মুমূর্ষু ভক্তের শিয়রে রবি 4.4/5 (5)

রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনে মৃত্যুর আঘাত বারেবারে ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়েছে। তাঁর সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক এতই নিবিড় যে পারিবারের বাইরেও বেশ কয়েকজন অনাত্মীয় গুণগ্রাহী মানুষের শেষ শয্যার শিয়রে এসে দাঁড়াতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে।  এই মানুষগুলি মৃত্যুর আগে তাদের একান্ত মনের মানুষটিকে একবার শেষ দেখা দেখতে চেয়েছেন, চেয়েছেন তাঁর গান আর কথা শুনে যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরে একটু শান্তির পরশ পেতে।

প্রায় সমবয়সী উপেন্দ্রকিশোর রায় (১৮৬৩-১৯১৫) ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)। তিনি ইতিমধ্যেই বাংলা শিশুসাহিত্যে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৫১ তম জন্মতিথি উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে যে বিশেষ সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেই রবীন্দ্রভক্ত তরুণ সুকুমারের সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। শান্তিনিকেতনের নানা উৎসব অনুষ্ঠানে সুকুমার আংশগ্রহণ করেছেন। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন লণ্ডন যান, সুকুমার রায়  তখন সেখানকার রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য। প্রথমদিন থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাঁর নানা অনুষ্ঠানে সঙ্গ দিয়েছিলেন।

সুকুমার রায়

সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে সুকুমার রায়ের বিবাহ ১৯১৩ সালের ডিসেম্বরে। এই সময়ে, শান্তিনিকেতনের নানা কাজের ব্যস্ততায় ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথে শিলাইদহে গিয়েছিলেন (১০ ডিসেম্বর) বেশ কিছুদিন বিশ্রামের লোভে। সেখানেই সুকুমারের বিয়ের খবর পেয়ে নিজের বিশ্রামসুখ ভুলে গিয়ে ১৩ ডিসেম্বর সোজা চলে এলেন কলকাতায়। সবাইকে অবাক করে সন্ধ্যায় হাজির হলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। এতই ভালোবাসতেন স্নেহের সুকুমারকে। সীতা দেবী লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন শুনিয়াছিলাম। বিবাহ প্রায় আরম্ভ হইতে যাইতেছে এমন সময় গেটের কাছে করতালিধ্বনি শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইয়া গেলেম। পরক্ষণেই দেখিলাম কবি আসিয়া সভাস্থলে প্রবেশ করইলেন। পরে শুনিয়াছিলাম, এই বিবাহে উপস্থিত থাকিবার জন্যই তিনি কলকাতায় আসিয়াছিলেন।

জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার বরাবরই ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী এবং ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রচারক। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও ব্রহ্মসংগীত রচনা, মাঘোৎসব পরিচালনা, প্রবন্ধ রচনা, বক্তৃতা ইত্যাদি বহু গঠনমূলক কাজ করেছেন। কিন্তু একসময়ে মূল ব্রাহ্মসমাজ নানাভাবে বিভক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় ডুবে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই সংকীর্ণতার ঘোর বিরোধী ছিলেন; তাঁর নৌকাডুবি, গোরা ইত্যাদি উপন্যাস প্রকাশের পরে রক্ষণশীলগোষ্ঠী প্রশ্ন তুলেছিল রবীন্দ্রনাথ ‘যথেষ্ঠ ও যথার্থ ব্রাহ্ম’ কি না? সেই সময় সুকুমার রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রমুখ তরুণ ব্রাহ্মেরা রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন করেছিলেন।

১৯২১ সালের ২ মে পুত্র সত্যজিত রায়ের জন্মের কিছুদিন পরেই সুকুমার রায়ের শারিরীক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। জানা যায় তিনি দুরারোগ্য কালাজ্বরে কবলিত। সেই সময়ে কালাজ্বরের কোনো চিকিৎসাই ছিল না, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এই সংবাদ রবীন্দ্রনাথকে ব্যাথিত করেছিল। তিনি নিয়মিত তাঁর খোঁজখবর নিতেন, দেখা করতে আসতেন। নানাভাবে তঁকে সাহস যোগাতেন।

১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ ও ১৯ তারিখে কলকাতার অ্যালফ্রেড ও ম্যাডন থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসব অভিনয় হয়েছিল। সুকুমার রায় তখন তাঁর গড়পাড়ের বাড়িতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। অভিনয় চলাকালীন রবীন্দ্রনাথ সেই  খবর পেলেন, এবং এটাও জানতে পারলেন, সুকুমার এতই অসুস্থ যে  কথা বলবার মত অবস্থায়ও নেই। পুত্রসম সুকুমারের জন্য কবির মন চঞ্চল হয়ে উঠল। কবির জ্যাঠতুতো দাদা, দিনেন্দ্রনাথের পিতা, দ্বিপেন্দ্রনাথ সে সময়ে শান্তিনিকেতনেই ছিলেন। অভিনয়ের আগের দিন খবর এল যে আকস্মিক হৃদরোগে তাঁর জীবনাবসান (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯২২) হয়েছে। দিনেন্দ্রনাথ তড়িঘড়ি শান্তিনিকেতনে চলে গেলে অবনীন্দ্রনাথ  ঠাকুরকে প্রায় বিনা প্রস্তুতুতে দিনেন্দ্রনাথের জায়গায় অভিনয় করতে হয়েছিল।

সেই পারিবারিক শোকের আবহেই রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুপথযাত্রী সুকুমারকে দেখতে গেলেন তাঁর গড়পারের বাডিতে। গুরুদেবকে দেখে কৃতজ্ঞতায় সুকুমারের চোখে জল এসে গিয়েছিল। তিনি কবিকে অনুরোধ করলেন দুটি গান গেয়ে শোনানোর জন্য। কথা বলতে পারছেন না, বই খুলে গানদুটি দেখিয়ে দিলেন কেবল। রবীন্দ্রনাথ ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ আর ‘দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো’ গানদুটি গেয়ে তাঁর যন্ত্রণাক্লিষ্ট হৃদয়ে একটু শান্তির পরশ বুলিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় গানটিতে সম্ভবত সেখানেই সুর দিয়েছিলেন এবং সুকুমারের অনুরোধে সেটি দুবার গাইতে হয়েছিল। পরের বছর পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সুরটি রক্ষিত হয় নি। ১৯২৩ সালে ১০ সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ২৬ বছর বয়সে বাংলা সাহিত্যের এক বিরল প্রতিভা অকালে ঝরে পড়ল।

১২ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে মন্দিরের উপাসনায় রবীন্দ্রনাথ সুকুমারকে স্মরণ করে বললেন, ‘আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মত, অল্পকালের আয়ুটিকে নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে প্রায় আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে সেই গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে’।

জীবনের যে কোনো দুঃখবেদনায় রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় ছিল তাঁর গান। সুকুমারের মৃত্যুশয্যায় তিনি যা গাইলেন তা কেবলমাত্র রোগযন্ত্রণায় সান্ত্বনার জন্যই নয়, নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করবার প্রয়াস ছিল তাতে। 

আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে

কান্তকবি রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০)  গলার ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। একেবারেই কথা বলতে পারছেন না, কাগজে লিখে নিজের কথা বা প্রশ্ন অন্যকে জানাতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ সে সময় শিলাইদহ থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। রজনীকান্তের একান্ত ইচ্ছা মৃত্যুর আগে যদি একবার কবির দেখা পাওয়া যায়। শরৎকুমার  লাহিড়ী মারফৎ রবীন্দ্রনাথের কাছে জানালেন তাঁর মনোবাসনা।  হাসপাতালের পরিবেশ  সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনে একধরণের অস্বস্তি আর ভীতি ছিল। তবুও মৃত্যু পথযাত্রী একজন ভক্তকবির কাতর আহ্বান তিনি উপেক্ষা করতে পারেলেন না। ১১ জুন সকালে দেখা করতে গেলেন রোগীর সঙ্গে। কবিকে দেখে রজনীকান্তের বহুদিনের অপূর্ণ সাধ সেদিন পূর্ণ হয়েছিল।

রজনীকান্ত সেন

পরে রবীন্দ্রনাথ রজনীকান্তকে লিখেছেন, ‘সেদিন আপনার রোগশয্যার পার্শ্বে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর তাহাকে আপনার সমস্ত অস্থিমাংস, স্নায়ুপেশী দিয়া চারিদিকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়াও কোনোমতে বন্দী করিতে পারিতেছে না, ইহাই আমি প্রত্যক্ত দেখিতে পাইলাম। এ কথা হইতে আমার মনে হইতেছিল, সুখদুঃখ বেদনায় পরিপূর্ণ এই সংসারের প্রভূত শক্তির দ্বারা কি ছোটো মানুষটির আত্মাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না? শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই, কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু সংগীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই, পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই। মানুষের আত্মার সত্যপ্রতিষ্ঠা যে কোথায়, তাহা যে অস্থিমাংস ও ক্ষুধাতৃষ্ণার মধ্যে নহে, তাহা সেদিন সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিয়া আমি ধন্য হইয়াছি’।  রবীন্দ্র-রজনীকান্তের এই মিলনের তিনমাস পরে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯১০ রজনীকান্তের মৃত্যু হয়েছিল।

আরও একজন ভক্তকে তার রোগশয্যার রবীন্দ্রনাথ দর্শন দিয়েছিলেন। তিনি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯)।  তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আলাপ ১৮৯৪ সালে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের দেওয়া মানপত্রটি রামেন্দ্রসুন্দরেরই লেখা। আবার তিন বছর পরে রমেন্দ্রসুন্দরের জন্মদিনের অভিভাষণটি পাঠ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই।  জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ৩১ মে  রবীন্দ্রনাথ স্যার উপাধি প্রত্যাখান করলে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তখন মৃত্যুশয্যায়। রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগের খবর জেনেছেন বসুমতী পত্রিকার পড়ে। তাঁর একান্ত ইচ্ছা কবি একবার তাকে দর্শন দিক। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন : রবিবার রামেন্দ্রবাবু এই সংবাদ অবগত হন, এবং রবীন্দ্রবাবুর পত্রের অনুবাদ পাঠ করেন। রামেন্দ্রবাবু তাহার কনিষ্ঠকে দিয়া রবিবাবুকে বলিয়া পাঠান, ‘আমি উত্থানশক্তিরহিত আপনার পায়ের ধূলা চাই।’

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

সোমবার (১৯ জ্যৈষ্ঠ) প্রভাতে রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রবাবুর শয্যাপার্শ্বে উপনীত হন। রামেন্দ্রবাবুর অনুরোধে রবিবাবু তাঁহাকে মূল পত্রখানি পড়িয়া শুনান। এ পৃথিবীতে রামেন্দ্রের এই শেষ শ্রবণ । রামেন্দ্রসুন্দর রবীন্দ্রনাথের পদধুলি গ্রহণ করেন। কিয়ৎকাল আলাপের পর রবীন্দ্রনাথ চলিয়া গেলেন ; রামেন্দ্রসুন্দর তন্দ্রায় নিমগ্ন হইলেন। সেই তন্দ্রাই মহানিদ্রায় পরিণত হইল। ৬ জুনরাত্রে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে রামেন্দ্রসুন্দরের মৃত্যু হয়।

Please rate this

Join the Conversation

2 Comments

  1. অসাধারণ সব ঘটনা আপনার লেখনীতে প্রাণ পেল।

  2. আপনার ব্লগের লেখাগুলি আমার কাছে অমূল‍্য সম্পদ। একাধারে সমৃদ্ধ হই ও অভিভূত হই। একটি বিষয় জানার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। অমিতাভ চৌধুরীর ‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ ‘ পড়ার সময় সুকুমার রায়ের মৃত‍্যূশয‍্যায় কবির ‘দুঃখ এ নয় সুখ নহে গো’ গানটি বিষয়ে জেনেছিলাম। গীতবিতানে গানটি আছে। youtube এ গানটি তপতী বিন্দু পিনাকী ভট্টাচার্যের সুরে গেয়েছেন। কবি যে সুরে গেয়েছিলেন সে সুরে আর কেউ কি গান নি? সে সুর কি হারিয়েই গেছে? এ বিষয়ে যদি আলোকপাত করেন ভালো হয়। নমস্কার।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *