শুরুর কথা
সম্ভবত ১৮৯২ সালের মাঝামাঝি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দ্যোগে জোড়াসাঁকোতে ড্রামাটিক ক্লাব-এর সূচনা হয়েছিল। এর প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘গার্হস্থ্য নাট্যসমিতি’। রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ঠাকুরবাড়ির দশজন সদস্যকে নিয়ে একটা কমিটি গড়ে প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। মাসিক চাঁদা ছিল পাঁচ টাকা, কিন্তু এককালীন একশ টাকা দিলে ‘মুরুব্বি সভ্য’ হওয়া যেত। বৈঠকখানা বাড়ির অব্যবহৃত তোষাখানাটাই ছিল ড্রামাটিক ক্লাবের কার্যালয়। মূলত নানা ধরণের নাটকের অভিনয়ের জন্যই এই ক্লাবটির সূচনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোড়ায় ‘গলদ নাটক‘টি এখানেই প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল। এছাড়া জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু নাটক’টির অভিনয়ও এই ড্রামাটিক ক্লাবেই। অলিকবাবুতে অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, অরুনেন্দ্রনাথেরা। এই অভিনয়ের পরেই ড্রামাটিক ক্লাবের পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল। আসলে অলীকবাবু নাটক দেখে অনেকে অনুযোগ করেছিলেন যে ‘ছেলেরা সব বুড়োদের নকল করে তামাশা করছে’। রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে ড্রামাটিক ক্লাবটাই তুলে দিলেন। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তবে অনেক চাঁদার টাকা জমা রেখে গেল। এখন এই টাকাগুলো নিয়ে কী করা যাবে পরামর্শ হচ্ছে । আমি বললুম, কী আর হবে, ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ করা যাক — এই টাকা দিয়ে একটা ভোজ লাগাও । ধূমধামে ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ সুসম্পন্ন করা গেল। ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধে রীতিমত ভোজের ব্যবস্থা হল, হোটেলের খানা।’
ক্লাব গঠন
১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধবাসরেই খামখেয়ালি সভার যাত্রা শুরু। মুখ্যত রবীন্দ্রনাথের উৎসাহেই এই ক্লাবের পত্তন। ক্লাবের নামকরণও তাঁরই। প্রথম অধিবেশনের খসড়ায় লেখা ছিল, Dramatic Club এর শ্রাদ্ধ এবং / খামখেয়ালী অন্নপ্রাশন = তারিখ ২৪ মাঘ। ড্রামাটিক ক্লাবের হাঙ্গামার কারণে রবীন্দ্রনাথ এবার সদস্য নেওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন, ঠিক করলেন এবার বেছে বেছে গুটিকয়েক ‘খেয়ালী আর মজলিসি‘ সভ্যই নেওয়া হবে। অন্যেরা থাকবেন অভ্যাগত হিসাবে। সভার তেমন কোনো নিয়মকানুন ছিল না। শুরুতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে প্রত্যেক সভ্যের বাড়িতে মাসে একটা করে ‘খামখেয়ালি মজলিস’ বসবে। কবিতা কিম্বা গল্পপাঠ, ছোটোখোটো অভিনয় আর গানবাজনা করাই ছিল এই সভার আসল উদ্দেশ্য। খামখেয়ালি সভার প্রত্যেক অধিবেশনের কার্যবিবরণী বিস্তারিতভাবে লেখা থাকত একটা খসড়া খাতায়। সমস্যা হল অনেক সময় সেখানে মিটিঙের তারিখ বা দিনক্ষণ লেখা থাকত না। তবুও নানা সূত্র থেকে মোটামুটি গোটা পাঁচেক অধিবেশনের কথা জানা গিয়েছে।
নানা অধিবেশন
প্রথম দিনের অধিবেশন বসেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৈঠকখানা বাড়িতে। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিল রাধিকা গোস্বামীর গান, ‘বিনিপয়সার ভোজ’ নাটিকার আবৃত্তি আর জোড়াসাঁকোয় সদ্য কেনা ‘ফোনোগ্রাফ‘ যন্ত্রের প্রদর্শন। রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন তাঁর ‘কুহেলিকা’ গল্পটা। আর ছিল গান বাজনা, সঙ্গে ‘বাঙ্গালা জলপান’। ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নীরদনাথ মুখোপাধ্যায়, করুণাচন্দ্র সেন, শেষন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাস ও অন্যান্যরা।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এই খামখেয়ালীর যুগে আমাদের বেশ একটা আর্টের কাল্চার চলছিল। নিমন্ত্রণপত্রও বেশ মজার ছিল। একটা স্লেট ছিল, সেটা পরে দারোয়ানরা নিয়ে রামনাম লিখত। সেই স্লেটটিতে রবিকাকা প্রত্যেক বারে কবিতা লিখে দিতেন, সেইটি সভার সভ্য ও অভ্যাগতদের বাড়ি বাড়ি ঘুরত। ঐ ছিল খামখেয়ালীর নেমন্তন্নের পত্র।’
সভার দ্বিতীয় অধিবেশন বসেছিল আশুতোষ চৌধুরীর ধর্মতলার বাড়িতে। এই আসরে রবীন্দ্রনাথ শ্রোতাদের তাঁর সদ্য লেখা ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। আর ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নূতন অবতার’ কবিতার আবৃত্তি সাথে মনোমোহন ঘোষের স্বরচিত ইংরাজি কবিতা। ছিল যথারীতি গান বাজনা আর জলপান।
খামখেয়ালি সভার তৃতীয় অধিবেশনের আহ্বায়ক বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্থান জোড়াসাঁকো। এদিনের অনুষ্ঠান সূচিতে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মানভঞ্জন’ আর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প থেকে পাঠ, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবৃত্তি ‘অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি’ আর গোঁসাইজির গান। আহারের ব্যাপারটি ছিল অভিনব – ধূপধূনা রসুনচৌকি সহযোগে, তাকিয়া আশ্রয় করিয়া, রেশমবস্ত্রমণ্ডিত জলচৌকিতে জলপান।
বিশেষ অতিথি অতুলপ্রসাদ সেন অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘একটি দিনের কথা আমার খুব মনে আছে। সেবার বলেন্দ্রনাথের পালা। কবিবরের কবিতা ও অন্যান্যের রচনা পাঠ, সংগীত, হাসির গান ইত্যাদি খামখেয়ালীর উৎসবানন্দ সম্ভোগের পর স্বল্পভাষী ও বিনয়ী বলেন্দ্রনাথ আমাদিগকে আহারের জন্য অন্য একটি ঘরে লইয়া গেলেন। সে ঘরটি এমনভাবে পুষ্পপত্রে সুসজ্জিত ছিল যে মনে হইতেছিল নন্দনের ফুলকুঞ্জে প্রবেশ করিলাম। মাঝখানে দেখিলাম একটি জলাশয়, তার মাঝে মাঝে দু’একটি বনস্পতি, জলে রাজহংস, জলপদ্ম, সরসীর তটের চারিপার্শ্বে নবদুর্বাদল — সকলই প্রকৃতির অনুকারী। সেই কাচ-নির্মিত সরোবরের চারিপাশে নিমন্ত্রিতের বসিবার স্থান। প্রত্যেকটি আসনের সম্মুখে নানাপ্রকার খাদ্যসম্ভার, তাহাতেও বিচিত্র বর্ণবিন্যাস। আমরা যেই খাইতে বসিলাম অমনি কোন এক প্রচ্ছন্ন স্থান হইতে মৃদু-মধুর সানাই বাজিতে লাগিল। আর বাক্যশিল্পী, আলাপকুশলী, হাস্যরসিক রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, জগদীন্দ্র রায়, অর্দ্ধেন্দু মুস্তফী আমাদিগকে তখন এমন হাসাইতে লাগিলেন যে, সে আলোড়নে সুখ-খাদ্য কোথায় যে তলাইয়া যাইতে লাগিল বুঝিতে পারিতেছিলাম না । এরূপ নানাবিধ আনন্দের বিচিত্র সমাবেশ আমি কখনও সম্ভোগ করি নাই।’
সভার চতুর্থ অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, স্থান তাঁর ওল্ড পোষ্ট অফিস স্ট্রিটের চেম্বার। সেদিনের সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ‘গোড়ায় গলদ’ নাটক পাঠের পরে অভ্যাগতেরা ‘ফরাসে বসিয়া প্লেটপাত্রে মোগলাই খানা’ সহযোগে সান্ধ্য আড্ডার মশগুল হয়ে উঠেছিলেন।
খামখেয়ালি সভার সবচেয়ে জমকালো আসরটি বসেছিল ১৮৯৭ সালের ১৯ জুলাই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। প্রথা অনুযায়ী স্লেটে-লেখা আমন্ত্রণ পত্র দিয়ে সদস্যদের আহবান জানানো হয়েছিল। মজার আমন্ত্রণ পত্রটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখা।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পিতৃ স্মৃতিতে সেবারের অনুষ্ঠানের একটি অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। জানা গিয়েছে সেদিন বাড়িতে হুলুস্থুলু পড়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ফরমাশ অনুযায়ী মৃণালিনী দেবী রান্না করেছিলেন নতুন ধরণের নানা পদ । খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল জয়পুর থেকে আনা শ্বেতপাথরের থালায়। বাঁশবন, শ্যাওলাপড়া ডোবা, খড়ের ঘর, কৃষ্ণনগর থেকে আনা গরু ছাগল আর চাষাভূষো মানুষের মুর্তি দিয়ে নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর নৈশভোজের জায়গাটাকে একেবারে গ্রামীন পরিবেশের মত করে তুলেছিলেন।
সমাপ্তি
ধীরে ধীরে খামখেয়ালি সভার সদস্যদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ল। ১৮৯৭ সালের ৩১ জুলাই রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকোয় আর একটি অনুষ্ঠানের পরে সভার কাজকর্ম মোটামুটি গুটিয়ে ফেলা হয়েছিল।
সমৃদ্ধ হলাম। এই বিষয়ে এত বিস্তারিত তথ্যবহুল ধারণা ছিল না। ধন্যবাদ।