একটি স্বর্গীয় নির্দেশ
উদ্দোগী শিল্পপতি, সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম সফল পুরুষ দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্যবসা বাণিজ্য এবং সম্পদ সৃষ্টিতে সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পাঁচ পুত্রের কেউই এই সম্পদ ধরে রাখা বা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেন নি। দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ কিছুদিন হিন্দু কলেজে পড়াশুনা করলেও পিতার নির্দেশে কিশোর বয়সেই ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতুল পারিবারিক বৈভবের আবহে তাঁর দিন কাটত জাগতিক স্ফুর্তি আর বিলাসব্যসনে। দেবেন্দ্রনাথের ছেলেবেলার দিনগুলিতে ধর্মপরায়ণা পিতামহী অলকাসুন্দরীর স্নেহ তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু ১৮৩৮ সালে অলকাসুন্দরী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছালে বৈদ্যরা বিধান দিলেন ‘এঁকে অর্ন্তজলি যাত্রায় পাঠাতে হবে’। তখনকার সামাজিক অনুশাসন অনুযায়ী কোনো হিন্দু মরণাপন্ন হলে তাকে গঙ্গাতীরে ফেলে রাখা হত, যতক্ষণ না তার জীবনদীপ চিরতরে নিভে যায়। দ্বারকানাথ তখন দেশের বাইরে থাকায় দেবেন্দ্রনাথকেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। পিতামহীর অর্ন্তজলি যাত্রার দিনগুলিতে দেবেন্দ্রনাথ তিন রাত্রি গঙ্গাতীরের খোলার ঝুপড়িতে তাঁর পাশে বসেছিলেন, যথাসম্ভব সেবা করেছেন আর নিজের চোখে দেখেছেন এক প্রিয়জনের অসহায় মৃত্যুযন্ত্রণা।
এই মৃত্যুদর্শন একুশ বছরের বিলাসমগ্ন দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাজগতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, সম্পূর্ণ ভাবে বদলিয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনদর্শন । পিতামহীর মৃত্যুতে দেবেন্দ্রনাথ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘দিদিমার মৃত্যুর পূৰ্ব্বদিন রাত্রিতে আমি ঐ চালার নিকটবর্তী নিমতলার ঘাটে একখানা চাঁচের উপর বসিয়া আছি।…এই অবসরে হঠাৎ আমার মনে এক আশ্চর্য উদাস ভাব উপস্থিত হইল। আমি যেন আর পূৰ্বের মানুষ নই। ঐশ্বর্য্যের উপর একেবারে বিরাগ জন্মিল। যে চাঁচের উপর বসিয়া আছি, তাহাই আমার পক্ষে ঠিক বোধ হইল; গালিচা দুলিচা সকল হেয় বোধ হইল; মনের মধ্যে এই অভূতপূৰ্ব্ব আনন্দ উপস্থিত হইল। পরে, দিদিমার মৃত্যুর পূর্বদিন রাত্রে যেরূপ আনন্দ পাইয়াছিলাম, তাহা পাইবার জন্য আবার চেষ্টা হইল। কিন্তু তাহা আর পাইলাম না। এই সময়ে আমার মনে কেবলই ঔদাস্য আর বিষাদ। সেই রাত্রিতে ঔদাস্যের সহিত আনন্দ পাইয়াছিলাম, এখন সেই আনন্দের অভাবে ঘন বিষাদ আসিয়া আমার মনকে আচ্ছন্ন করিল। কিরূপে আবার সেই আনন্দ পাইব, তাহার জন্য মনে বড়ই ব্যাকুলতা জন্মিল। আর কিছুই ভাল লাগে না…
এরপর দেবেন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক চর্চার দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৮৪৫ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে পিতা দ্বারকানাথের ইংলণ্ডে মৃত্যু (১৮৪৫), তাঁর ইউনিয়ান ব্যাঙ্কের পতন, বিপুল আর্থিক দেনা, পাওনাদারদের তাগাদা ইত্যাদিতে তাঁকে বিড়ম্বিত হতে হয়েছে। দ্বারকানাথের বিরাট ব্যাবসা-সাম্রাজ্যের হাল ধরবার মত যোগ্যতা না থাকলেও দেবেন্দ্রনাথ জমিদারির আয়তন বৃদ্ধিতে সফল হয়েছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নানা মামলা-মোকদ্দমা, পরিবারের আর্ন্তকলহ, ইত্যাদি। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ভ্রমণপিপাসু মানুষ। সংসারের আবর্ত থেকে তিনি প্রায়ই বেরিয়ে পড়তেন ঈশ্বরের সন্ধানে। আর হিমালয়ই ছিল তাঁর মনের শান্তির আশ্রয়। আপাত সংসার বৈরাগী হলেও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রাশ ছিল দেবেন্দ্রনাথেরই হাতে। সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটির দিকে তাঁর ছিল কড়া নজর। পরিবারের কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত তাঁর পরামর্শ বা অনুমতি ছাড়া হওয়া সম্ভব ছিল না।
১৮৫৬ সালের অক্টোবর মাসের তিন তারিখে দেবেন্দ্রনাথ চিরতরে সংসার ত্যাগ করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে, নিজের একান্ত সেবক কিশোরীকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়লেন । ইচ্ছা হিমালয়ের উচ্চতম স্তরে পৌঁছে ঈশ্বরের সাধনায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আর আমি লোকেদের সঙ্গে হো হো করিয়া বেড়াইব না। একাগ্রচিত্ত হইয়া একান্তে তাঁহার জন্য কঠোর তপস্যা করিব। আমি বাড়ি হইতে চলিয়া যাইব, আর ফিরিব না’। দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র উনচল্লিশ বছর। পথে মুঙ্গের-পাটনা-কাশী হয়ে অমৃতসর পৌঁছান ১৮৫৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। সেখান থেকে কালকা, অবশেষে সিমলায় পৌঁছালেন কয়েকদিন পরে। সিমলায় কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে দুর্গম পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে ধীরে ধীরে উপস্থিত হলেন উচ্চতম শিখর নারকাণ্ডায়। পাহাড়ের নিবিড় বনাঞ্চল, অসীম নীরবতা আর স্বর্গীয় শোভায় দেবেন্দ্রনাথের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল, নতজানু হয়ে তিনি বিশ্বদেবতাকে প্রণাম করলেন।
দেবেন্দ্রনাথ স্থির করলেন এবার পদব্রজে আরও উপরে উঠবেন, আজীবন এখানেই তপস্যা করে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু বিধাতার নির্দেশ ছিল অন্য। তাই দেবেন্দ্রনাথকে আবার নেমে আসতে হল সংসারের হট্টমেলার হাটে, কাঁধে তুলে নিতে হল সব দায়ভার।
তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন : এই সময়ে আমি কন্দরে কন্দরে নদী প্রস্রবণের নব নব বিচিত্র শোভা দেখিয়া বেড়াইতাম। এই বর্ষাকালে এখানকার নদীর বেগে বৃহৎ বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড প্রবাহিত হইয়া চলিয়া যায়। কেহই এ প্রমত্ত গতির বাধা দিতে পারে না। যে তাহাকে বাধা দিতে যায়, নদী তাহাকে বেগমুখে দূর করিয়া ফেলিয়া দেয়। একদিন আশ্বিন মাসে খাদে নামিয়া একটা নদীর সেতুর উপর দাঁড়াইয়া তাহার স্রোতের অপ্রতিহত গতি ও উল্লাসময়ী ভঙ্গী দেখিতে দেখিতে বিস্ময়ে মগ্ন হইয়া গেলাম। আহা! এখানে এই নদী কেমন নির্মল ও শুভ্র! ইহার জল কেমন স্বাভাবিক পবিত্র ও শীতল। এ কেন তবে আপনার এই পবিত্র ভাব পরিত্যাগ করিবার জন্য নীচে ধাবমান হইতেছে? এ নদী যতই নীচে যাইবে, ততই পৃথিবীর ক্লেদ ও আবর্জনা ইহাকে মলিন ও কলুষিত করিবে। তবে কেন এ সেই দিকেই প্রবল বেগে ছুটিতেছে? কেবল আপনার জন্য স্থির হইয়া থাকা তাহার কি ক্ষমতা? সেই সৰ্ব্বনিয়ন্তার শাসনে পৃথিবীর কর্দমে মলিন হইয়াও ভূমিসকলকে উৰ্ব্বর ও শস্যশালিনী করিবার জন্য উদ্ধতভাব পরিত্যাগ করিয়া ইহাকে নিম্নগামিনী হইতেই এই প্রকার ভাবিতেছি, এই সময়ে হঠাৎ আমি আমার অন্তর্যামী পুরুষের গম্ভীর আদেশ-বাণী শুনিলাম, তুমি এ উদ্ধত ভাব পরিত্যাগ করিয়া এই নদীর মত নিম্নগামী হও। তুমি এখানে যে সত্য লাভ করিলে, যে নির্ভর ও নিষ্ঠা শিক্ষা করিলে, যাও পৃথিবীতে গিয়া তাহা প্রচার কর।
আমি চমকিয়া উঠিলাম! তবে কি আমাকে এই পুণ্যভূমি হিমালয় হইতে ফিরিয়া যাইতে হইবে? আমার তো এ ভাবনা কখনই ছিল না। কত কঠোরতা স্বীকার করিয়া সংসার হইতে উপরত হইয়াছি; আবার সংসারে যাইব বলিয়া বাসাতে আসিলাম; তাহাতেও আমার বুকের ধড়ধড়ানি গেল না। তখন কিশোরীকে ডাকিলাম, এবং বলিলাম, “কিশোরী! আমার আর সিমলাতে থাকা হইবে না ; ঝাপান ঠিক কর।’ এই কথা বলিতে বলিতে দেখি যে, আমার হৃৎকম্প কমিয়া যাইতেছে। তবে এই কি আমার ঔষধ হইল? আমি সেই সমস্ত দিনই বাড়ি যাইবার জন্য স্বয়ং উদ্যোগী হইয়া উপযুক্ত ব্যবস্থা ও বন্দোবস্ত করিতে লাগিলাম; ইহাতেই আমি আরাম পাইলাম। দেখি যে, আমার হৃদয়ের সে ধড়ধড়ানি আর নাই, সব ভাল হইয়া গিয়াছে। ঈশ্বরের আদেশ, বাড়িতে ফিরিয়া যাওয়া; সে আদেশের বিরুদ্ধে কি মানুষের ইচ্ছা টিকিতে পারে? সে আদেশের বাহিরে একটু ইচ্ছা করিতে গিয়া প্রকৃতি-সুদ্ধ বিরুদ্ধে দাঁড়াইল, এমনি তাহার হুকুম! হুৰ্মে-অন্দর সব কোই, বাহর- হুম ন কোই। আর কি আমি সিমলাতে থাকিতে পারি’?
দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব ছিল না। সংসার ত্যাগের দুবছর পড়ে ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর আবার ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। আর তার দুবছর পরে জন্ম নিলেন তাঁর কণিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ। হয়ত এই যুগপুরুষের আবির্ভাবের উদ্দেশেই বিধাতা মহর্ষিকে আবার সংসারের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছিলেন।