পরপর পাঁচটা স্কুল বদলিয়েও যখন মন বসানো গেল না তখন অভিভাবকরা রবিকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠাবার তোড়জোড় শুরু করলেন। ব্যারিস্টারি ছিল সেকালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পেশা। অভিভাব্কেরা ভেবেছিলেন, একদম মুর্খ হয়ে থাকবার চাইতে ব্যারিস্টারি পাশ করলে, কিছু উপার্জন করে অন্তত নিজের জীবনটা চালাতে পারবেন দেবেন্দ্রনাথের ছোটো ছেলে রবি। তাঁরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি সেই রবি একদিন বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে তোলপাড় ফেলে দেবেন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সবে সতের বছর। বাইরের জগত সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতাই তৈরি হয় নি, কেবলমাত্র একবার পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণ ছাড়া। । কিন্তু বিলেতে গিয়ে নতুন পরিবেশে অপরিচিত মানুষের ভীড়ে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্য কিছু প্রস্তুতির তো দরকার। মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন (১৮৭৮) আমেদাবাদে অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর হিসাবে কর্মরত। ঠিক হল রবীন্দ্রানাথকে আমেদাবাদে সত্যেন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ইংরাজিতে কথা বলা আর আদবকায়দা শেখবার জন্য। ১৮৭৮ সালের ১৫ মে রবীন্দ্রনাথ আমেদাবাদে পৌঁছান মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে। আমেদাবাদ রবীন্দ্রনাথের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শাহিবাগে সত্যেন্দ্রনাথের প্রাসাদের মত বিরাট বাড়ির ছাদে শুক্লপক্ষের গভীর রাত্রে একলা ঘুরে বেড়াবার সময়ে রচনা করেছেন একাধিক কবিতা ও গান।
![](https://purnendurrabi.com/wp-content/uploads/2020/11/13a-1.jpg)
সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ডাঃ আত্নারাম পাণ্ডুরঙ উদার আধুনিক-মনষ্ক উদ্যমী পুরুষ। তিনি বোম্বাই অঞ্চলের ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। পাণ্ডুরঙ তাঁর তিন মেয়েকে ইংল্যাণ্ড থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও ঝকঝকে করে এনেছিলেন। আগস্ট মাসে সত্যেন্দ্রনাথ রবিকে বোম্বাইতে ডাঃ আত্নারামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর মেয়েদের কাছ থেকে আরও ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিতে।
আত্নারাম পাণ্ডুরঙ-এর বড় মেয়ে আনা তড়খড়-এর উপরে ভার পড়ল রবীন্দ্রনাথকে বিলেত যাত্রার উপযোগী করে তোলবার জন্য। আন্না রবীন্দ্রনাথের চাইতে বয়সে কিছু বড়, সুন্দরী এবং সপ্রতিভ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মেলামেশা, তাঁকে ইংরাজিতে কথা বলা বা আদবকায়দা শেখানোর ক্ষেত্রে তার কোনো জড়তা ছিল না। কিন্তু প্রথম যৌবনের সন্ধিক্ষণের সুঠাম সুপুরুষ রবির প্রতি তাঁর কিশোরী মনে কিছু ভালোলাগার স্পন্দন উঠেছিল। আন্না রবীন্দ্রনাথকে ইংরাজি শেখাতেন, কবি আন্নাকে শোনাতেন বাংলা কাব্য। বয়সে কিছুটা বড়ো হলেও আন্নার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একবার আন্না কবির কাছে আবদার করলেন তার জন্য একটা ডাকনাম জোগাতে। রবীন্দ্রনাথ নাম রাখলেন ‘নলিনী’, যা তিনি পরবর্বতীকালে ব্যবহার করেছেন তাঁর বহু কবিতা নাটক আর গানে ।
![](https://purnendurrabi.com/wp-content/uploads/2020/11/Anna.jpg)
‘ছেলেবেলা’য় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এখানে (আমেদাবাদে) কিছুদিন থাকার পর মেজদাদা মনে করলেন, বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিতে পারলে হয়ত ঘরছাড়া মন আরাম পাবে। ইংরাজি ভাষা শেখবারও সেই হবে সহজ উপায়। তাই কিছুদিনের জন্য বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্তঘরে আমি বাসা নিয়েছিলুম। সেই বাড়ির কোনো-একটি পড়াশুনোওয়ালা মেয়েকে ঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন, তাঁর শিক্ষা বিলেত থেকে। আমার বিদ্যে সামান্যই, আমাকে হেলা করলে দোষ দেওয়া যেত না। তা করেন নি। পুঁথিগত বিদ্যা ফলাবার মত পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধা পেলেই জানিয়ে দিতুম যে কবিতা লেখবার হত আমার আছে। আদর আদায় করবার ঐ ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো মূলধন। যাঁর কাছে নিজের এই কবিয়ানার জানান দিয়েছিলাম তিনি মেপেজুখে নেন নি। কবির কাছে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম জুগিয়ে – সেটা ভালো লাগল তাঁর কানে। ইচ্ছে করেছিলেম সেই নামটা আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে। বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাঁথুনিতে; শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে; বললেন, ‘কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় আমার মরণদিন থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি’।
রবীন্দ্রনাথ আন্নাকে যে ডাক-নামটি দিয়েছিলেন সেটি ‘নলিনী’। এই নামটি রবীন্দ্রনাথের এতই প্রিয় ছিল যে, তাঁর কৈশোর-তরুণ জীবনে লেখা বহু কাব্য,কবিতা, নাটকে তিনি এটি বারবার ব্যবহার করেছেন। আর যে ‘কবিতার ছন্দের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন সেটিই আমাদের আলোচ্য গান ‘শুন নলিনী খোলো গো আঁখি’। কবিতাটি শৈশব সংগীত (১২৯১) কাব্যগ্রন্থের প্রভাতী শিরোনামে সংকলিত। পরে সুরসংযোগের সময়ে কবিতার ১০ থেকে ১৭তম বর্জন করা হয়েছিল।
![](https://purnendurrabi.com/wp-content/uploads/2020/11/13b.jpg)
আর একদিন আন্না রবীন্দ্রনাথকে বললেন, ‘তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে’। এই অনুরোধের মধ্যেই ধরা পড়েছে আন্নার অন্তরের গভীর প্রেমের রূপটি। একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। একদিন আন্না কবিকে বললেন, ‘জানো, কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাবার’। এই বলে সে চেয়ারে নেতিয়ে পড়ল, যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সুযোগ এবং প্ররোচনা সত্বেও নিজের সংযম হারান নি। বেচারা আন্না ছদ্মঘুম থেকে উঠে দেখল কেউ তার দস্তানা চুরি করে নি। এই ঘটনা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ‘আমি স্বপনে রয়েছি ভোর, সখী আমারে জাগায়ো না’ গানটি রচনা করেছিলেন, যার মধ্য দিয়ে তরুণী আন্নার মর্মবেদনা ভাষায় রূপ পেয়েছে।
![](https://purnendurrabi.com/wp-content/uploads/2020/11/13e.jpg)
আন্না নানাভাবে কবিকে প্ররোচিত করতে চেষ্টা করতেন। একবার এক চাঁদনি রাতে রবি উদাস হয়ে ভাবছেন জোড়াসাঁকো বাড়ির কথা, সেখানকার লোকজনের কথা, কিছুই ভালো লাগছে না তাঁর। এমন সময়ে আন্না এসে তাঁর খাটের উপরে বসে পড়লেন। বললেন, ‘আচ্ছা আমার হাত ধরে টানো তো – টাগ অফ ওয়ারে দেখি কে জেতে? এর পরের দৃশ্যটা রবীন্দ্রনাথের বয়ানেই শোনা যাক। ‘আমি সত্যই ধরতে পারি নি, কেন হঠাৎ তার এতরকম খেলা থাকতে টাগ অফ ওয়ারের কথাই মনে পড়ে গেল। এমন কি আমি এ শক্তি পরীক্ষায় সম্মত হতে না হতে সে হঠাৎ শ্লথভাবে হারমানা সত্বেও আমার না হল পুলক-রোমাঞ্চ না খুলল রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি। এতে সে নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ রকম সন্দিহান হয়ে পড়েছিল’।
পরবর্তীকালে (১ জানুয়ারি ১৯২৭) এক আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি আন্নার আসক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো ক’রেই সে ঘুরত আমার আঁনাচেকানাচে। – একথা আমি মানব যে আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মত একটা কিছু ঘটেছে, কিন্তু হায় রে, সে-হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না কোনোরকম তৎপরতা না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব‘। আন্না তড়খড়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাত-সম্পর্ক মাত্র একমাস বা তার সামান্য কিছু বেশি। কিন্তু এঁর স্মৃতি কবির মনে অম্লান হয়ে ছিল বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত। আন্নার প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। তিনি স্বীকার করেছেন, ‘জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন-মানুষের দূতী, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড়ো করে দিয়ে যায়। না ডাকতেই আসে, শেষ কালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায় না’। (ছেলেবেলা) ।
![](https://purnendurrabi.com/wp-content/uploads/2020/11/13c.jpg)
![](https://purnendurrabi.com/wp-content/uploads/2020/11/Red-Bar-2.jpg)
শুন নলিনী খোল গো আঁখি রচনা ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দ | রচনাস্থান আমেদাবাদ অথবা বোম্বাই | কবির বয়স ১৭ বছর | পর্যায় প্রেম ও প্রকৃতি স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী
আমি স্বপনে রয়েছি ভোর প্রকাশ ১৮৭৮ সালে প্রথম বিলেত যাত্রার প্রাক্কালে | রচনাস্থান বোম্বাই | কবির বয়স ১৭ বছর | পর্যায় প্রেম ও প্রকৃতি | স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী | শৈশব সঙ্গীত কাব্যগ্রন্থের এই গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নময়ী নাটকে (চৈত্র ১২৮৮) ব্যবহৃত হয়েছিল।
![](https://purnendurrabi.com/wp-content/uploads/2020/11/Red-Bar-3.jpg)
বাহ।সুন্দর লেখা।সুন্দরভাবে ওই পর্বের বর্ণনা।আপনার সব লেখাগুলিই ভালো লাগে।
ধন্যবাদ।
সুমিষ্ট বাল্য কথা যা প্রায় সবার জীবনের হারানো সুর ।
শুভ দীপাবলির ভালবাসা সবার জন্য এই
আটাত্তুরে বুড়োর থেকে ।
ছায়া পথে মিশিয়ে যাওয়ার আগে
খুব মধু পান করছি ।
ধন্যবাদ মহান ডাক্তার বাবু
কলহন সান্যাল
বালক দীপাবলি দিবস
14 নভেম্বর 2020
আপনার কথার মধ্যে এক অদ্ভুত আন্তরিকতা থাকে যে মন ভালো হয়ে যায়, কাজের উৎসাহ বেড়ে যায়। এটাও ঠিক এধরণের লেখা আমাদের কৈশোরের দিনগুলির কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
আপনার মত একজন পাঠকও থাকলে ব্লগ লেখা সার্তক হয়। অনেক ধন্যবাদ।
আপনার কথা কিছু জানতাম, কিন্তু পড়ে দেখলাম কিছুই জানতাম না!! খুব ভালো লাগলো। এই লেখাটি দিয়েই আমার মাত্রা শুরু করলাম।
চরৈবেতি।
প্রাণমন ভরে গেল আপনার পরিবেশনার গুণে। কোন কিশোর বয়সের কৈশোরিকা প্রিয়ার আয়ত চোখের দৃষ্টি বহু যুগের ওপার হ’তে মনে এল। লেখার সঙ্গে একাত্ম হলে এইরকমই হয়। সুন্দর!
ধন্যবাদ আপনাকে।
It’s sheer bliss knowing so many unknown facts of a person who made us GLOBAL . Excellent efforts. COMMENDABLE. Looking forward to more such SPLENDID jobs.
Thank you.