হামচুপামূহাফ
১৮৭৫ সালের জুলাই মাস। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিলেত থেকে ফিরেছেন ব্যারিষ্টার হয়ে। সেই সময়ে ব্যারিস্টারী ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় আর অর্থকরী পেশা। কিন্তু সেই মোহ ত্যাগ করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন তরুণসমাজকে স্বদেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ করবার কাজে। সঙ্গে পেলেন আনন্দমোহন বসু, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ও আরও কয়েকজনকে। তাঁদের বক্তৃতায়, ইতালিকে অস্ট্রিয়ার-শাসন থেকে মুক্ত করবার জন্য কার্বোনারি-সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত গুপ্তসমিতির কার্যকলাপ তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এক দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। শোষক ইংরাজকে দেশ থেকে বহিষ্কার, স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার আর দেশমাতৃকাকে ভালোবাসবার প্রতিজ্ঞায় এখানেও গড়ে উঠেছিল ছোটো ছোটো অনেক গুপ্তসমিতি।
উত্তেজনার আঁচ এসে পড়ল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেও। বৈপ্লবিক কাজ করবার অদম্য বাসনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রাজনারায়ন বসুর উদ্দ্যোগে তৈরি হল সঞ্জীবনী সভা নামে এক গুপ্ত সমিতি। সভার সাঙ্কেতিক নাম হামচুপামূহাফ। সভাপতি মনোনীত হলেন রাজনারায়ণ বসু। ভয়ংকর রহস্যাবৃত এই গোপন সভার উদ্দেশ্য স্বাদেশিকতা। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সবেমাত্র ১৫ বছর। তিনিও যোগ দিলেন এই যজ্ঞে। সমিতির অফিস ছিল ঠনঠনিয়ার এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পোড়ো বাড়িতে। আসবাব বলতে ভাঙা টেবিলচেয়ার, হেলে পড়া টানাপাখা আর টিমটিমে তেলের প্রদীপ। সেখানে ‘দ্বার রুদ্ধ, ঘর অন্ধকার, কথা চুপিচুপি, উত্তেজনা চরম’।
সঞ্জীবনী সভার নূতন সদস্যদের দীক্ষাদান হত ঋকমন্ত্রে। গভীর রাত্রে অগ্নিকুণ্ডের সামনে, বুকচিরে রক্ত দিয়ে বটপাতায় লিখে দিতে হত মন্ত্রগুপ্তির প্রতিজ্ঞা। তারপরে সেই রক্তলেখা বটপাতা পোড়ানো হত পবিত্র হোমাগ্নিতে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই দীক্ষানুষ্ঠানের এক অসাধারণ বর্ণনা লিখেছেন তাঁর স্মৃতিচারণায় , ‘যেদিন নূতন কোনও সভ্য এই সভায় দীক্ষিত হইতেন সেদিন অধ্যক্ষমহাশয় লাল পট্টবস্ত্র পরিয়া সভায় আসিতেন।.. আদি-ব্রাহ্ম সমাজ পুস্তকাগার হইতে লাল-রেশম জড়ানো বেদ-মন্ত্রের একখানা পুঁথি এই সভায় আনিয়া রাখা হইয়াছিল। টেবিলের দুইপাশে দুইটি মড়ার মাথা থাকিত, তাহার দুইটি চক্ষুকোটরে দুইটি মোমবাতি বসানো ছিল। মড়ার মাথাটি মৃত ভারতের সাঙ্কেতিক চিহ্ন। বাতি দুইটি জ্বালাইবার অর্থ এই যে, মৃত-ভারতে প্রাণসঞ্চার করিতে হইবে ও তাহার জ্ঞানচক্ষু ফুটাইয়া তুলিতে হইবে’।
এইভাবে গগনচন্দ্র হোম, ব্রজনাথ দে, নবগোপাল মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিগণ সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন।
সভা শুরু হত বেদমন্ত্র গানে, কার্যবিবরণী লেখা হত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্ভাবিত গুপ্তভাষায়। সভার কাজটি কেমন ছিল? রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘আমরা সভা করিয়া, কল্পনা করিয়া, বাক্যালাপ করিয়া, গান গাহিয়া সেই ধাক্কাটা (উত্তেজনার আগুন) সামলাইবার চেষ্টা করিয়াছি।…তাহাতে ফোর্ট উইলিয়ামের একটি ইস্টকও খসে নাই’।
কিন্তু কিছু কাজের চেষ্টাও হয়েছিল। সদস্যরা নিজেদের আয়ের দশ শতাংশ দান করতেন। সেই টাকায় একটা স্বদেশী দেশলাই কারখানা স্থাপন করা হল। অনেক গবেষণা ও অর্থব্যায়ের পরে যে দেশলাই তৈরি হল তার একটি বাক্সের যা খরচ পড়ল, তাতে সারা পাড়ার সম্বৎসরের উনুন ধরানো যেত।
এর পরের প্রচেষ্টা হল স্বদেশী কাপড়। অনভিজ্ঞ সদস্যরা প্রচুর ঋণ নিয়ে কিনে ফেললেন কাপড় তৈরির সরঞ্জাম। বহু প্রতীক্ষার পর, ‘অবশেষে ব্রজবাবু একদিন মাথায় একটা গামছে বেঁধে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উপস্থিত এবং তঁদের কলে এই গামছার টুকরো তৈরি হয়েছে বলে তাণ্ডব নৃত্য জুড়ে দিলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অনেক গবেষণা করে ভারতবাসীর জন্য এক অভিন্ন সার্বজনীন পোষাক উদ্ভাবন করলেন। কেমন সেটি? বলা যায় পাজামা, ধুতি, শোলার টুপি আর পাগড়ির মিশ্রণে তৈরি এক অপরূপ পোষাক। বলাবাহুল্য স্বয়ং আবিষ্কারক ছাড়া আর কেউ এই পোষাক পরিধান করতে সাহস পাননি।
সঞ্জীবনী গুপ্ত সভার সদস্যদের উদ্দীপ্ত করবার জন্য রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছেন। তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ এবং একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন। শেষোক্ত গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা পুরুবিক্রম নাটকে ব্যবহৃত হয়েছিল। রাজনারায়ণবাবু গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে, হাতপা নাড়িয়ে চিৎকার করে এই গানগুলি গেয়ে সংস্থার সদস্যদের উজ্জীবিত করতেন।
এতসব ভয়ংকর গুরুত্বপূর্ণ কাজের টেনশন থেকে মাঝে মাঝে মুক্তি পাবার জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সঞ্জীবনী সভার সদস্যরা সদলবলে শিকারে বেরোতেন। সঙ্গে থাকত কাদম্বরীদেবীর হাতের তৈরি ‘রাশিকৃত লুচি তরকারি’। শিকারের ক্ষেত্রটি ছিল মানিকতলার কোনও পোড়ো বাগান বাড়ি। দলে জুটে যেত চেনাঅচেনা ছোটোবড়ো নানা শ্রেনীর লোক। সেই রোমাঞ্চকর শিকারের বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, ‘এই শিকারে রক্তপাতটাই সবচেয়ে নগণ্য ছিল। শিকারের অন্য সমস্ত অনুষ্ঠানই বেশ ভরপুরমাত্রায় ছিল। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসিয়া উচ্চনীচ নির্বিচারে সকলে এক্ত্র মিলিয়া লুচির উপরে পড়িয়া মুহূর্তের মধ্যে কেবল পাত্রটাকে মাত্র বাকি রাখিতাম’।
এইভাবে সঞ্জীবনী সভা দেশসেবার মহতী উদ্দেশ্যে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন। ধীরে ধীরে সদস্যসংখ্যাও বেড়েছিল একটু একটু করে। কিন্তু সব ভালো কাজের মধ্যেও কিছু সন্দেহপ্রবণ মানুষ থাকে। এখানেও কিছু ‘সুবুদ্ধি লোক’ এসে জুটল। তাদের জ্ঞানগর্ভ পরামর্শে সঞ্জীবনী সভার সদস্যরা রাষ্ট্রীয়-বিদ্বেষের আশঙ্কায় নিজেদের গুটিয়ে নিলেন। মাত্র ছয়মাসেই (১৮৭৬-১৮৭৭) শেষ হয়ে গেল একটি সম্ভাবনাময় বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানের।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গুপ্তভাষার কৌশল
আকার = অকার | অকার = আকার | ই = উ | ঈ = উ |
উ = ই | উ = ঈ | এ = ঐ | ঐ=এ | ও = ঔ | ঔ = ও
ক খ গ ঘ = গ ঘ ক খ | চ ছ জ ঝ = জ ঝ চ ছ | ট ঠ ড ঢ = ড ঢ ট ঠ
ত থ দ ধ = দ ধ ত থ | প ফ ব ভ = ব ভ প ফ | শ ষ স = হ
হ = স | র = ল | ল =র | ম = ন | ন = ম
স ন্ জী ব নী স ভা = হা ম্ চু পা মূ হা ফ্
এই সভা কি কেবলই ঠনঠনিয়ার পোড়ো বাড়িতে গভীর রাতে হত? অন্য স্থান ও সময়ের উল্লেখও পাই। “কোন এক ব্রাহ্মণ জমিদার সভ্যের গঙ্গার ধারের বাগানবাড়িতে” আর সময় বোধহয় সন্ধ্যা। কেন না উল্লেখ আছে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আর একটা গানের উল্লেখ পাই। ” আজি উন্মদ পবনে “। স্মৃতি হয়তো প্রতারিত হয়েছে , কোন গানের প্রথম পঙ্ক্তি এই রকম নেই। এই সময় ভারতী পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি গান একসঙ্গে প্রকাশিত হয়। শাঙন গগনে ঘোর ঘন ঘটা নিশীথ যামিনীরে । এই রকম পঙ্ক্তি আছে। যদিও সঞ্জীবনী সভার কেন্দ্রীয় ভাবনার সঙ্গে এই গানের কোন মিল নেই। হয়তো সেদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রাজনারায়ণকে এই গান গাইতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
অসাধারণ লাগলো, এতো অজানা অদ্ভুত তথ্য জানতে পেরে..অনেক শুভকামনা রইলো..😊🙏
চমৎকার রচনা।