সারস্বত সমাজ (১৮৮২) : কলকাতার ৯২ নম্বর বউবাজার স্ট্রীটে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িটি ছিল তৎকালীন বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের মিলন ক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছেন। তিনিও মাঝে মাঝে ঐ আসরে উপস্থিত হতেন বঙ্কিমচন্দ্রের সান্নিধ্য লাভের আশায়। আর সেই যোগাযোগের অনুপ্রেরণাতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে ১৮৮২ সালের চৈত্র মাসে সারস্বত সমাজের সূচনা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র সাহিত্যচর্চা ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন, সঙ্গীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করা। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সভাপতিত্বে তৈরি করা হয়েছিল অনুষ্ঠানপত্র আর নিয়মাবলী। আরও সদস্য সংগ্রহের আশায় উদ্যোক্তেরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ আবেদন রেখেছিলেন। কিন্তু প্রথমে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। বিদ্যাসাগর মহাশয় তো বলেই দিয়েছিলেন, ‘আমি পরামর্শ দিতেছি, আমাদের মতো লোককে পরিত্যাগ করো। হোমরাচোমরাদের লইয়া কোনো কাজ হইবে না, কাহারও সঙ্গে কাহারও মত মিলিবে না।’ তিনি এই সভায় যোগ দিতে রাজি হননি।
সারস্বত সমাজের প্রথম অধিবেশন হয়েছিল জুলাই মাসের ১৬ তারিখে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। প্রথমদিকে কিছুটা সংশয় থাকলেও পরে বঙ্কিমচন্দ্র, শৌরীন্দ্রমহন ঠাকুর, কৃষ্ণবিহারী সেন প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সমাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৮২ সালের ২ ডিসেম্বর সারস্বত সমাজের একটি বিশেষ অধিবেশনে ভূগোলের পরিভাষা নিয়ে মূল্যবান আলোচনা হয়েছিল। ভৌগলিক পরিভাষা নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশের ইচ্ছাও ছিল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ রাজনারায়ন বসুকে লিখেছেন, ‘সারস্বত সমাজে গোল যথেষ্ঠ হইতেছে, কিন্তু ভূগোল কিছুই হইতেছে না’। সদস্যদের উৎসাহের অভাবে আর রবীন্দ্রনাথের বৃহত্তর কাজে ব্যস্ততার কারণে মাত্র এক বছরের মধ্যেই সারস্বত সমাজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
সারস্বত সমাজের মহত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথ হতাশ হননি। কোনো গঠনমূলক কাজে তিনি কখনোই হাল ছেড়ে দিতেন না। তাঁর দীর্ঘ জীবনে এর উদাহরণ আমরা বারবার লক্ষ করেছি। তাই ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি এবং সমমনস্ক কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিলে সমালোচনী সভা নামে একটি ছোটো গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল অক্রুর দত্ত লেনের সাবিত্রী লাইব্রেরিতে। যদিও এই সভাটিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
সঞ্জীবনী সভা (১৮৭৫) : সদ্য বিলেতফেরত ব্যারিস্টার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আকৃষ্ট হয়ে, দেশমাতৃকাকে ভালোবাসবার প্রতিজ্ঞায় বাংলার তরুণসমাজ সেদিন পাগল হয়ে উঠেছিল। সেই উত্তেজনার আঁচ এসে পৌঁছেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও। ১৮৭৫ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর রাজনারায়ন বসু দেশমাতৃকার সেবা আর স্বাদেশিকতার উদ্দেশে ‘সঞ্জীবনী সভা’ নামে একটা গুপ্ত সমিতি স্থাপন করেছিলেন, যার সাঙ্কেতিক নাম ছিল হামচুপামূহাফ। অফিস ঠনঠনিয়ার এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পোড়ো বাড়িতে। কিশোর রবীন্দ্রনাথও যোগ দিয়েছিলেন এই মহান কর্মযজ্ঞে। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘সমস্ত অনুষ্ঠান রহস্যে আবৃত ছিল। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋক মন্ত্রে, কথা চুপিচুপি।’ সভার কাজটি কেমন ছিল? রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘আমরা সভা করিয়া, কল্পনা করিয়া, বাক্যালাপ করিয়া, গান গাহিয়া সেই ধাক্কাটা (উত্তেজনার আগুন) সামলাইবার চেষ্টা করিয়াছি।…তাহাতে ফোর্ট উইলিয়ামের একটি ইস্টকও খসে নাই।’ সভার সদস্যরা স্বদেশী দেশলাই কারখানা স্থাপন, স্বদেশী কাপড় তৈরির যন্ত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আবিষ্কৃত অভিন্ন সার্বজনীন পোষাক উদ্ভাবন ইত্যাদি গঠনমূলক কাজ শুরু করলেও প্রতিটি প্রকল্পই ব্যর্থ হয়েছিল পরিকল্পনা আর অভিজ্ঞতার অভাবে।
১৫ বছরের রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভা তখন ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে, প্রশ্রয় পাচ্ছেন জ্যোতিদাদার কাছে। সঞ্জীবনী সভার জন্য লিখে ফেললেন একটি দীপ্ত গান, একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন। রাজনারায়ণবাবু গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে, হাতপা নেড়ে, চিৎকার করে সেই গান গেয়ে সংস্থার সদস্যদের উজ্জীবিত করতেন। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘দেশের সমস্ত খর্বতা দীনতা অপমানকে তিনি দগ্ধ করিয়া ফেলিতে চাহিতেন। তাঁহার দুইচক্ষু জ্বলিতে থাকিত, তাঁহার হৃদয় দীপ্ত হইয়া উঠিত, উৎসাহের সঙ্গে হাত নাড়িয়া আমাদের সঙ্গে মিলিয়া তিনি গান ধরিতেন। সঞ্জীবনী সভার সদস্যেরা দেশসেবার মহতী উদ্দেশ্যে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন। কিন্তু কিছু মানুষ যে-কোন ভালো কাজের মধ্যেও নানা ত্রুটি খুঁজে পান, খুঁৎ ধরেন । এখানেও কিছু ‘সুবুদ্ধি লোক’ এসে জুটল। তারা জানালেন যে সঞ্জীবনী সভার কার্যকলাপ রাষ্ট্রীয় রোষের কারণ হতে পারে। ফলে তাদের পরামর্শে সভার সদস্যরা নিজেদের গুটিয়ে নিলেন। মাত্র ছয় মাসেই (১৮৭৬-১৮৭৭) শেষ হয়ে গেল একটি সম্ভাবনাময় বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান।
পারিবারিক হিতকারী সভা (১৯০৯) : আত্মীয়পরিজন, দাসদাসী আর বহুলোকের কোলাহলে বিরক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং আরো অনেকে অন্যত্র চলে গেলেও জোড়াসাঁকোর সাংস্কৃতিক পরিবেশটি বজায় রেখেছিলেন মূলত গগনেন্দ্রনাথ আর আবনীন্দ্রনাথ। ১৯০৯ সালে জোড়াসাঁকোর দুঃস্থ আত্মীয়স্বজনদের আর্থিক সাহায্যের জন্য তাঁরা স্থাপন করেছিলেন পারিবারিক হিতকারী সভা। এই সভা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও পূর্ণিমা চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সকলেই আত্মীয়দের পুষত বলে বাবা রবিদাদা ও অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন যে, সব বাড়ি থেকে কিছু কিছু চাঁদা তুলে ফাণ্ড করবেন। সেই ফাণ্ড থেকে দুঃস্থ লোকেদের সাহায্য করা যায় তা হলে কারও গায়ে লাগে না। তাই পারিবারিক হিতকারী সভা নাম দিয়ে একটা কমিটি গঠন করেন। সকলে মিলে দেখাশোনা করতেন।’ ফাণ্ড থেকে শুধুমাত্র ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়দেরই মাসোহারার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। বাইরের লোক এই সুবিধা পেত না। ফাণ্ডের আয় বাড়াবার জন্য মাঝে মাঝে ‘দানমেলা’র আয়োজন করা হত। সেখানে বাড়ির মেয়েরা নিজেদের হাতের কাজ, সেলাই, খাবার, পুতুল ইত্যাদি তৈরি করে বিক্রি করত। আর প্রত্যেকের বাড়িতে মাসে একদিন করে মিটিং বসত । মেয়েদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য ঠিক হয়েছিল যার হাতের কাজ ভাল হবে সে প্রাইজ পাবে।
বিচিত্রা ক্লাব (১৯১৫) : জোড়াসাঁকোর সবচেয়ে উজ্জ্বল আর ঐতিহ্যময় ক্লাবটির নাম বিচিত্রা ক্লাব। বিচিত্রা ভবন তথা লালবাড়ি ছিল বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম পীঠস্থান, তার কর্মধারাও ছিল বিচিত্র। ১৯১৫ সালে ১২ জুলাই রথীন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথের উদ্দ্যোগে লালাবাড়িতে এক বিশেষ অধিবেশনের মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল বিচিত্রা ক্লাবের। এই ক্লাবের মূল উদ্দেশ্য ছিল চিত্রকলা-চর্চা আর তার নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। নন্দলাল বসু বিচিত্রা কথাটি খুব সুন্দর অক্ষরে কুঁড়েঘরের ধাঁচে এঁকে সংস্থার প্রতীকচিহ্নটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সূচনার সময় ক্লাবটির নাম ছিল The Bichitra Studio for Artistes of the Neo-Bengal Scholler. পরে রবীন্দ্রনাথ এর নতুন নাম দিয়েছেন বিচিত্রা। গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের শিল্প প্রতিভার তখন মধ্যগগন। তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে ছবি এঁকেছেন নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, মুকুল দে এবং আরও অনেকে। ছিল একটি পাঠাগার যেখানে সন্ধ্যায় সকলে মিলিত হতেন রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প-প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনায় অংশ নেবার জন্য। এখানকার বিরাট হলঘরে অভিনীত হয়েছে ডাকঘর, বৈকুন্ঠের খাতা, শেষ বর্ষণ, নটীর পূজা, ফাল্গুনী, চিরকুমার সভা ইত্যাদি নাটক। ১৯২১ সালে বিচিত্রা বাড়ির পিছনের ফাঁকা জমিতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিচিত্রা ক্লাবের মূল প্রেরণা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এরপরে বিশ্বভারতীর বহুতর কাজের ব্যস্ততা, বৃহত্তর আহ্বানে বিশ্বের নানাপ্রান্তে ছুটোছুটি ইত্যাদি কারণে বিচিত্রা ক্লাবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ কমে গিয়েছিল।