বাল্মীকিপ্রতিভা আর কালমৃগয়ার সাফল্যের পরে ২৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন আর একটি অনবদ্য গীতিনাট্য মায়ার খেলা (প্রকাশ অগ্রহায়ণ ১২৯৫)। ওই বছরেই ১৫ পৌষ বেথুন স্কুলে প্রথম অভিনয়েই মায়ার খেলা দর্শকদের মনোহরণ করেছিল। আর এই গীতিনাট্যের ‘অলি বার বার ফিরে যায়’ গানটির জন্য রবীন্দ্রনাথ ইংলণ্ডে গায়ক হিসাবে প্রচুর খ্যাতি ও প্রশংসা লাভ করেছিলেন। প্রথমবার ইংলণ্ড ভ্রমণের সময়ে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি ঘরোয়া আসরে গান গাইলেও তা শ্রোতাদের কাছে তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপের কারণ হয়েছিল। কিন্তু ১৮৯০ সালের আবার যখন ইংলণ্ডে গিয়েছিলেন তখন সেই অবজ্ঞার ষোলোআনা শোধ তুলেছিলেন তিনি।
১৮৯০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর লণ্ডনে পৌঁছালে হোটেলে জায়গা না পেয়ে রবীন্দ্রনাথ Miss Mull নামে একজন ধণী ও সংগীতরসজ্ঞা মহিলার আতিথ্য গ্রহণ করেন। এই মহিলার কথা রবীন্দ্রনাথ আগেই শুনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ঐশ্বরিক সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব আর গানের মোহে Miss Mull ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের অনুরাগিণী হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলায় বসত গানের আসর। রবীন্দ্রনাথের গলায় আলি বার বার ফিরে যায় গানটি তাঁকে এতই মোহিত করেছিল যে বারবার শুনেও Miss Mull এর যেন তৃপ্তি হত না। Miss Mull নিজেও মন্দ গাইতেন না। একদিন লোকেন পালিতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ National Gallery দেখতে গিয়েছিলেন। ফিরে আসবার পরে Miss Mull অভিমান করে বললেন ‘কেন তুমি সারাদিন বাইরে কাটালে। ঘরে থাকলে আমরা বেশ গানবাজনা নিয়ে থাকতে পারতুম’।
Miss Mull ছাড়াও ইংলণ্ড-সমাজের আরও নানা জায়গায় গান গেয়ে রবীন্দ্রনাথ তারিফ পেয়েছেন। যেমন একদিন গিয়েছিলেন Miss Oswald -এর বাড়িতে। সেখানে অনেক বাংলা গানের সাথে অলি বার বার গেয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আবার যেদিন Brand এর বোনেদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন সেদিনও অলি বার বার গানটি তাদের খুব ভালো লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন তারা খুব চমৎকার harp আর পিয়ানো বাজায়। কিন্তু এইসব জায়গায় গান গেয়ে বাড়ি ফিরে আসবার পরে Miss Mull কবিকে আবার টেনে আনতেন সান্ধ্য গানের আসরে। সেখানে নানা গানের সাথে রবীন্দ্রনাথকে আবার গাইতে হত অলি বারবার ফিরে যায়। আসলে রবীন্দ্রনাথের উপর Miss Mull এর একটি সূক্ষ্ম অধিকারবোধ তৈরি হয়েছিল, হয়ত কিছুটা প্রণয়ও। শ্রী প্রশান্ত পাল তাঁর রবিজীবনীতে লিখেছেন, –ইনিও একজন রবি-অনুরাগিণীতে পরিণত হন, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে সম্ভবত flirtation-এর উর্ধে ওঠেনি।
স্বদেশে ফিরবার সময়ে জাহাজেও গায়ক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ অজস্র সাধুবাদ পেয়েছেন। জাহাজের কনসার্টে গেয়েছেন নানা ধরনের গান যার মধ্যে অন্যতম ছিল অলি বারবার ফিরে যায়। অনেক মেয়ে যেচে আলাপ করে বলেছেন, I say, Tagore, you sang awfully this evening কিম্বা It is a treat to hear you sing. এইভাবে অসাধারণ কন্ঠস্বর আর কিছু গান রবীন্দ্রনাথকে বিদেশের মাটিতে সুগায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
১৯১২ সালে লণ্ডনের অ্যালবার্ট হলে রবীন্দ্রনাথের দালিয়া গল্পের ইংরাজি অনুবাদ The Maharani of Arakan-এর অভিনয় হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথের করা অলি বার বার ফিরে যায় গানের ইংরাজি অনুবাদ The bee is to come and the bee is to hum আমিনার গান হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
অন্যান্য তথ্য | প্রকাশ অগ্রহায়ণ ১২৯৫ | রচনাস্থান দার্জিলিং- পার্কস্ট্রিট | কবির বয়স ২৭ বছর | স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী
পৌষ ১৩৪৫-এ রবীন্দ্রনাথ (৭৭ বছর বয়স) মায়ার খেলা গীতিনাট্যের সঙ্গে কয়েকটি নতুন গান যোগ করে এটিকে নৃত্যনাট্যে রূপান্তরিত করেছিলেন।
লেখাটি ভালো লাগলে Comment Box এ একটি মন্তব্য লিখলে উপকৃত হব। – পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার
খুব ভালো লাগলো। তথ্যগুলো এত সুন্দর ভাবে গুছিয়ে লিখেছেন,যে বার বার পড়তে ইচ্ছে করছে।
হ্যাঁ,গীতিনাট্য মায়ার খেলার ৫০ বছর বাদে কবির নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা লিখবেন।তাতে আরও ১৩ টা মতো নতুন গান যোগ হবে পুরানো গানের সাথে।
Dada…notun vabe janlam atit ke. Khuuuub valo laglo. Shonibarer blog…quiz. .gan er apekhhay thaki sara saptaho dhore. Dhonyobad dada
ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগলো। পড়েও জেনেও সেগুলি আবার ভুলে যায় চর্চার অভাবে। আপানার ব্লগের কল্যাণে আবার মনে হয় যেন নতুন করে জানলাম। আমরা যারা রবীন্দ্রনাথকে অন্তরে লালন করি তারা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি শনিবারের জন্য। আমরা কেবল রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসি । তিনি আমাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তেমন কিছুই তো করতে পারি না, বলা ভালো, করি না। আপনি যেন এই কাজকে আপনার ব্রত হিসাবে নিয়েছেন। নইলে একজন ব্যস্ত চিকিৎসক হয়েও এই ব্লগের জন্য আপনি যে কি পরিমান সময় ব্যয় করেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে কাজগুলি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে করে চলেছেন সেগুলি যে কত মূল্যবান তা সময় একদিন বলবে। অনুগ্রহ করে এটিকে আমার প্রশস্তি ভাববেন না। এ আমার আন্তরিক অনুভূতির প্রকাশ মাত্র। ভালো থাকুন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। প্রশস্তি নয়, আপনার এই অনুভূতি আমাকে উৎসাহ যোগাবে।
দাদা অনেক ধন্যবাদ ; সমৃদ্ধ হলাম ।কতবার যে মায়ার খেলা নৃত্যনাট্য করেছি কৈশোরে ;আজ আবার নতূন করে আরো ভালবেসে গেয়ে উঠলাম “অলি বারবার ফিরে যায়”……..
সত্যি, সবই যেন চিরনতুন।
আগে পড়েছিলাম,আবার পড়লাম। খুব ভালো লাগল।
আপনার রবীন্দ্রপ্রীতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। দৈনন্দিন খুঁটিনাটিতে যেভাবে তাঁর সমগ্র পরিচয় উদঘাটন করে চলেছেন, তা খুবই উপভোগ্য।
আপনাকে পরম প্রীতি জানাই।
ধন্যবাদ জানাই। পাঠকের সাথে সাথে আমিও সমৃদ্ধ হচ্ছি প্রতিদিন।
ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই । বহু তথ্য পরিবেষণ করেছেন । তথ্যের উৎসগুলি পাদটীকা হিসেবে সংযুক্ত করলে পাঠকেরা সে-বইগুলি পড়ে নিজেদের জ্ঞানের সীমানা বাড়াতে পারবেন, এবং সেই সূত্রে দেশে রবীন্দ্রচর্চাও আরও বিস্তৃতি পাবে । রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে কতো দরকারি বই আছে, তার খোঁজই তো আমরা রাখি না ।
রবীন্দ্রনাথ প্রথমবারে সম্ভবত ধ্রুপদাঙ্গের গান গেয়ে থাকবেন, কারণ তাঁর ধ্রুপদের শিক্ষাই ছিল । ইওরোপীয়রা ও-ধরনের গানের মর্মার্থ গ্রহণ করতে পারত না । স্বয়ং ম্যাক্স ম্যুলার দ্বারকানাথের মুখে ধ্রুপদ শুনে তা নিতান্ত অসাঙ্গীতিক ঠাউরেছিলেন । অবশ্য দ্বারকানাথ তাঁকে আগেই সে-ব্যাপারে সাবধান করে দিয়ে তবে গান শুনিয়েছিলেন ।
শনিবারের ব্লগটি পড়বার ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মন্তব্য করবার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আগামী পোষ্টগুলি থেকেই তথ্যসূত্রের উল্লেখ থাকবে। এটি অবশ্যই পাঠকের পক্ষে সহায়ক হবে।
শনিবারের ব্লগের কথা আপনার সমমনষ্ক বন্ধুদের জানালে ভালো লাগবে।