শঙ্খদা 4.8/5 (5)

আজ শঙ্খদার জন্মদিনে আমার স্মৃতিচারণা  

আগে আমার নাম ছিল পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকার।  শঙ্খদা বললেন, ‘ওটা পূর্ণেন্দুবিকাশ করে দিন’। আমি একটু খুঁৎখুঁৎ করেছিলাম। শঙ্খদা বললেন, ‘ওটাই থাক’। সেই থেকে আমি  পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার। ততদিনে এই বিশাল মানুষটির সান্নিদ্ধের জড়তা আমার অনেকটাই কেটে গিয়েছে। প্রথম দিকে, মানে ২০০৪ সাল নাগাদ, এমনটা ছিল না। চিকিৎসক হিসাবে আমার জগৎ শঙ্খদার থেকে অনেক দূরে, বলা যায় বিপরীত মেরুতে। নার্সিংহোমের ব্যস্ততা, অপারেশন আর রোগীর ভীড়ে সাহিত্যের আঙিনায় উঁকিঝুঁকি ছাড়া গভীরে প্রবেশ করবার ফুরসৎ নেই। সেই সময়, কী এক অনিবার্য সমাপাতনে শঙ্খদার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে গেল। এতদিন ছিল শুধু জীবিকার অন্বেষণে ছুটে বেড়ানো, এবার শুরু হল জীবনকে নতুন করে দেখবার পালা।

তখন গান শোনবার জন্য আজকের মত এত উপকরণ ছিলনা। ছিল ঘর ভরতি ক্যাসেট আর ক্যাসেট প্লেয়ার। কিন্তু সেই ক্যাসেট-ভাণ্ডার থেকে মনের মত কিম্বা প্রিয় শিল্পীর গান শোনা ছিল মহা ঝঞ্ঝাটের। সেই সমস্যার সমাধান হয়েছিল আমার সংকলন করা গীতবিতান আর্কাইভ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম ডিজিটাল সংকলনে। আর সেই সূত্রেই শঙ্খদাকে প্রথম দেখা, আলাপের সূত্রপাত, যা আমার পেশাগত জীবনের গতানুগতিকতার বাইরে অন্য একটি আঙ্গিনার দরজা খুলে দিয়েছিল ।

প্রথম থেকেই ইচ্ছা ছিল শঙ্খদাকে আমার সংকলনটা একবার দেখিয়ে তাঁর মতামত চাইব আর সম্ভব হলে একটা ভূমিকা লিখে দেবার অনুরোধও করব। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না দুটি কারণে। প্রথমত উনি আমাকে চেনেনই না, কেন অকারণে তাঁর মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন আমার মত সামান্য মানুষের জন্য। দ্বিতীয়ত রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কিছু করবার যোগ্যতা কি আমার আদৌ আছে? এই দোলাচলের মধ্যে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে শঙ্খদার সঙ্গে দেখা করবার একটা সুযোগ এসে গেল একদিন। যদিও সেই বন্ধুর হাত দিয়েই আমার কাজের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তাঁকে।

নির্ধারিত দিনে, নির্ধারিত সময়ে, অনেক সাহসে ভর করে, কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ ঝুলিয়ে, ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের তিন তলার দরজার কলিংবেলের সুইচে আঙুল ছোঁয়ালাম। ফ্লাটবাড়ির সবুজ রঙের দরজায় নেমপ্লেট ‘মিঠি-দিয়া’। শঙ্খদার দুই মেয়ের আদরের নাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে নিভাজ সাদা ধুতিপাঞ্জাবী পরা, সৌম্যদর্শন শঙ্খদা নিজেই দরজা খুলে বললেন, ‘আসুন’, মুখে স্মিত হাসি।  ছোট্টো একটি সম্ভাষণই  একনিমেষে আমার মনের সমস্ত সংকোচ দূর করে দিল। বন্ধুটি আগেই বলেছিল  শঙ্খদা অত্যন্ত গম্ভীর আর খুব কম কথার মানুষ। কিন্তু সেই আপাত গাম্ভীর্যের মধ্যে এক অকৃত্রিম  আন্তরিকতার ছোঁয়ায়, প্রথম দর্শনেই মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল।

ইতিমধ্যে আর এক প্রস্থ চা এবং টা-ও এসে গিয়েছে সেন্টার টেবিলে। পরে জেনেছিলাম এটি ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের এই ফ্লাটের একটি  বিশেষ ঘরানা।  যে-কোনো অতিথি, যখনই শঙ্খদার কাছে আসুক না কেন, তাকে আপ্যায়িত করবার জন্য সেন্টার টেবিল কখনো খালি থাকে না। শঙ্খদা নিজের হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। সীমাহীন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবার মত অবস্থা তখন আমার। শুধু তাইই নয়, বিদায় নেবার জন্য যখন প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম, শঙ্খদা দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। আমার মত একজন নগণ্য মানুষকে আপন করে নিতে, প্রাথমিক পরিচয়ের জড়তা কাটাতে  শঙ্খদার এই অহংকারহীন  বিনয় আর সৌজন্যে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।

ডানদিকের বইঠাসা ছোটো ঘরটাতে বসতে দিলেন নিজের চেয়ারের পাশটিতে। রয়েছেন আরও কতিপয় অতিথি। ছোট্টো ডিভান, সেন্টার টেবিল।  জানালা দিয়ে আসা আলোয় উজ্জ্বল ঘরটাতে ছড়িয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত আভিজাত্য।  বলতে বাধা নেই সেদিন সেই পরিবেশে, শঙ্খদার মুখোমুখি, নিজেকে খুব বেমানান লাগছিল। একরাশ সংকোচ আর উৎকণ্ঠায় হাতের তালু ঘেমে উঠছিল। ‘আপনি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কিছু করছেন শুনলাম’।  শঙ্খদার কথার মধ্যে যে প্রশ্রয় ছিল তাতে একটু সাহস পেয়ে, ল্যাপটপ খুলে গীতবিতান আর্কাইভের বিষয়বস্তুগুলি দেখালাম। উনি অত্যন্ত  মনযোগ দিয়ে দেখলেন, কিছু প্রশ্ন করলেন।  কেন করেছি, কতদিন লাগল ইত্যাদি। অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম কেমন হয়েছে। স্বল্পভাষী শঙ্খদা বললেন, ‘বেশ ভালো’।  বুঝলাম আমার দীর্ঘ পরিশ্রম বৃথা হয়নি। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার এই কাজ দেখে শঙ্খদা হয়ত মনে মনে  হেসে আমাকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে বিদায় করবেন। কিম্বা বলবেন এ আমার অনধিকার চর্চা। কিন্তু শঙ্খদার মত মানুষ যে-কোনো গঠনমূলক কাজকে অন্তর থেকে সমর্থন করে, তাকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যাবার জন্য পরামর্শ আর উৎসাহ দিতে কার্পণ্য করেন না। শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, প্রত্যেক উদ্যোমী প্রচেষ্টার প্রতি তাঁর উদারতা কত মানুষের প্রতিভাকে উন্মোচিত করেছে তার হিসাব নেই।

আসবার আগে শঙ্খদার কাছে  আবদার করেছিলাম গীতবিতান আর্কাইভের একটা ভূমিকা লিখে দেবার জন্য। পরে, আমার স্পর্ধায় আমিই অবাক হয়ে গিয়েছি। শঙ্খদার মত ব্যক্তিত্ব, যার সঙ্গে সেদিনই প্রথম পরিচয়, কোন সাহসে আমি এমন অনুরোধ করতে পেরেছিলাম! শঙ্খদা শুধু বলেছিলেন, ‘দেখছি’। একই সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের উচ্ছ্বাস আর ‘দুঃসাহসিক অনুরোধ’-এর  লজ্জায় পরবর্তী কয়েকটি দিন কেটে গেল।

শঙ্খদা কিন্তু আমার কথা ভোলেন নি। আমাদের প্রথম দেখাটিকে তিনি মনে রেখেছিলেন। অনেক যত্ন করে নিজের হাতে  গীতবিতান  আর্কাইভের  একটা অসাধারণ ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন।  শঙ্খদার ফোন পেয়েই এক রবিবার সকালে হাজির হলাম সেই তীর্থক্ষেত্রে । শঙ্খদা তাঁর পাশের চেয়ারে আমাকে ডেকে নিয়ে একটা সাদা কাগজে ঝকঝকে অক্ষরে নিজের হাতে লেখা গীতবিতান আর্কাইভের ভুমিকাটা দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখুন ঠিক হয়েছে কিনা’। লেখাটায় একবার চোখ বুলিয়েই গায়ে কাঁটা দিল। এক একটা অক্ষর যেন হিরের টুকরো। আমার নিজের খেয়ালে তৈরি রবীন্দ্রনাথের গানের এই আর্কাইভের জন্য শঙ্খদার মত মানুষ যে কী অসীম গুরুত্ব দিয়ে অসামান্য ভূমিকাটি লিখেছেন, সেটা ভেবে আমার চোখ জলে ভরে গেল। আনত হয়ে প্রণাম করে তাঁর  আশীর্বাদ চাইলাম।

সেই শুরু। শঙ্খদার এই প্রশ্রয় আমার রবীন্দ্রচর্চায় নতুন উৎসাহ যুগিয়েছিল। শুধু তাইই নয়, আমি অনুভব করেছিলেম, পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরেও পেশাবহির্ভূত যে-কোনো গঠনমূলক কাজের আনন্দ আর তৃপ্তির মূল্য সীমাহীন। রোজকার একঘেয়েমির ব্যস্ততা থেকে একটু মুক্তির ছোঁয়া পায় আমাদের জীবন।    

তারপর দীর্ঘ ১৯ বছর শঙ্খদার সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয়। তাঁকে যতই দেখেছি ততই বিস্মিত হয়েছি ভিতরের মানুষটিকে একটু একটু করে চিনতে পেরে। প্রতি রবিবার বাইরের ছোট্টো ঘরটা জমজমাট হয়ে ওঠে রবিবাসরীয় আড্ডায়। কত মানুষের সেখানে সমাগম। সবার জন্য শঙ্খদার  দরজা সদা-উন্মুক্ত। কেউ আসেন তার লেখা নতুন বইটিতে কবির আশীর্বাদী সাক্ষর নিতে, কেউ আসেন নতুন কবিতা শোনাতে। কারও বা বায়না পত্রিকার জন্য লেখা চাই, কেউ আসেন তার রচনা সংশোধনের আশায়। আবার আগামী পরিকল্পনার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতেও কারও কারও উপস্থিতি। এছাড়া কবিতা পাঠ, আবৃত্তি তো রয়েইছে। এইসব রবিবাসরীয় আড্ডায় শঙ্খদা মধ্যমণি, তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে সবার কথা মনযোগ দিয়ে  শুনছেন। শঙ্খদা খুব কম কথা  বলেন, কিন্তু যা বলেন তার জন্য সবাই উদ্গ্রীব হয়ে থাকেন।  শঙ্খদার  চরিত্রে রাগ বা বিরক্তি বলে কোনো শব্দ নেই। এত মানুষের এত আবদারে তাঁকে কখনো উষ্মা প্রকাশ করতে দেখিনি।   

গীতবিতান আর্কাইভটিকে সম্পূর্ণতর করবার জন্য শঙ্খদা নানা পরামর্শ আর তথ্য যুগিয়েছেন প্রতিনিয়ত।  সফটওয়ারের আরও কিছু সংশোধন করে  কিছুদিন পরে গিয়েছিলাম গীতবিতান আর্কাইভের চূড়ান্ত রূপটা শঙ্খদাকে দেখাতে। সেদিনই প্রথম পরিচয় হয়েছিল প্রতিমা বৌদির সঙ্গে। শান্ত মাতৃরূপ যেন। শঙ্খদা ওঁনাকে ডেকে বলেছিলেন ‘এসো একটা নতুন জিনিস দেখে যাও’।  সেদিন চা-পানের ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রনাথের গানের সংরক্ষণ, বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, গীতবিতান আর্কাইভের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল দুই বিরাট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি, তাঁর গান, তাঁর দর্শন  শঙ্খদা আর প্রতিমা বৌদির  জীবনে কত নিবিড়ভাবে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে জেনে বিস্ময়ে নির্বাক হয়েছিলাম। সেদিন শঙ্খদাকে খুব কাছে পেয়ে, অচেনা মানুষটিকে যেন নতুন করে চিনলাম। ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি এই বিরাট মানুষটিকে আমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দেবার জন্য।     

সৃষ্টিশীল মানুষ বরাবরই আত্মপ্রচারের জন্য উন্মুখ। আর আজকের স্যোশাল মিডিয়ার যুগে সবাই যে যার ঢাক পিটিয়ে চলেছে। ব্যতিক্রম দেখেছি একমাত্র শঙ্খদা। সামান্যতম প্রচারের সম্ভাবনা দেখলেই শঙ্খদা সেখানে আর নেই। সেবার সবেমাত্র জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। আমরা গিয়েছি প্রণাম করতে। চা-এর সঙ্গে শঙ্খদার জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় নিজেদের সমৃদ্ধ করছি। এমনসময় একদল সাংবাদিক ঘরে ঢুকলেন  শঙ্খদার ইন্টারভিউ আর ছবি নেবার জন্য।  তিনি তাদের সমাদরে আপ্যায়ন করলেন, চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিলেন, কিন্তু  ইন্টারভিউয়ের জন্য ব্যুম আর ক্যামেরার চালু  করতেই বললেন, ‘আপনারা কাজ করুন আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি’। সাংবাদিককুলের অবস্থা তখন দেখবার মত।

একই ঘটনা ঘটেছিল আমার বেলাতেও। আনুষ্ঠানিক প্রকাশের আগে গীতবিতান আর্কাইভের একটা প্রেস-রিলিজ হবে রোটারি সদনে ২০০৫ সালে। শঙ্খদাকে অনুরোধ করলেম, ‘আপনার হাত দিয়েই এটা প্রকাশ করতে চাই’। তিনি শুধু মৃদু হেসে নীরব থাকলেন। অর্থাৎ ‘না’।  উনি চান নি মঞ্চে উঠে প্রচারের আলোয় নিজেকে মেলে ধরতে। তবে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, বসেছিলেন দর্শকাশনের এক কোণায়। অনুষ্ঠান শেষে, চা-পানের আসরে আমার হাত ধরে একান্তে বলেছিলেন, ‘অসাধারণ একটা কাজ করেছেন আপনি’। আমার মনে হয়েছিল আড়াই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আজ সার্থক হল। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী আশা করতে পারে আমার মত একজন সম্পূর্ণ ভিন্ন পেশার মানুষ। 

গীতবিতান আর্কাইভ প্রকাশের সাফল্য, শঙ্খদার প্রেরণা আর উৎসাহ আমাকে রবীন্দ্র-সাহিত্যের আরও গভীরে হাতছানি দিত। চিকিৎসা-কাজের ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় পেলেই গীতবিতানের পাতায় ডুবে যেতাম মণিমুক্তার খোঁজে।  একদিন ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’-এর  পরিকল্পনা নিয়ে শঙ্খদার দ্বারস্থ হলাম। এবারের ভাবনা রবীন্দ্রনাথের লেখা সমস্ত গানের যাবতীয় তথ্যগুলিকে দুই মলাটের মধ্যে এমনভাবে সংকলন করা, যাতে এক নজরেই সবকিছু জেনে নেওয়া যায়। শঙ্খদার আশীর্বাদ নিয়ে ২০০৭ সালে শুরু করা কাজ  শেষ হয়েছিল ২০১৯ সালে সিগনেট প্রেস থেকে গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার নামে বইটি প্রকাশের মাধ্যমে।  মাঝের দশ বছরে কত অসংখ্যবার শঙ্খদার কাছে গিয়েছি, কত দুঃস্প্রাপ্য  বই আর পত্রপত্রিকা আমাকে দিয়েছেন ব্যবহার করবার জন্য, কতবার লেখা আর তথ্য সংশোধন করে দিয়েছেন তার আজ আর হিসেব নেই। গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার কাজটির প্রতি শঙ্খদার আগ্রহ আর উৎসাহ আমার সমস্ত পরিশ্রমকে আনন্দে রূপান্তর করেছিল।  শঙ্খদা ছাড়াও আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন শ্রদ্ধেয় সুভাষ চৌধুরী, অরুণকুমার বসু, প্রবীর গুহঠাকুরতা, নিত্যপ্রিয় ঘোষ, আলপনা রায়, স্বপন সোম প্রমুখ অসংখ্য গুণীজনেরা। তবে প্রকাশকের ঘরে বইটা বহুদিন ছাপা-না-হয়ে পড়ে থাকায় আমি যখনই বিরক্ত আর হতাশ হয়ে যেতাম, শঙ্খদাই আমাকে স্বান্তনা দিয়েছেন, ধৈর্য্য ধরতে বলেছেন। গীতবিতান  তথ্যভাণ্ডারের শুভেচ্ছা বার্তায় শঙ্খদা লিখেছেন, ‘আমাদের নিরন্তর রবীন্দ্রচর্চার জগতে এটি একটি জরুরি কাজ হিসাবে গণ্য হবে বলে বিশ্বাস করি। পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার এজন্য আমাদের সকলেরই সাধুবাদ পাবার যোগ্য’। শঙ্খদার কাছ থেকে এই প্রশংসা পাবার পরে আমার জীবনে আর কী চাহিদা থাকতে পারে?

‘গীতবিতান আর্কাইভ’ আর ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কবিতার ডিজিটাল সংকলন ‘রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভ’-এর নেপথ্যে রয়েছে শঙ্খদার নিরন্তর উৎসাহ আর সহযোগিতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতার নানা তথ্য যুগিয়ে, বহু সংশয়ের সমাধান করে, নানা পরামর্শ দিয়ে, পাঁচ বছরের পরিশ্রমে গড়ে তোলা রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভটিকে একটি অত্যন্ত মূল্যবান রবীন্দ্র-সংকলনের রূপ দিতে সাহায্য করেছেন তিনি।

২০১৮ সাল। রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা ঠিক করলাম আনুষ্ঠানিক প্রকাশের আগে একটা প্রেস কনফারেন্স করতে হবে। দিন পাওয়া গেল জুন মাসের ছয় তারিখে, প্রেসক্লাবে। হয়ত রাজি হবেন না, তবুও একদিন ভয়ে ভয়ে কথাটা জানিয়ে বললাম, ‘শঙ্খদা আপনি কি প্রেস কনফারেন্সে থাকতে পারবেন কিছুটা সময়ের জন্য’? একটু ভেবে বললেন, ‘সাধারণত আমি কোনো প্রেস কনফারেন্সে যাই না, তবে এটাতে যাবই’। আনন্দ আর বিস্ময়ে আমি কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলাম না। 

প্রেসক্লাবে  শঙ্খদা  এসেছিলেন একেবারে নির্দিষ্ট সময়ে। ইদানিং নানা সভাসমিতি, বই-প্রকাশ, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদি উপলক্ষে উদ্যোক্তাদের অনুরোধে শঙ্খদাকে উপস্থিত থাকতে হত। কিন্তু সময়ের ব্যাপারে তাঁর কোনো নড়চড় হত না। যাইহোক প্রেসক্লাবে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভে ২৪৫ জন শিল্পীর কণ্ঠে ৫০০০ টি রবীন্দ্রকবিতার আবৃত্তি সংকলিত রয়েছে। আমাদের একান্ত ইচ্ছা ছিল শঙ্খদারও কয়েকটি আবৃত্তি যুক্ত থাকুক আমার এই কাজের সঙ্গে। আমাদের শত অনুরোধেও শঙ্খদাকে রাজি করানো যায়নি। তাঁর যুক্তি আগেকার সেই ‘গলা’ এখন নাকি আর নেই। অথচ প্রেস ক্লাবে  আর্কাইভ সম্বন্ধে নিজের বক্তব্যের মাঝে শঙ্খদা মজা করে বলেছিলেন, ‘এরা ২৪৫ জন শিল্পীকে দিয়ে আবৃত্তি রেকর্ড করিয়েছেন কিন্তু আমাকে সুযোগ দেননি’। বুঝুন কান্ডটা ! পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হল ‘রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভে পাঠ করবেন শঙ্খও’।

শঙ্খদার সান্নিদ্ধে যখনই এসেছি নতুন ভাবে তাঁকে আবিষ্কার করেছি। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, অন্যায়ের সঙ্গে আপসহীন প্রতিবাদ, সমস্ত মানুষকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় উজাড় করে দেওয়া, তীক্ষ্ণ রসবোধ আর আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বারবার ছুটে গিয়েছি তাঁর কাছে। পিতৃসম এই মানুষটির কাছে গেলেই মনে হত এক অদ্ভুত আনন্দময় পরিবেশের মধ্যে রয়েছি। একবার অসুস্থতার জন্য বেশ কয়েকমাস শঙ্খদার কাছে যেতে পারিনি। একদিন সকালে ফোন এল, ‘আমি শঙ্খ বলছি, আপনি কি আমার উপরে রাগ করেছেন? অনেকদিন আসেন নি বা আপনার কোনো খবর পাচ্ছি না’। শঙ্খদার উপর রাগ করব? কেউ কি করতে পারে?   আমার মত একজন সামান্য মানুষের জন্য শঙ্খদার এত চিন্তা আর উদ্বেগে আমি কোনো কথাই বলতে পারি নি।  পরদিনই গিয়ে, প্রণাম করে, ভুল স্বীকার করে তবে শান্তি পেয়েছিলাম। সবার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, সকলের পারিবারিক খবরাখবর, সুখদুঃখের সাথি শঙ্খদার সৌজন্যবোধ আর বিনয়ী ব্যবহার আজকের দিনে নিঃসন্দেহে বিরল। শেষের দিকে হাঁটতে একটু অসুবিধা হত, তবুও দেখা করে ফিরে আসবার সময় সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন, হাজার বারণ করলেও শুনতেন না।

চিকিৎসক হিসাবে রোগীদের প্রতি দায়ব্ধতাকে পূর্ণ মর্যদা দিয়ে যখনই সময় পেয়েছি রবীন্দ্রনাথকে জানবার চেষ্টা করেছি।  সেটা নেহাতই শখের কারণে। সেখানে কোনো প্রাপ্তি আর পুরস্কারের চাহিদা ছিল না। আর তাতে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন শঙ্খদাই। একটা জিনিস বিশ্বাস করেছি, শঙ্খদার মত মানুষের প্রশ্রয়ে, ডাক্তারি পেশার বাইরে আমি যেটুকু রবীন্দ্রচর্চা করেছি বা করছি, তা বৃথা যাবে না। শঙ্খদার বাড়িতে সেই সময়ে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। তাদের সাহিত্য আলোচনা, কবিতা পাঠ আর নানা মূল্যবান আলাপচারিতা থেকে নিজেকে ঋদ্ধ করেছি। শঙ্খদার রবিবাসরীয় আড্ডাগুলির আরও একটি তীব্র আকর্ষণ ছিল। সেটি শঙ্খদার জীবনের নানা মজাদার অভিজ্ঞতার সরস খণ্ডচিত্র আর টিকাটিপ্পনী।  সেখানে নবাগত অতিথিদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময়  শঙ্খদা  বলতেন, ‘ইনি ডাক্তার সরকার। গীতবিতান আর্কাইভ আর রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভ সংকলন-দুটি ইনিই করেছেন। আর হ্যাঁ, উনি চোখের ডাক্তারিও করে থাকেন’। 

শঙ্খদা আর প্রতিমা বৌদি দুজনের চোখের সমস্যা ছিল, মূলত বার্ধক্যজনিত। তবে শেষের দিকে শঙ্খদার কথা শুনতে বা বুঝতে অনেকেরই বেশ মুশকিল হত। শঙ্খদা মজা করে বলতেন, ‘আমি হয়ত একটা কথা বললাম। যাকে বললাম তিনি যখন তার সম্পূর্ণ অন্য উত্তর বা প্রতিক্রিয়া দিতেন, বুঝতে পারতাম তিনি আমার কথা কিছুই বোঝেন নি, পুরোপুরি আন্দাজে উত্তর দিয়েছেন’। এই ধরণের অনেক কথোপকথন শোনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তবে কেন জানিনা ওঁনার সব কথাই আমি মোটামুটি বুঝতে পারতাম।  

শঙ্খদার জন্মদিন ৫ ফেব্রুয়ারি। প্রতিবছর এইদিন আমি আর বর্ণালী তাঁকে প্রণাম করে প্রাণভরা আশীর্বাদ নিয়ে আসতাম। যদিও করোনার প্রকোপে গত দুবছর সেটা আর সম্ভব হয় নি।  কিন্তু তারপর যে আকস্মিক ঝড় আমার জীবনে আছড়ে পড়েছিল, তেমনটা ঘটেছিল প্রায় ১৬ বছর আগে আমার বাবার মৃত্যুর দিনে।  গত ২১ এপ্রিল জগতের জগতের সব বন্ধন কাটিয়ে শঙ্খদা অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন। আর তার মাত্র আট দিন পরেই প্রতিমা বৌদিও চলে গেলেন তাঁকে সঙ্গ দিতে। জানি তাঁদের শূন্যতার বেদনা  আমাদের বয়ে চলতে হবে সারা জীবন ধরে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তাঁদের স্নেহ-আশীর্বাদ চিরজীবন আমার রবীন্দ্রচর্চার সাথি হয়ে থাকবে। 

Please rate this

Join the Conversation

2 Comments

  1. শঙ্খ ঘোষ এর জন্মদিনে যথার্থ প্রণতি জানিয়েছেন পুর্ণেন্দুবাবু۔ তাঁর সৌভাগ্য তো বটেই আমাদের ও সৌভাগ্য এমন মহৎ কাজ আপনার কাছ থেকে পেয়েছি

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *