অনিচ্ছার গান No ratings yet.

বয়স যখন কম ছিল, যখন স্বরযন্ত্রের অত্যাধিক অত্যাচারে তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়নি, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে নানা সভা এবং অনুষ্ঠানে জনতার আবেদনে গান গাইতে হত। বরং বলা যায় তাঁর গান শোনবার জন্যই বোধহয়  সেইসব সভায় ভীড় জমাতেন সমস্ত শ্রেণীর মানুষ। রবীন্দ্রনাথ সেটি জানতেন, তাই সবসময়ে তাঁর পকেটে থাকত একটা ছোট্টো গানের নোটবুক। গান গাইবার জন্য তাঁকে দুবার অনুরোধ করতে হত না। লুব্ধ শ্রোতাদের উপহার দিতে দ্বিধা করতেন না তাঁর কোকিল কণ্ঠের সুমধুর উদাত্ত গান। কিন্তু একবার তাঁকে এমন সভায় গান গাইবার আবেদন করা হয়েছিল, যেখানে তিনি যেতেই চান নি। গাইতে চান নি কিছু বিদেশী অনুকরণ-প্রিয়  মানুষের নিষ্ফল সভায়।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই। ঠাকুর পরিবারের অনেকেই ছিলেন কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারাও আবর্তিত হয়েছে জাতীয় কংগ্রেসের নানা কর্মকাণ্ড ও প্রস্তাবের সাথে সাথে। ১৮৮৫ সালের ২৫ ডিসেম্বরে বিডন স্কোয়ারে ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’এর প্রথম অধিবেশনের পর ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে (২৮-৩০ ডিসেম্বর) জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হলে ও টাউন হলে। এবারের সভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

কিন্তু এই অধিবেশনকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক তিক্ত ঘটনা ঘটেছিল। তখন কবির বয়স মাত্র ২৫ বছর, বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে উদীয়মান তরুণ। লিখে ফেলেছেন অসংখ্য গান-কবিতা। সর্বোপরি অসাধারণ তাঁর গানের গলা। যেকোনো অনুষ্ঠানে তাঁর গান শোনবার জন্য জনতা অধীর হয়ে থাকে।

সফল রাজনৈতিক মিলনমেলাকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্য আহ্বায়ক শ্রী তারকনাথ পালিত অংশগ্রহণকারী নেতাদের এক নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালেন নিজের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথকেও সেখানে উপস্থিত থেকে কয়েকটি গান করবার অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কোনো ইচ্ছা ছিলনা ঐ অনুষ্ঠানে যাবার। কারণ প্রসঙ্গে তিনি পরে লিখেছেন, ‘তখনকার দিনে আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের অঞ্জলি তোলা ছিল রাজপ্রাসাদের দুর্গম উচ্চ শিখর থেকে প্রসাদকণা বর্ষণের প্রত্যাশায়’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ না চাইলেও তারকনাথ একপ্রকার জোর করেই তাঁকে নিমরাজি করিয়েছিলেন। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত নরম মনের মানুষ, কারও অনুরোধ তিনি সহজে ফেরাতে পারতেন না।

যাইহোক নির্দিষ্ট দিনে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে গেলেন ভোজসভায়। সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য  ভাইয়েরাও নিমন্ত্রিত। তাঁরা ইচ্ছা করেই খাঁটি বাঙালিয়ানার ধুতিচাদর পরে গিয়েছিলেন। যথারীতি এই বেশভূষা বিদেশীভাবাপন্ন আমন্ত্রিত অথিতিদের উপহাসের খোরাক হয়ে উঠল। এরকমই ঘটবে অনুমান করে রবীন্দ্রনাথ সদ্যরচিত একটি গান নির্বাচন করে রেখেছিলেন সেখানে গাইবার জন্য। নৈশভোজনে পানাহার ও বক্তৃতার শেষে রবীন্দ্রনাথকে গাইতে অনুরোধ করা হলে সবাইকে স্তব্ধ করে তিনি গাইলেন ‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না |  এ কি শুধু হাসিখেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা’? যা হবার তাই হল। এই গান শুনে কারো মুখে কথা নেই। সকলেই নিজেদের বিবেকের কাছে লজ্জিত। ভাঙা পার্টির শেষে সবাই একে একে বিদায় নিলেন।

১৮৯৮ সালের ৩০ মে ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন  আশুতোষ চৌধুরী, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, গগনেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ এবং আরো কয়েকজন। অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘The first day proceedings were opened punctually at 2 O’clock on Monday. Babu Rabindranath Tagore, the sweet singer, as the president called him later on, singing a national anthem in Bengali’. কোন গান ছিল সেটি? সভায় উপস্থিত কবি ও সমালোচক গোপালচন্দ্র রায় ‘রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’ পত্রিকায় উল্লেখ করেছেন গানটি ‘কড়ি ও কোমল’এর অন্তর্ভুক্ত ‘আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না’। অবশ্য প্রতিবেদনটির সত্যতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ গানের কথার ও ভাবটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এটি একটি নেতিবাচক গান ।  কোনো  সভার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এই ধরণের গান রবীন্দ্রনাথের পক্ষে গাওয়া বোধহয় সম্ভব ছিল না।

তবে আলোচ্য গানটি রবীন্দ্রনাথকে আরো একটি অনুষ্ঠানে গাইতে দেখা গিয়েছিল। ১৯০৪ সালের ৩০ মার্চ কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ নামের দীর্ঘ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। তারপরে ‘আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না’ গানটি গেয়ে ছাত্র  এবং শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবি দীনেশচরণ বসুর (১৮৫১-১৮৯৮) প্রথম পরিচয় ১৮৮৬ সালের ২৭ এপ্রিল। প্রথম আলাপেই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমায় বোলো না গাহিতে গানটি শোনবার সৌভাগ্য হয়েছিল দীনেশচরণের। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘দোতলার সিঁড়ির মুখেই রবিঠাকুরের সহিত সাক্ষাৎ হইল।  দেহচ্ছন্দ সুদীর্ঘ, বর্ণ বিশুদ্ধ গৌর, মুখাকৃতি দীর্ঘ, নাসা চক্ষু ভ্রু সমস্তই সুন্দর, যেন তুলিতে আঁকা।  গুচ্ছে গুচ্ছে কয়েকটি কেশতরঙ্গ স্কন্ধের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। পরিধান ধুতি। সাহিত্য সম্বন্ধে বহুক্ষণ আলাপ হইল। স্বর অতি কোমল ও সুমিষ্ট, রমণীজনোচিত। রবি ঠাকুরের গানের কথা শুনিয়াছিলাম কিন্তু গান শুনি নাই। তাঁহাকে গান গাহিতে অনুরোধ করা হইলে সাধাসাধি নাই, বনবিহঙ্গের ন্যায় স্বাধীন উন্মুক্ত কণ্ঠে অমনি গান ধরিলেন। গানটি এই ‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো  না

অন্যান্য তথ্য | রচনা ১৭ নভেম্বর ১৮৮৬ | রচনাস্থান কলকাতা | কবির বয়স ২৫ বছর | পর্যায় স্বদেশ | স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী | কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের ‘বঙ্গবাসীর প্রতি’ শিরোনামের কবিতা। | সাধনা পত্রিকার আষাঢ় ১৩০০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল

Please rate this

Join the Conversation

8 Comments

  1. কাকু অসাধারন সব তথ্য , রহস্য উপন্যাসের মতো , খুব ভালো লাগছে, প্রণাম নেবেন

    1. আমার মনে হয় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে বিনা শ্রমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেই চলেছি স্বার্থপরের মত। আপনাকে ধন্যবাদ ও প্রণাম জানাই।

  2. সাবলীল উপস্থাপনায় মূল‍্যবান তথ‍্য। প্রতিবারের মত এবারেও বলি – সমৃদ্ধ হলাম। ধন‍্যবাদ আপনাকে।
    প্রতি শনিবার আপনার ব্লগের জন‍্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি।

  3. আপনার এই তথ্য সমন্বিত আলোচনা যেমন সুন্দর তেমনি উপযোগী।আরো লিখুন আর মানুষের দরবারে পৌঁছে দিন।

  4. সমৃদ্ধ হলাম। আরো জানার জন্য প্রতীক্ষায় রইলাম।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *