শিল্পীর আঁকা ছবিকে কেন্দ্র করে গান রচনা রবীন্দ্রনাথের সৃজনক্ষমতার একটি বিশেষ প্রকাশ। অসিতকুমার হালদারের আঁকা সরস্বতীর ছবি ‘দিব্যপ্রজ্ঞা’ দেখে লিখেছেন ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’ (৭ এপ্রিল ১৯১৪) গানটি। আবার নন্দলাল বসুর ‘দীক্ষা’ ছবির বিষয়কে নিয়ে রচনা করেছেন পূজা পর্যায়ের ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ (১ জানুয়ারি ১৯১০) গানটি। তেমনই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ গানের পিছনে রয়েছে আর একটি ছবির ইতিহাস।
———————-
তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে
অসুস্থতার কারণে ১৯১২ সালের মার্চ মাসে প্রস্তাবিত ইংলণ্ড যাত্রা বাতিল হয়ে গেলে বিশ্রামের জন্য রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন শিলাইদহে ছিলেন। সেখানেই গীতিমাল্য কাব্যের সূচনা হয়েছিল। তারপরের তিন বছরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন, ইংলণ্ড, সমুদ্রপথ, কলকাতা, রামগড় ইত্যাদি নানা জায়গায় লিখেছেন গীতিমাল্যের শতাধিক গান-কবিতা। ১৯১৪ সালের চৈত্র মাসেই শান্তিনিকেতনে লেখা হয়েছিল ২৪ টি রচনা। তারই একটি ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’ গানটি সৃষ্টির গল্প শুনিয়েছেন অসিতকুমার হালদারও তাঁর রবিতীর্থ বইটিতে।
অসিতকুমার হালদার (১৮৯০-১৯৬৪) প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন একনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন। সম্পর্কে তিনি রবীন্দ্রনাথের নাতি (রবীন্দ্রনাথের দিদি শরৎকুমারীর কন্যা সুপ্রভাদেবীর পুত্র)। ১৯১১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি শান্তিনিকেতনে কলা বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুকুলচন্দ্র দে (১৮৯৫-১৯৮৯) তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র। তিনিও চিত্রকলা শিল্পের এক প্রতিভাময় চরিত্র। সদাহাস্যময় মুকুল কবির খুবই স্নেহের পাত্র। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নানা বিদেশ ভ্রমণে মুকুলকে সঙ্গী করে নিতেন। কবির কাছে মুকুলের ছিল আবাধ যাতায়াত।
সেবার, ১৯১৪ সালে, অসিতকুমার রাঁচিতে গিয়েছেন বিশেষ কাজে। একদিন মুকুলের মনে ছবি আঁকবার বাসনা জন্মাল। কিন্তু কী আঁকবেন ভেবে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে আবদার করলেন কোনো একটা বিষয়বস্তু নির্বাচন করে দিতে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমার উপযুক্ত একটি সরস্বতী আঁক, দিব্যপ্রজ্ঞা। ক্যালেন্ডারের সরস্বতী চাই না। মহা উতৎসাহে মুকুল ছবি আঁকতে বসে গেলেন। একের পর এক ছবি আঁকছেন আর রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে আসছেন। কিন্তু কোনোটাই কবির পছন্দ হচ্ছে না। আরও কয়েকবার চেষ্টা করে মুকুল হাল ছেড়ে দিলেন।
যথাসময়ে অসিত হালদারও রাঁচির কাজ মিটিয়ে আশ্রমে ফিরে এসেছেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে মুকুলের ছবি আঁকবার কথাটা তুললেন। কবি কিন্তু সরস্বতীর দিব্যপ্রজ্ঞার কথাটা ভুলতে পারেন নি। তিনি অসিত হালদারকে অনুরোধ করলেন ছবিটা নতুন করে এঁকে দেবার জন্য। শুধু তাই নয় ছবিটা কেমন হবে তার একটি আভাষও বর্ণনা করলেন জ্যোতিদৃপ্ত ভাবে, নিজের কল্পনার অনুভূতি মিশিয়ে। শিল্পী অসিত হালদার চট করে বুঝে নিলেন কবির মনের চাহিদাটা। অধ্যক্ষ এবারে নিজেই কবির উপযুক্ত দিব্যপ্রজ্ঞা সরস্বতী আঁকতে বসে গেলেন। কথা বলার সময়ে কবি যেভাবে জ্যোতিদৃপ্ত ভাব প্রকাশ করেছিলেন সরস্বতীর বিষয়ে, অধ্যক্ষ সেই আভাস পেয়ে এক অগ্নিময়ী সরস্বতীর রূপ আঁকলেন। আঁকা শেষে রবীন্দ্রনাথের কাছে ছবিটা তুলে ধরতেই কবির মনেও সুরের রঙ ধরল। রঙের সঙ্গে সুর মিশিয়ে সাথে সাথে রচনা করলেন ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’। তৈরি হল ছবির রঙ আর গানের সুরের এক অনন্য কোলাজ, গীতিমাল্যের আর একটি অসাধারণ গান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় অসিতকুমারের আঁকা ছবিকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ আরো কয়েকটি গানের জন্ম দিয়েছিলেন।
ওগো বধূ সুন্দরী তুমি মধুমঞ্জরী
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ (স্ত্রী সংজ্ঞা দেবী)। তাঁদের কন্যা মঞ্জুশ্রী রবীন্দ্রনাথের আদরের নাতনী। মঞ্জুশ্রী ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম দুজন ছাত্রীদের একজন। সুকন্ঠী মঞ্জুশ্রীর অভিনয় দক্ষতার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিসর্জন, ভৈরবের বলী ইত্যাদি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে যামিনীমোহন চট্টোপধ্যায়ের পুত্র ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। রবীন্দ্রনাথের ভৈরবের বলীতে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ঐ একই নাটকে রবীন্দ্রনাথ মঞ্জুশ্রীকে অপর্ণার ভূমিকায় নির্বাচন করেছিলেন । ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কংগ্রেসের একজন প্রথম সারির নেতা এবং অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্দ্যোক্তা। প্রসঙ্গত সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। কালক্রমে মঞ্জুশ্রীও ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কলকাতায় ১৩৫০ এর দুর্ভিক্ষের সময়ে নিজের বাড়িতেই তিনি রিলিফ সেন্টার খুলেছিলেন।
তাই মঞ্জুশ্রীর সঙ্গে যখন ক্ষিতীশপ্রসাদের বিবাহের প্রস্তাব এসেছিল, রবীন্দ্রনাথ তাতে সানন্দে তাঁর সম্মতি জানিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালের ১০ই মার্চ মঞ্জুশ্রী-ক্ষিতিশপ্রসাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। বিবাহের দিনে রবীন্দ্রনাথ নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে বিবাহিত জীবনকে সার্থক করে তোলবার জন্য সময়োপযোগী উপদেশ দেন। রবীন্দ্রনাথ নানাসময়ে পরিচিতজনের বিবাহ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন ইত্যাদি উপলক্ষে বহু গান এবং কবিতা রচনা করে আশীর্বাদ হিসাবে উপহার দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও তিনি নবদম্পতিকে দিয়েছিলেন একটি অনবদ্য সুন্দর উপহার।
রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছুদিন আগে ‘সাত ভাই চম্পা নামে’ একটি অসাধারণ ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেই ছবিকে কেন্দ্র করে ‘বধূমঙ্গল‘ শিরোনামে একটা কবিতা রচনা করে পরিণয়-উপহার হিসাবে নবদম্পতির হাতে তুলে দেন । পরে কবিতাটি গানে (ওগো বধূ সুন্দরী) রূপান্তরিত হয়েছে।
বিয়ের পরের দিন নিজের বাড়ী ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়, ক্রন্দনাকুল মঞ্জুশ্রীকে দেখে মেয়েদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা পর্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে এক দার্শনিক ভাবনার উদয় হয়েছিল। কিছুদিন পরে রাণুকে লিখেছেন, ‘ওর কান্না দেখে বুঝতে পারি মেয়েদের পক্ষে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়াকে কতখানি বোঝায়। স্বামীর উপর কতখানি ভালোবাসা থাকলে এই বন্ধন ছেদনটা সহজ হয় তা ঠিক বুঝতে পারা পুরুষদের পক্ষে শক্ত। মঞ্জুর এই কান্না নিশ্চয়ই ক্ষিতিশের মনে খুব বেদনা দিচ্ছে, তার মনে হয়ত সংশয় হচ্ছে মঞ্জু তাকে যথেষ্ঠ ভালোবাসে কিনা। এই সংশয়ের উপর এই অনিশ্চয়ের উপরই মানুষের বড় বড় ট্র্যাজেডির পত্তন। মঞ্জু আজও তার নিজের সংসারটিকে সৃষ্টি করতে আরম্ভ করেনি বলেই তার মা-বাপের সংসার ত্যাগ করে যেতে এত কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যে মুহূর্তে তার আপন জীবন দিয়ে তার সংসার সৃষ্টি করতে পারবে সেই মুহুর্তেই তার বাপ মায়ের সংসার তার কাছে ছায়ার মতো হয়ে যাবে’।
১৯৩৫ সালের ২০ মার্চ (৫ চৈত্র ১৩৪১) দোল পূর্ণিমার রাত্রে শান্তিনিকেতনে একটি বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সেদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ওগো বধূ সুন্দরী এবং আমার বনে বনে ধরল মুকুল গানদুটি গেয়েছিলেন। মঞ্জুশ্রী-ক্ষিতিশপ্রসাদের বিবাহে উপহার দেওয়া ওগো বধূ সুন্দরী কবিতাটির কিছু পাঠ পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে এটিকে গানে রূপান্তর করেছেন।
ওগো বধূ সুন্দরী, রচনা ১০ মার্চ ১৯২৪, রচনাস্থান কলকাতা, কবির বয়স ৬২ বছর, পর্যায় প্রকৃতি বসন্ত ,স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রবাসী পত্রিকার ভাদ্র ১৩৩১ সংখ্যায় বধূমঙ্গল শিরোনামে প্রকাশিত।
তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, রচনা ৭ এপ্রিল ১৯১৪, রচনাস্থান শান্তিনিকেতন, কবির বয়স ৫২ বছর, পর্যায় পূজা গান, স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতিমাল্য কাব্যগ্রন্থের গান,সঞ্চয়িতায় সুরের আগুন শিরোনামে সংকলিত, কবিকৃত ইংরাজি অনুবাদ My heart is on fire with the flame of thy songs (POEMS)
মনে হল শব্দ যেন গলে গলে পরছে রং এর বাক্স থেকে । ধুসর কমলা রং দিব্য প্রজ্ঞা সরস্বতী হয়ে চিদাকাশ কে কৃপা করছেন । এত হৃদয় তন্ময় লেখা যে পাঠক অভিভূত না পারেন না । চেষ্টা প্রচেষ্টা কে
অভিনন্দন রইল ।
আমি রবীন্দ্র-দিকগজ নই । তবু বুঝতে পারি প্রতিক্ষণের ইতিহাস এবং তার ইতিহাস কি মরমি ভালবাসার আখরে রচিত থাকছে ।
আমি দুএক জন কে রীলে করেছি হয়তো তাঁরা রবীন্দ্র প্রেমে আরো ভাবুক হবেন । ঠিক জানিনা । আন্তরিক
নমস্কারন্তে ।
কলহন সান্যাল
7-11-2020
Apni sarthoknama.jebhabe rabikarke snigdho alor labonye amader madhye bilie dichhen ta to purnachandrer matoi.
Rabindranather lekha kobita o anka chhobir madhyeo amoni gatayat achhe.tar kathaao apner swadu lekhay akdin peye jabo asha kori.
Ar akta kotha, quiz er uttor debar samay moner bayas kome jay.tai aktaa uttor bhul hole utsaho jhimie pare.jodi sab sathik uttor ekebare sheshe deoa hoy tabe besh romanchokar utkanttha upobhog kora jay.ektu bhebe dekhben?namaskaar.
প্রাঞ্জল ভাষায় সুন্দর পটভূমিকা। রবীন্দ্র নিবেদিত প্রান আপনার। প্রতিনিয়ত রবীন্দ্র বিষয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করে চলেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
This article is actually a pleasant one it assists new the web viewers, who are wishing in favor of blogging. Dannie Niels Andres
আপনাকে আগেই জানিয়েছি আমার রাঁচি পর্বের অসিত হালদার প্রসংগ পূর্নতা পেল এই তথ্যটিতে। আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকলাম
আমার তথ্য আপনার লেখা / প্রবন্ধে স্বীকৃতি পেয়েছে, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। লেখাটির জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।