১৮৮২ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ। বাতাসে হালকা শীতের আভাস। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিজের পড়বার ঘরে ১৪ বছরের এক বালক নিবিষ্টমনে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। কিন্তু বারবার তার মনোযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা উচ্চস্বরে একটি কণ্ঠের কিছু সংলাপে। সঙ্গে ছিল মৃদুস্বরের অন্য কন্ঠ। উচ্চকণ্ঠটি ছিল রামসর্বস্ব পণ্ডিতের, বালকটির সংস্কৃত শিক্ষক, মৃদুকণ্ঠটি মেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আর বালকটি আমাদের রবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একাধারে নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা ও চিত্রশিল্পী। তিনি সবে তার নতুন রচনা ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক’ শেষ করেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রামসর্বস্ব পণ্ডিত সেই নাটকের প্রুফই সংশোধন করছিলেন। রামসর্বস্ব পণ্ডিতের কণ্ঠ বরাবরই একটু উচ্চগ্রামে বাঁধা। আর সেই কণ্ঠই বালক রবির পড়ার বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল।
সরোজিনী একটা বিয়োগান্ত নাটক, নিজের সম্মান রক্ষার্থে সরোজিনী নামে এক রাজপুত রমণীর আত্মহত্যার কাহিনী নিয়ে যার সমাপন। সরোজিনী ছিলেন রাজস্থানের অন্তর্গত মেয়োয়ারের রাণা লক্ষণ সিংহের কন্যা। যুদ্ধে আলাউদ্দিন খিলজির কাছে রাণা লক্ষণ সিংহ পরাজিত হবার পর রাজপুত রমণীদের শ্লীলতাহানির সম্ভাবনা দেখা দেয়। জ্বলন্ত আগুনে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তারা নিজেদের সতীত্ব রক্ষা করেন।
সরোজিনী নাটকের এই ট্রাজেডি বালক রবীন্দ্রনাথকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে তিনি নিজের পাঠ বন্ধ রেখে চুপ করে বসে রামসর্বস্ব ও জ্যোতিদাদার প্রুফ পড়া শুনছিলেন। আবার মাঝে মাঝে নিজের মতামত, অর্থাৎ সংলাপের কোথায় একটু পরিবর্তন করলে নাটকটা আরো ভালো জমে ওঠে, তা জানিয়ে দিচ্ছিলেন নিজের পণ্ডিত মহাশয়কে।
নাটকের মধ্যে একটা দৃশ্য আছে যেখানে দেখানো হয়েছে, যুদ্ধে পরাজিত হবার পরে, রাজপুত মহিলারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জনের সংকল্পে জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই দৃশ্যটাকে আরো আবেগময় করে তোলবার জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এখানে একটা বক্তৃতা রচনা করেছিলেন। পণ্ডিত রামসর্বস্ব যখন বক্তৃতার অংশটি পাঠ করছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা অস্থির হয়ে উঠল। তিনি আর নিজের ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। সটান পাশের ঘরে গিয়ে জ্যোতিদাদাকে বললেন যে, নীরস বক্তৃতা এখানে কিছুতেই খাপ খায় না। সরোজিনী জ্বলন্ত আগুনে হেঁটে আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছেন, এই দৃশ্যের পিছনে বক্তৃতার বদলে একমাত্র গান বা পদ্যরচনাই সঠিক নির্বাচন হতে পারে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। বয়সে অনেক ছোটো হলেও রবির কাব্যপ্রতিভাকে তিনি মর্যদা দিতেন। আসলে দুজন সৃজনশীল মানুষের মনের তার যেন একসুরেই বাঁধা ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছোটোভাইয়ের প্রস্তাবটা উপেক্ষা করতে পারলেন না। বক্তৃতাটা তাঁরও ঠিক মনের মত হয়নি, এজন্য তিনিও বরাবর একটু খুঁৎখুঁৎ করছিলেন। কিন্তু সময় কোথায়? এত অল্পসময়ে দৃশ্য- উপযোগী একটা পদ্যরচনা করা কি সম্ভব? দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল তাঁর কপালে।
দাদার এই সঙ্কটে এগিয়ে এলেন রবি। ভার নিলেন সমস্যা সমাধানের। নিজের পড়ার ঘরে গিয়ে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে নাটকের দৃশ্যটা মানসচক্ষে দেখবার চেষ্টা করতে করতে লিখে ফেললেন একটি অসাধারণ গান, ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ, পরান সঁপিবে বিধবা বালা’ । কতটুকুই বা সময় লাগল এই ৩৬ লাইনের রচনাটি লিখতে ? কাব্যপ্রতিভাময় যাঁর চেতনা, তাঁর সৃষ্টি তো এভাবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে রবির বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। গুটি গুটি পায়ে বালক রবি পাশের ঘরে গিয়ে দাদার হাতে তুলে দিলেন তাঁর রচনা। কবিতাটি পাঠ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রামসর্বস্ব চমৎকৃত হয়ে রবিকে অনেক বাহবা দিলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৫ অগ্রহায়ণ ১২৮২ সালে। গানটি রয়েছে নাটকের ষষ্ঠ অঙ্কের একেবারে শেষ দৃশ্যে। যদিও প্রথমেই বলা হয়েছে প্রুফ দেখবার ঘটনাটা কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহের তবুও অনুমান করা যায় গানটির রচনা কাল কার্তিকের শেষ কিম্বা অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহ ।
২ মাঘ ১৮৮২ সালে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে নাটকের প্রথম অভিনয় হয়েছিল। সরোজিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সেকালের বিখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী নটী বিনোদিনী এবং বিজয়সিংহের ভূমিকায় অমৃতলাল বসু। নাটকটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই জনপ্রিয়তায় রবীন্দ্রনাথের ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ ‘ গানটির অবদান ছিলো সর্বাধিক। কারণ এই একটি গানই নাটকের অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলো। সরোজিনীর ভূমিকাভিনেত্রী বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীতে দৃশ্যটির বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন ‘রাজপুত ললনারা গাইতে গাইতে চিতারোহণ করছেন। সে দৃশ্যটি যেন মানুষকে উন্মাদ করে দিত। তিন চার জায়গায় ধূ ধূ করে চিতা জ্বলছে, সে আগুনের শিখা দু’তিন হাত ঊঁচুতে উঠে লকলক করছে। তখন তো আর বিদ্যুতের আলো ছিলো না, স্টেজের উপর ৪/৫ ফুট লম্বা সরু সরু কাঠ জ্বেলে দেওয়া হ’ত। লাল রঙের শাড়ি পরে, কেউ বা ফুলের গয়নায় সেজে, কেউ বা ফুলের মালা হাতে নিয়ে এক এক দল রাজপুত রমণী গাইতে গাইতে চিতা প্রদক্ষিণ করছে, আর ঝুপ করে আগুনের মধ্যে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে পিচকারী করে সেই আগুনের মধ্যে কেরোসিন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে, তাতে কারু বা চুল পুড়ে যাচ্ছে, কারু বা কাপড় ধরে উঠছে – তবুও কারু ভ্রুক্ষেপ নেই – তারা আবার ঘুরে আসছে, আবার সেই আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তখন যে কি রকমের একটা উত্তেজনা হ’ত তা লিখে ঠিক বোঝাতে পারছি না’।
জ্বল্ জ্বল্ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ, পরান সঁপিবে বিধবা-বালা।
জ্বলুক্ জ্বলুক্ চিতার আগুন, জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা।
শোন্ রে যবন! শোন্ রে তোরা, যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে,
সাক্ষী র’লেন দেবতা তার এর প্রতিফল ভুগিতে হবে।
দেখ্ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন, দেখ্ রে চন্দ্রমা দেখ্ রে গগন!
স্বর্গ হতে সব দেখ্ দেবগণ, জলদ-অক্ষরে রাখ্ গো লিখে।
(তথ্যসূত্রঃ বিনোদিনী দাসীঃ ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ আমার কথা ও অন্যান্য রচনা {১৩৭৬})
সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ সরোজিনী নাটকটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, যার অন্যতম কারণ ছিল রবীন্দ্রনাথের গানটি। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত গান- রচয়িতার পরিচয় উহ্য থাকায় সমস্ত প্রশংসা পেয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। বালক রবির প্রতিভার স্বীকৃতি ঘটেনি সেই সময়ে।
অসাধারণ লেখা।
বিষয়টি খুবই তথ্যসমৃদ্ধ এবং গানটি উচ্চারণ ও গায়কীর গুণে বলিষ্ঠতার ছাপ রেখেছে।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে বুঝলাম গান টি নাটক কে পূর্নতা দিয়েছিল। কিন্তু ভেবে পাইনা শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পেতে যে গন আত্মহত্যা তা কি রকম ভাবে সতীদাহের মত হত্যা প্রথায় পরিবর্তিত হলো,নাকি হত্যা প্রথা আগেই ছিল তাকে গৌরবময় করতে এই ঘটনা। আজও শুনতে পাওয়া যায় এই হত্যার কথা।
আপনার কাছ থেকে কবিগুরুর এই রচনা যেমন জানতে পারলাম তেমনি আশায় রইলাম কু প্রথার বিরুদ্ধে গুরুদেবের গানের উৎসমুখ সম্বন্ধে নতুন কিছু শুনতে। বাতুলতা হয়ে গেলে ক্ষমা করবেন।
খুব ভালো লাগলো সরোজিনী নাটকের এই তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ! আরো জানার ইচ্ছে রইলো।
বাহ্… অসাধারণ তথ্য.. সমৃদ্ধ হলাম..
অনেক অনেক শুভকামনা রইলো..💐💐