১৩৪৭ সালের শেষলগ্নে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন শান্তিনিকেতনে। দিন কাটছে রোগশয্যায়, কখনো কেদারায়, কখনো বিছানায়। এক নাগাড়ে বেশীক্ষণ কথা বলতে পারছেন না, নিজের হাতে লেখালেখিও প্রায় বন্ধ। অথচ তখনও চলছে তাঁর বিচিত্র সাহিত্যসৃষ্টির কাজ। রচনা করেছেন রোগশয্যায় (৫ পৌষ ১৩৪৭), জন্মদিনে (১ বৈশাখ ১৩৪৮), গল্পসল্প (২৭ বৈশাখ ১৩৪৮) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। এরই মধ্যে শুরু হল নববর্ষ আর কবির জন্মোৎসবের প্রস্তুতি। নতুন বছরের ভাষণের জন্য লিখছেন সভত্যার স্ংকট নামের একটি মূল্যবান প্রবন্ধ।
সেই সময়ে মৈত্রেয়ী দেবী প্রায় সবসময়েই রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থেকে তাঁর সেবাযত্ন করতেন, কবির মুখে মুখে বলে যাওয়া কবিতা, গান ইত্যাদি খাতায় টুকে রাখতেন। একদিন দুপুরবেলা কবি বিশ্রাম নিচ্ছেন, ঘুমে তন্দ্রাচ্ছন্ন। এমন সময় তাঁর প্রিয় নাতি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথের ছেলে) ঘরে ঢুকে হাঁকডাক করে তাঁকে ডেকে তুললেন। কবি চোখ মেলে চাইলেন। টুকরো টুকরো দুচার কথার পর নববর্ষের কথা উঠলে সৌমেন্দ্র অনুযোগ করে বললেন, রবিদা তুমি যন্ত্রের বর্ণনা করেছ, ‘নমো যন্ত্র নমো যন্ত্র’ লিখেছ, এবার মানুষের বন্দনা কর, মানুষের জয়গান গাও। মৈত্রেয়ী দেবী কাছেই ছিলেন। তিনি লিখেছেন, আমি তো শুনে অবাক। এ ব্যক্তি বলে কী? ইনি সারাজীবন মানুষের জয়গানই তো গাইলেন। যাইহোক পরদিন সকালে আমাকে কাগজকলম আনতে বললেন ও আমাকে dictate করলেন সেই আশ্চর্য গানটি – ঐ মহামানব আসে।
গান নয়, মৈত্রেয়ী দেবী কবির মুখে বলে যাওয়া যেটি কাগজে টুকে নিলেন সেটি আসলে কবিতা। এই কবিতাটিকে কাটছাঁট করেই ওই মহামানব আসে গানে রূপান্তর করা হয়েছিল। এই গান রচনা প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছেন, গুরুদেব লিখে দেশকে নববর্ষের বাণী পাঠাচ্ছেন অথচ গানে কোনো বাণী দেবেন না তা হতে পারে না। …পরের দিন গিয়ে বললাম, নববর্ষের প্রভাতে বৈতালিকের জন্য একটি নতুন গান রচনা করতে আপনার কষ্ট হবে? প্রথমে আপত্তি করলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে তা বন্ধ রাখতে পারলেন না। বললেন, সৌম্য (সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) আমাকে বলেছে মানুষের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে। সে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি, মানুষের জয়গান করিনি। তাই একটা কবিতা রচনা করেছি, সেটাই হবে নববর্ষের গান।
রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে গতদিনের লেখা কবিতার খাতাটা আনতে বললেন। শান্তিদেব ঘোষ কবিতাটি দেখলেন। কবিতাটির দুটি রূপ রয়েছে সেখানে। দুটিই একটু বড় (প্রথম রূপটি ২৭ লাইনের এবং দ্বিতীয় রূপটি ১৮ লাইনের)। শান্তিদেব দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবলেন এত বড় কবিতায় সুরসংযোগ করতে কবির নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হবে। শারিরীক অসুস্থতা সত্বেও রবীন্দ্রনাথ কবিতায় সুর দিতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। অল্পেই ক্লান্ত হয়ে শান্তিদেবকে বললেন, আজ থাক, কালকে হবে। পরের দিন শান্তিদেব আবার এলেন অত্যন্ত স্ংকোচের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ এবার কবিতাটিকে সংক্ষিপ্ত করে, কয়েকটি নতুন লাইন যুক্ত, কিছু শব্দ ও লাইনের অদলবদল করে গানের বর্তমান রূপটি (১২ লাইন) তৈরি করে, তাতে সুর বসিয়ে শান্তিদেবের হাতে তুলে দিলেন। সৃষ্টি হল সেই অসাধারণ ওই মহামানব আসে গানটি। শেষ লেখা (ভাদ্র ১৩৪৮) কাবগ্রন্থের ৬ সংখ্যক কবিতা হিসাবে এই সংক্ষিপ্ত রূপটিই সর্বত্র পরিচিত। গানটি শান্তিদেব ঘোষকে শিখিয়ে দেবার পরে বললেন, আমার জন্মদিনের উৎসবে গানটা গাওয়া হবে, তারপর এই বোকার দেশে সকলে বলবে না তো যে নিজেকেই মহামানব বলেছে!
১৩৪৮ সালের পয়লা বৈশাখে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ-প্রাঙ্গণে নববর্ষের উৎসব যথাযোগ্য মর্যদার সঙ্গে পালিত হয়েছিল। ক্ষিতিমোহন সেন সেদিন সভ্যতার সংকট অভিভাষণটি পাঠ করেছিলেন। সেই সভাতেই ওই মহামানব গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল। সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের ভাবনার সঙ্গে গানটির স্পষ্ট যোগাযোগ আছে। আর প্রবন্ধের সমাপ্তিতেও এটি মুদ্রিত রয়েছে।
এর কিছুদিন পরেই কবির আশিতম জন্মদিন। গুরুদেবের জন্মদিন এবারে কিভাবে উৎযাপন করা হবে সেটাই জানতে শান্তিদেব ঘোষ কবির সঙ্গে দেখা করলেন ২৩ বৈশাখে। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা জন্মদিন উপলক্ষে নাচগানের একটা ছোটো আয়োজন করা হোক।
১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথের বাষট্টিতম জন্মদিনটিকে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকেরা ঘরোয়াভাবে পালন করেছিলেন। ‘এই উপলক্ষে আশ্রমস্থ বালিকারা তাঁহার বাড়ির অলিন্দগুলি আলপনা, মাল্য ও মঙ্গলঘট দিয়া খুব সুন্দর করিয়া সাজাইয়াছিলেন’। ৮ মার্চ পূরবীর মাটির ডাক কবিতাটি রচনার পরে বহুদিনের আলস্য কাটিয়ে নিজের জন্মদিনের জন্য রবীন্দ্রনাথ পঁচিশে বৈশাখ শিরোনামের ‘রাত্রি হল ভোর’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। কবিতাটি যদিও নিজের একান্ত খেয়ালের রচনা, কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর অনুরোধে সবুজপত্রে ছাপানোর জন্য পাঠিয়ে লিখেছেন, আমার হাতে একটিও লেখা নেই। …আমার জন্মদিনে নিজের খেয়ালে নিজেরই উদ্দেশে একটা কবিতা লিখেছিলুম। ভেবেছিলুম সেটাকেই খাতার অন্তঃপুরেই রেখে দেব। কিন্তু তুমি লেখা দাবী করেচ বলে সেইটাই পাঠালাম, বিশেষ কিছু নয়। পরে এই কবিতাটাই পূরবী কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। আবার ১৮৯৯ সালে শিলাইদহ থাকাকালীন জন্মদিনের গান শিরোনামের ভয় হতে তব অভয় মাঝে গানটি রচনা করেছিলেন নিজের আটত্রিশতম জন্মদিন উপলক্ষে। তারপর কবির প্রায় প্রতিটি জন্মদিনই পালিত হয়েছে রবীন্দ্রভক্তদের উৎসাহ উদ্দীপনায়। কিন্তু নিজের জন্য আর কোনো গান বা কবিতা লেখেন নি।
১৩৪৮ সালের ২৫ বৈশাখ কবির আশিতম জন্মদিনটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ জন্মদিন। এই প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ‘রবীন্দ্রসংগীত’ বইটিতে লিখেছেন, পরের দিন সকালে (২২ বৈশাখ) তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, আপনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে কবিতা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, অথচ একটা গান রচনা করলেন না এটা ঠিক মনে হয় না। এবারের পঁচিশের বৈশাখে সমস্ত দেশ আপনার জন্মোৎসব করবে, এই দিনটিকে উপলক্ষ করে একটা গান রচনা না হলে জন্মদিনের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না। শুনে বললেন, তুই আবার একটা অদ্ভুত ফরমাশ এনে হাজির করলি। আমি নিজের জন্মদিনের গান নিজে রচনা করব, লোকে আমাকে বলবে কী! দেশের লোক এত নির্বোধ নয়, ঠিক ধরে ফেলবে যে, আমি নিজেকে নিজেই প্রচার করছি। তুই চেষ্টা কর এখানে যাঁরা বড়ো বড়ো কবি আছেন তাঁদের দিয়ে গান লেখাতে। … উত্তরে আমি বললাম আপনি থাকতে অন্যদের কাছে চাইবার কী প্রয়োজন। যখন জন্মদিনের কবিতা লিখেছিলেন, তখন কি কেউ আপনাকে দোষী করেছিল?
শান্তিদেবের যুক্তিতে নিমরাজি হয়ে রবীন্দ্রনাথ পঁচিশে বৈশাখ কবিতাটি নির্বাচন করলেন গানে রূপান্তর করবার জন্য। এই ধরনের কবিতা-গানের রূপান্তর কবি আগেও অনেক করেছেন। সেইভাবেই ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটিকে অবলম্বন করে খুব অল্প সময়েই হে নূতন দেখাদিক আরবার গানটি তৈরি করে ফেললেন। গান রচনার পরে, এতে সুরযোজনাও করা হল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। তখনও জানা ছিল না যে বিধাতা স্থির করে রেখেছেন এটাই কবির নিজস্ব সুর সংযোজিত শেষ গান। ‘পঁচিশের বৈশাখ’ কবিতাটি দীর্ঘ এবং সাতটি স্তবক নিয়ে গঠিত। গানে রূপান্তরের সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র ষষ্ঠ ও সপ্তম স্তবকদুটি গ্রহণ করেছেন কিছু অদলবদল, শব্দের পরিবর্তন এবং ছত্র-বর্জন করে। গান রচনার পরে শান্তিদেব ঘোষ গানটি শিখিয়ে তবে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।
শুধু গান নয়, এই জন্মদিনে তিনি একটি কবিতা (আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা) লিখে বাঁকুড়ায় অন্নদাশঙ্কর রায়কে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ আশ্রমবালিকাদের বশীকরণ প্রহসনটির অভিনয় উপভোগ করেছিলেন।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে গানের মধ্য দিয়ে বাংলা সংগীত জগতের যে নূতন দীগন্তের সূচনা হয়েছিল দীর্ঘ ৬৪ বছর পরে শেষ গানের রেশ নিয়ে সে যাত্রা শেষ হল ৮০ বছরে।
ওই মহামানব আসে | রচনা ১৪ এপ্রিল ১৯৪১ | রচনাস্থান শান্তিনিকেতন | কবির বয়স ৮০ বছর | পর্যায় আনুষ্ঠানিক সংগীত | স্বরলিপিকার শান্তিদেব ঘোষ | শেষলেখা (১৩৪৮) কাব্যগ্রন্থের ৬ সংখ্যক কবিতা
হে নূতন দেখা দিক আরবার | রচনা ৬ মে ১৯৪১ | রচনাস্থান শান্তিনিকেতন | কবির বয়স ৮০ বছর | পর্যায় আনুষ্ঠানিক সংগীত | স্বরলিপিকার শান্তিদেব ঘোষ | পুরবী কাব্যগ্রন্থের ৪ সংখ্যক কবিতা | সবুজপত্র পত্রিকার চৈত্র-বৈশাখ ১৩২৮-২৯ সংখ্যায় পঁচিশে বৈশাখ শিরোনামে প্রকাশিত।
ঋদ্ধ হলাম। প্রতি টি সপ্তাহ ধরে প্রতীক্ষায় থাকি… শনিবারের ব্লগের। এত সুন্দর তথ্য – সমৃদ্ধ লেখার আকর্ষণ এড়ানো বড়ই কঠিন। ধন্যবাদ ।
Asaadhaaron.ei parber sera lekhagulir modhye ekti.anondo bedoner misro rase achchhanno mon bole otthe ‘shes ganer resh nie jao chole’.
Kobir sheser dingulo apner lekhay apurbo madhuri nie fire esechhe.sharirik jantranaa tar sange prio natir arbachin uktike upeksha kore naba sristir anonde jebhabe charpash poripurno kore diechhen ta nirbak kore dey .abar dhanyobad o shubhechha janai.
জানা ঘটনাও সময়ের প্রবাহে মনের আড়ালে চলে যায়। তাকে সামনে আনতে গেলে যে কাজটি করতে হয় তা হলো আবার তাকে সযত্নে সামনে আনা। এক্ষেত্রে সেই কাজটি আপনি করলেন। আবার সেটি উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠলো। এই সমস্ত খণ্ডচিত্রের মধ্যেই তো আসল রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায়। মানুষ রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায়। চরৈবতি। আপনাকে ধন্যবাদ।