রবীন্দ্রনাথের স্কুলজীবন কখনোই সুখের হয় নি। কান্নাকাটি করে সত্যপ্রসাদ আর সোমেন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হলেও, স্কুলের মোহ প্রথমদিনেই ঘুচে গিয়েছিল। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন ‘ঘরগুলা নির্মম, ইহার দেয়ালগুলা পাহারাওয়ালার মত – ইহার মধ্যে বাড়ির ভাব কিছুই না, খোপওয়ালা একটা বড়ো বাক্স। কোথাও কোন সজ্জা নাই, রঙ নাই, ছেলেদের হৃদয়কে আকর্ষণ করিবার লেশমাত্র চেষ্টা নাই। ছেলেদের যে ভালোমন্দ লাগা বলিয়া একটা খুব মস্ত জিনিস আছে, বিদ্যালয় হইতে সে-চিন্তা একেবারে নিঃশেষে নির্বাসিত।’ সহপাঠীদের অশুচি আর অপমানজনক আচরণ, অধিকাংশ শিক্ষকদের কুৎসিত ভাষা আর নীরস পাঠ্য-বিষয় অচিরেই তাঁর মনে স্কুল সম্বন্ধে ভীতির সঞ্চার করেছিল। ১০ বছরের স্কুলজীবনে পাঁচবার স্কুল বদল করে অবশেষে তিনি ক্ষান্ত দিয়েছেন।
আসলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার ভিত গড়ে উঠেছিল বাড়ির পরিবেশে, গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। মূল কাণ্ডারী ছিলেন সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি স্বেচ্ছায় রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য ভাইদের, এমনকি ঠাকুরবাড়িতে নবাগত বালিকা গৃহবধূদের পড়াশোনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আর ছিলেন একাধিক গৃহশিক্ষক। তাঁদের কাছে পাঠের তালিম চলত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ছোটোবেলায় কী না শিখতে হয়েছে তাঁকে? বাংলা, ইংরাজি, ড্রয়িং, সংস্কৃত, চারুপাঠ, বাস্তুবিচার, গান, প্রাকৃত বিজ্ঞান, কুস্তি, জিমন্যাস্টিক, লাঠিখেলা আরও কতকিছু। সে ছিল এক বিরাট আয়োজন।
রবীন্দ্রনাথের দৈনিক পড়াশুনোর রুটিন ভোরে অন্ধকার থাকতে উঠে লেংটি পরে কানা পালোয়ানের সঙ্গে কুস্তি। মাটিমাখা শরীরের উপর জামা চাপিয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রের কাছে অস্থিবিদ্যা-শিক্ষা। সাতটা থেকে ন’টা নীলকমল ঘোষালের কাছে পদার্থবিদ্যা, মেঘনাদবধকাব্য, পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল পড়া। এরপর স্নান-খাওয়া সেরে ঘোড়ায় টানা ইস্কুলগাড়ি বা পালকি চেপে স্কুলে যাওয়া। সাড়ে চারটেয় স্কুল থেকে ফিরে জিমন্যাস্টিক শিক্ষা। এর পরেই ড্রয়িঙের ক্লাস। সন্ধ্যা থেকে রাত নটা পর্যন্ত অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ইংরেজি টিউশন। রাত্রি ন’টার পর ছুটি। এর সঙ্গে রবিবার বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে গান, সীতানাথ ঘোষের কাছে প্রাকৃত-বিজ্ঞান শিক্ষা নিতে হত।
এই পর্ব্ব আমি তাঁর বাল্য-কিশোর দিনগুলিতে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত শিক্ষাগুরুদের সান্নিধ্য পেয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রাখব।
প্রচলিত রীতি অনুযায়ী লেখাপড়ার জগতে আমাদের প্রবেশ সরস্বতী পূজার দিনে হাতেখড়ির মাধ্যমে। সেটা একটা উৎসবের মতই ব্যাপার। ঐ দিন ছোট্টো শিশুটির হাতে খড়ি বা চক ধরিয়ে, স্লেটে অ-আ-ক-খ লিখে শুরু হয় শিক্ষাযাত্রার, লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা শুরু হয়েছিল নিতান্ত অনাড়ম্বর ভাবে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদালানের পাঠশালায়, গৃহশিক্ষক মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়’এর হাতে। তখন তাঁর বয়স চারও হয়নি। ক’দিন আগে দু’বছরের বড়ো সোমেনদা আর ভাগ্নে সত্যদা যখন সেজেগুজে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ বিষম কান্না জুড়েছিলেন, সঙ্গে যাবার বায়নায়। সেটা যতটা না স্কুলের জন্য, তার চাইতে অনেক বেশী গাড়ি চড়ে বাড়ির বাইরে বেরোনোর বাসনায়। জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘যিনি আমার শিক্ষক ছিলেন তিনি আমার মোহ বিনাশ করিবার জন্য প্রবল চপেটাঘাতসহ এই সারগর্ভ কথাটি বলিয়াছিলেন ‘এখন স্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদিতেছ, না যাবার জন্য ইহার চেয়ে অনেক বেশী কাঁদিতে হইবে।’ এবং সেটা রবীন্দ্রনাথ হাড়েহাড়ে উপলব্ধির করেছিলেন নিজের জীবনে।
রবীন্দ্রনাথের আদি শিক্ষাগুরু মাধবচন্দ্রর বাড়ি বর্ধমান জেলায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথায় ‘তিনি একেবারে সেকেলে পণ্ডিতের জ্বলন্ত আদর্শ। রং কালো, গোঁপজোড়া কাঁচাপাকায় মিশ্রিত মুড়া-খংরারন্যায়।’ পাঠশালা বসত বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে। পাশের বাড়ির অনেক ছেলেও সেখানে পড়তে আসত। মাধবচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত নীরস আর কড়া মাস্টারমশাই। চকচকে বেতের লাঠি আর অকথ্য গালিগালাজই ছিল তাঁর ছেলে-পাড়ানোর হাতিয়ার। নিশ্চিতভাবে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের মনে ‘পণ্ডিত-ভীতি’র প্রথম বীজটি তিনিই রোপণ করেছিলেন। তাই ‘পুরনো বট’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘ওখানেতে পাঠশালা নেই, পণ্ডিতমশাই বেত হাতে নাইক বসে, মাধব গোঁসাই’।
মাধবচন্দ্রের পরে ১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসে ব্রজেন্দ্রনাথ রায় নামে আর একজন পণ্ডিত সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে কিছুদিন পড়িয়েছিলেন। সম্পর্কে তিনি সারদাসুন্দরী দেবীর ভাই, জোড়াসাঁকোর পারিবারিক হিসাবপত্র দেখাশোনা করতেন। তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
এরপর, ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেন নীলকমল ঘোষাল। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তখন নর্মাল স্কুলের একটি শিক্ষক, শ্রীযুক্ত নীলকমল ঘোষাল মহাশয় বাড়িতে আমাদের পড়াইতেন। তাঁহার শরীর ক্ষীণ শুষ্ক ও কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ ছিল। তাঁহাকে মানুষজন্মধারী একটি ছিপছিপে বেতের মতো বোধ হইত। সকাল ছটা হইতে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাভার তাঁহার উপর ছিল।’ নীলকমলবাবু মোটামুটি বছর চারেক রবীন্দ্রনাথের শিক্ষকতা করেছেন। প্রথমদিকে বেতন দশ টাকা হলেও পরে তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাঠ্যবই ছাড়াও তিনি পড়াতেন চারুপাঠ, বস্তুবিচার, প্রাণীবৃত্তান্ত, মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য। নীলকমল ঘোষালের পড়ানোর পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথের কাছে সুখকর ছিলনা। তাঁর কথায়, ‘যে-জিনিসটা পাতে পড়লে উপাদেয় সেইটাই মাথায় পড়লে গুরুতর হইয়া উঠিতে পারে।’ রবীন্দ্রনাথের দুঃখ করে বলেছেন, ‘তাঁর সময় ছিল ঘড়ি-ধরা নিরেট, এক মিনিটের তফাত হবার জো ছিল না।’ বর্ণকুমারী দেবীও ছিলেন নীলকমল মাষ্টারের ছাত্রী। কিন্তু ছেলেদের মত মেয়েদের নিয়মের কোনো কড়াকড়ি ছিল না।
নর্মাল স্কুলে কেবলমাত্র বাংলা ভাষাতেই পড়ানো হত। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করে ১৮৬৮ সালের জুলাই মাসে রাখালদাস দত্তকে মাসিক ছ’টাকা বেতনে ইংরাজি শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রনাথ প্যারীচরণ সরকারের First Book of Reading থেকে ইংরাজি বর্ণমালা আয়ত্ত করেছিলেন। ১৮৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মাসে রাখালদাসের কার্যকাল শেষ হলে নতুন শিক্ষক হিসাবে এলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, মার্চ মাসের ৫ তারিখে। অঘোরনাথ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাংলাশিক্ষা যখন বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে তখন আমরা ইংরেজি শিখিতে আরম্ভ করিয়াছি। আমাদের মাস্টার অঘোরবাবু মেডিকেল কলেজে পড়িতেন।’ অত্যন্ত মজবুত স্বাস্থের অধিকারী মেডিকেল কলেজের ছাত্র অঘোরনাথের কঠোর সময়ানুবর্তীতায় অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তাঁহার তিন ছাত্রের একান্ত মনের কামনাসত্ত্বেও একদিনও তাঁহাকে কামাই করিতে হয় নাই। এমন-কি বর্ষার সন্ধ্যায় মুষলধারে বৃষ্টিতে রাস্তায় একহাঁটু জল দাঁড়িয়েছে, মাস্টারমশায়ের আসবার সময় দু-চার মিনিট অতিক্রম করে গেছে, ‘বর্ষাসন্ধ্যার পুলকে মনের ভিতরটা কদম্বফুলের মতো রোমাঞ্চিত’ হয়ে উঠেছে, রাস্তার সম্মুখের বারান্দাটাতে চৌকি নিয়ে গলির মোড়ের দিকে ছাত্রের দল করুণদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ‘এমনসময় বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যেন হঠাৎ আছাড় খাইয়া হা হতোস্মি করিয়া পড়িয়া গেল। দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়াছে।’
অঘোরনাথবাবুর শিক্ষণ-পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। একে তো , তিনি সন্ধ্যার সময় পড়াতে আসতেন, তার উপরে মিটমিটে আলোয় যখন প্যারী সরকারের ফার্স্ট বুক পড়াতেন, সারাদিনের ক্লান্তির পরে সেই নীরস অধ্যয়ন বালক রবিকে ঘুমের জগতে টেনে নিয়ে যেত। অবশ্য ছাত্রদের পড়াশুনোর ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কখনও মুগ্ধভাবে ইংরাজি আবৃত্তি করে, কখনও মানুষের কণ্ঠনালীর কলাকৌশল ব্যাখ্যা করে, আবার কখনও বা মেডিকেল কলেজের ডিসেশকন রুমে নিয়ে গিয়ে তাদের প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি বালক রবির মনযোগ আকর্ষণ করতে পারেন নি। অঘোরবাবুর মাসিক বেতন দশ টাকা থেকে বেড়ে পরে পনের টাকা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ততদিনে পিতার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণ সেরে ফিরে এসেছেন নতুন অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে। এমনিতেই রবীন্দ্রনাথ স্কুল-বিমুখ, এবার নানা ছুতোয় স্কুলে যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলেন। ১৮৭৩ সালের ফাল্গুন মাসে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবর্তে ইংরাজি শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেন আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য। বেতন মাসিক পনের টাকা। অভিভাবকেরা এবার আর ভুল করেন নি। জ্ঞানচন্দ্র সন্ধ্যার বদলে সকাল বেলাতেই তাঁর ছাত্রদের পড়াতেন।
মাইনে করা মাস্টার ছাড়াও বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ, সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথও তিনটি বালকের পড়াশুনোর ভার নিয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘স্কুলে বালকেরা টেঁকিতে পারিল না। আমি দুই প্রহর হইতে ৪টা পর্যন্ত এবং পণ্ডিত (জ্ঞানচন্দ্র) সকালবেলায় তাহাদিগকে পড়াইতেছেন। তাহাদের স্কুল অপেক্ষা ভাল পড়া হইতেছে, তবে তাঁর উৎসাহ বেশিদিন বজায় ছিল না।’ দ্বিজেন্দ্রনাথ দুপুরবেলায় ছেলেদের অঙ্ক শেখাতেন। কিছুদিন পরে তিনি পড়ানোর দায়িত্ব ছেড়ে দিলে ‘দুপুরবেলায় ছেলেদের আটকে রাখবার জন্য’ গিরীশচন্দ্র মজুমদারকে ইংরাজি পড়াবার জন্য নিয়োগ করা হল। গিরীশচন্দ্র শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ মাত্র এই পাঁচ মাস ছেলেদের পড়িয়েছেন। তারও আগে উমাচরণ ঘোষ নামের একজন শিক্ষক কিছুদিন ‘সোমবাবুদিগের মাষ্টার’ হিসাবে কাজ করেছেন।
(আগামী সংখ্যায় )
খুব সুন্দরভাবে ক্রম অনুযায়ী জানতে পারছি। একটি printing mistake হয়ে গেছে। ‘..এরপর ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেন নীলকমল ঘোষাল।’
এটা ১৯৬৬ সাল হবে না। মনে হয় ১৮৬৬ সাল হবে।
ধন্যবাদ।
হ্যা, ১৮৬৬ র জায়গায় ১৯৬৬ হয়ে গিয়েছে। ভুলটা ধরিয়ে দেবার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।