান, পেন ইত্যাদি অন্তত একশটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে রবীন্দ্রনাথের স্থান তখন শীর্ষে। জমিদারির কাজ সামলানো, শান্তিনিকেতন, শিলাইদহ, বিদেশভ্রমণ, লেখালেখির সাথে সাথে দেশবিদেশের অতিথি আপ্যায়ন, সাংসারিক টানাপোড়েনে অসম্ভব ব্যস্ত জীবন। তারমধ্যেই কেন তিনি এতগুলি পণ্যের বিজ্ঞাপনে নিজেকে জড়ালেন? সম্ভবত তাঁর স্বদেশপ্রীতি এবং স্বদেশীপণ্যর মাধ্যমে স্বনির্ভরতা ও সমাজ সচেতনতাই এর মূল কারণ।
তাঁর বিজ্ঞাপনগুলি হত সংক্ষিপ্ত, ভাষায় থাকত দেশপ্রেম, রসবোধ, ছন্দ আর বুদ্ধির অসাধারণ মিশ্রণ –যা পাঠক-ক্রেতাকে সহজেই আকৃষ্ট করত। এককথায় আল্ট্রামডার্ণ প্যাকেজ। সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনে লিখেছেন “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।” জলযোগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জন্য লিখেছিলেন, ‘জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর আলাদা স্বাদ আছে।…’ ।
রেডিয়াম ক্রিম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না’। বলাবাহুল্য এই বিজ্ঞাপনের পরে রেডিয়াম ক্রিমের জনপ্রিয়তা অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমন কি পাগলের মহৌষধের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের বাণী পাওয়া যায়, ‘ আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থপুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর উন্মাদরোগাক্রান্ত ছিলেন। আবার গোদরেজ সাবানকে যেকোন বিদেশী সাবানের চাইতে ভালো বলে দাবী করেছেন বিজ্ঞাপনে।
রবীন্দ্রনাথ মূলত দেশীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনই করতেন। কিন্তু একবার তাঁকে বিদেশী বোর্ণভিটার বিজ্ঞাপনেও দেখা গিয়েছে। লিখেছেন, ‘বোর্ণভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি’। অর্থাৎ বিদেশী পণ্য হলেও এই পানীয়ের উপরে রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট ভরসা ছিল। আবার একইসাথে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন দেশীয় নেপিয়ার পেন্টকে। তবে যে পণ্যই হোক না কেন, গুণগত মানের না হলে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত তার বিজ্ঞাপন করতেন না।
এস ঘোষের ফটোগ্রাফি, দ্বারকিনের হারমোনিয়াম বা কুন্তলীন কেশ তেল যেকোনো রবীন্দ্র-বাণী যুক্ত বিজ্ঞাপন সেই পণ্যকে লাভের মুখ দেখিয়েছিল। পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এমনই এক জনপ্রিয় তারকা।
রবীন্দ্রনাথের সুসীম-চা চক্র উদ্বোধনের দিনে লেখা গানের কিছু বাক্য (চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল কাতলি-জল তল কলকল হে..) নিয়ে লিপটন চায়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশের পরে চা-খোর শৌখিন মানুষদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছি, হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল লিপটন চা-এর বিক্রি।
বর্তমানে অবলুপ্ত শ্রীঘৃত সম্পর্কে বিজ্ঞাপন ‘বাংলায় ঘিয়ের ভেজাল বাঙালির অন্ত্রের ভেজালকেও অনিবার্য করে তুলেছে। আমি আশা করি শ্রীঘৃত বাঙালির এই ভেজাল রোগের প্রতিকার করবে’।
রবীন্দ্রনাথ-কৃত বিজ্ঞাপনের ভাষা, বাক্যরচনা, ব্যবহৃত ছবি, সবই নিজের করা। সেখানে থাকত নিজের দাড়িওয়ালা ছবিটি, কিছু প্রশংসা-বাক্য এবং তাঁর বিখ্যাত সাক্ষর। ব্যাস, তাতেই পণ্যের চাহিদা বেড়ে যেত চড়চড় করে। রবীন্দ্রনাথই বিজ্ঞাপনের ভাষা বা ক্যাচলাইন তৈরির পথ দেখিয়েছিলেন। বলা যায় এবিষয়ে তিনি পথিকৃৎ।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিমানভ্রমণ ঘটেছিল ১৯২১ সালের ১৬ এপ্রিল প্যারিস থেকে লণ্ডন যাত্রাপথে। তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে কে এল এম বিমানসংস্থা ‘গুরুদেবের বিমান যাত্রা’ শীর্ষক একটি বিজ্ঞাপন ছেপেছিল। এছাড়া ভারতীয় পূর্বরেল তাদের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার উল্লেখ করেছিল।
বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য বর্তমানে রয়েছে টিভি, রেডিও, বিলবোর্ড, ভিডিও, ফেসবুক-সহ নানা ডিজিটাল মাধ্যম। রবীন্দ্রনাথের সময়ে এগুলির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখন বিজ্ঞাপনগুলি প্রকাশিত হত ম্যাগাজিন ও পত্রিকাগুলিতে। মূলত আনন্দবাজার, বসুমতী, স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার ইত্যাদি দৈনিক সংবাদপত্র আর সাধনা, তত্ত্ববোধিনী, ভাণ্ডার, শনিবারের চিঠি ইত্যাদি পত্রিকারগুলিতেই এই সমস্ত বিজ্ঞাপনগুলি প্রকাশিত হত। এখনকার দিনের তারকারা কোটি কোটি টাকা দক্ষিণা নিয়ে থাকেন তাদের নাম বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করবার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র দেশীয় পণ্যের উন্নতি ও প্রসারের জন্যই নিজের জনপ্রিয়তাকে বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করেছিলেন, অর্থের জন্য নয়।
Purnendur Sanibarer Blog is all about Rabindranath Tagore RabindraSangeet Poems Recitations Dance Drama of India KolkataN
এত টা জানতাম না। ডোয়ার্কিনের হারমণিয়ামের বিজ্ঞাপন টা দেখেছি। খুব ভাল লাগছে
বহু আগে “জলযোগ” নামে একটি মিষ্টির দোকান ছিল উত্তর কলকাতায়। এখন উঠে গেছে। সম্ভবতঃ দক্ষিণ কলকাতায় এখনো আছে। ওই দোকানে রবীন্দ্রনাথের ছবিসহ একটি উদ্ধৃতি বড় করে বাঁধানো ছিল, যেখানে তিনি বলছেন “জলযোগের পয়োধি খাইয়া তৃপ্ত হইয়াছি” (বা ওই রকম কিছু লেখা ছিল)।