সখিসমিতি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আর একটি মিলনকেন্দ্র। এই সমিতি গঠনের পিছনে আছে একটি ছোট্ট ইতিহাস । বলা হয় তৎকালীন থিয়োসফিক্যাল আন্দোলনের হাত ধরেই এর শুরু। কর্নেল অলকট, মাদাম ব্লাভাটস্কি প্রমুখ কয়েকজন থিয়োসফিস্টের উদ্দ্যোগে ১২৮৯ সালে ৬ এপ্রিল দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জানকীনাথ ঘোষাল, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় কলকাতায় ‘বেঙ্গল থিয়োসফিক্যাল সোসাইটি’র (BTS) সূচনা হয়েছিল। সোসাইটির অধিবেশন বস্ত জানকীনাথ ঘোষালের কাশিয়াবাগানের বাড়িতে। সেই সূত্রে থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর পরিচয়। কিছুদিন পরে তিনি এটির মহিলা শাখার সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কয়েকবছর পরে সোসাইটির কাজে সদস্যদের উৎসাহে ভাঁটা পড়েছিল। তখন এই শাখার মহিলা সদস্যদের নিয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী ‘সখিসমিতি’ নামের একটি আলাদা সংগঠন গড়ে তুললেন। নামটি রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া।
সখিসমিতি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘কুমারী ও বিপন্না বিধবাদের’ বৃত্তি দিয়ে পড়ানো, পড়া সাঙ্গ হলে তাদের শিক্ষয়িত্রীরূপে বেতন দিয়ে অন্তঃপুর-মহিলাদের শিক্ষার জন্যে নিযুক্ত করা। এছাড়াও মফঃস্বলে ধর্ষিতা নারীদের জন্যে প্রয়োজন হলে উকিল ব্যারিস্টার নিযুক্ত করে মোকদ্দমা চালানো, বাঙলার বিভিন্ন জেলা থেকে শিল্প সংগ্রহ করে মেলা করা, তাতে মেয়েদের দ্বারা অভিনয় করানো প্রভৃতি নানা আয়োজনে ‘সখি-সমিতি’ খুব অল্পদিনেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
‘মহিলা শিল্পমেলা‘র আয়োজন সখিসমিতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্বর্ণকুমারী দেবী চেয়েছিলেন মেয়েদের হাতের কাজকে শুধুমাত্র ঘরের শোভাবর্ধনের কাজে না লাগিয়ে, তাকে ‘শিল্পের মূল্য’ দিয়ে সবার সামনে তুলে ধরতে। তাতে মহিলারা একদিকে যেমন নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন তেমনই আর্থিকভাবে তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন। এই উদ্দেশ্যেই স্বর্ণকুমারী দেবী মেলায় মহিলাদের হাতের তৈরি নানা ধরণের জিনিসপত্র প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১২৯৫ সালের ১৫ পৌষ, বেথুন স্কুলে।
সংবাদ প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘সখীগণ আপনাদের মধ্যে অতিরিক্ত চাঁদা তুলিয়া সেই অর্থ হইতে বৎসর বৎসর একটি মহিলা শিল্পমেলা খুলিবার প্রস্তাব করিয়াছেন । দেশীয় মহিলাদের ব্যবহারোপযোগী দ্রব্যাদি ও মহিলাগণ বিরচিত নানাবিধ শিল্পাদি এই মেলায় প্রদর্শিত ও বিক্রীত হইবে।…সমিতি আগামী মাঘ মাসে এই মেলা খুলিবার ইচ্ছা করেন।’
সখিসমিতির অন্যতম সদস্যা সরলা রায় রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের জন্য একটা নাটক লিখে দেবার আবদার করেছিলেন। তাঁরই অনুরোধে ১২৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘মায়ার খেলা গীতিনাট্য’। ১২৯৫ সাল পৌষ মাসে, বেথুন স্কুলে সখিসমিতির আয়োজনের মূল আকর্ষণ ছিল মায়ার খেলার অভিনয়। এই উপলক্ষে মেলা প্রাঙ্গণটিকে ফুল লতাপাতা দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছিল। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন, ‘আমাদের বাড়ির মেয়েরাই অভিনয় করেন । সখাদের বেশ ছিল খুব টকটকে রঙের সার্টিনের পাঞ্জাবি ও ধুতি তার সঙ্গে ঈষৎ গোঁফের রেখা।‘ সরলা দেবীর কথায়, ‘সেবার দাদা ও সুরেন স্টেজ ম্যানেজার ছিলেন। মায়াকুমারীদের মাথায় অলক্ষ্য তারে বিজলীর আলো জ্বালানো তাঁদের একটি বিশেষ কারিগরি ছিল। আর সবাই অতি ভয়ে ভয়ে ছিল—পাছে বিজলীর তার জ্বলে উঠে মায়াকুমারীদের shock লাগে !—মেলা সুন্দর করে সাজানো, স্টেজ বাঁধা, স্টল ঘেরা প্রভৃতি সব কাজেই দাদাদের ব্যাপৃত থাকতে হয়েছিল ক’দিন ধরে।’ সেদিনের মেলাটির উদ্বোধন করেছিলেন তদানীন্তন ছোটোলাট বেলীর পত্নী ‘লেডি বেলী’। উপস্থিত ছিলেন বড়লাট লর্ড ল্যান্সডাউনের পত্নীও। রবীন্দ্রনাথ ‘মায়ার খেলা’র সত্ব সখিসমিতিকে দান করেছেন। এবং এটি উৎসর্গ করেছেন সরলা রায়কে।
কেবলমাত্র মহিলাদের নিয়েই মঞ্চস্থ মায়ার খেলা নাটকের নাম ভুমিকায় ছিলেন সরলা দেবী, অভিজ্ঞা, প্রতিভা, ইন্দিরা, প্রিয়ম্বদা প্রমুখ ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাই। মঞ্চের সামনে প্রথম সারিতে বসে নাটক দেখা তখনকার কালের অন্তঃপুরবাসিনী মেয়েদের পক্ষে ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সখিসমিতি আয়োজিত প্রথম অনুষ্ঠানের আশাতীত সাফল্য সদস্যদের উজ্জিবিত করেছিল। মেলায় আয়োজন করা হয়েছিল স্কুলের মাঝখানের খোলা চত্বরে। ছোটো ছোটো সুসজ্জিত স্টলে নিজেদের হাতের কাজের নানা পশরা সাজিয়ে মহিলারা তাদের দোকান খুলেছিলেন। সেবার প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছিল, বিক্রিবাটাও হয়েছিল আশানুরূপ।
১২৯৫ সালের পর থেকে সখিসমিতির সদস্যরা প্রতিবছর মহিলা শিল্পমেলার আয়োজন করেছেন। ১২৯৮ শিল্পমেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল ১২৯০ সালে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে লেখা ‘বিবাহ উৎসব’ নাটিকার মঞ্চায়ণ। নাটকটি লেখা হয়েছিল হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে উপলক্ষে। ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিয়ের দিনেই সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের অকালমৃত্যুর খবর বাসরের আনন্দ-উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছিল। সেই আক্ষেপ পুরণ হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরী আর স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা যৌথ রচনা বিবাহ-উৎসবের মধ্য দিয়ে।
১৮৯২ সালের ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি, তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত মেলাটির Indian Mirror পত্রিকার বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল, The Fancy Fair will be opened by Lady Elliott on Tuesday, the 16th, and last till Thursday, the 18th instant, both days inclusive. Doors will be opened at 11 A.M. Stalls will be kept by Bengali ladies of some of the best families in Calcutta. Tickets of admission 8 annas. Children under 10 years, halfprice. Boys above 7 years of age will not be admitted. The Fair will close everyday at 4 P.M., after which there will be a short dramatic performance entirely by ladies. Box-seat Rs.3 each other seats Rs. 2 each.”
এর পরের শিল্পমেলার আসর বসেছিল ১৮৯৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর, এবারও সেই বেথুন স্কুল। তিনদিনের সেই মেলার উদ্বোধন করেছিলেন ভাইসরয় লর্ড এলগিনের পত্নী কাউণ্টেস অফ্ এলগিন। কিন্তু সেবার কোনো নাটক অভিনীত হয়েছিল কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
ধীরে ধীরে সখিসমিতির কাজকর্মে ভাঁটা পড়লে, স্বর্ণকুমারীর কন্যা হিরন্ময়ী দেবী সেটিকে ‘বিধবা শিল্পাশ্রম’-এ পরিণত করে, নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছিলেন। অন্তপুরবাসিনী মহিলাদের শিক্ষিত করে সামাজিক ও আর্থিক পুনর্বাসনে সখিসমিতি আয়োজিত শিল্পমেলাগুলির অবদানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
লেখক ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
আগামী সংখ্যায় জোড়াসাঁকো নাট্যশালা ও কমিটি অফ ফাইভ
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। আপনাকে যে পরিশ্রম করে এই কর্মকাণ্ড করতে হয় তা অনুধাবন করে বিস্মিত হই। ধন্যবাদ আপনাকে।