গুরুকুল -২ 3.67/5 (3)

রবীন্দ্রনাথের স্কুলজীবন কখনোই সুখের  ছিল না। কান্নাকাটি করে সত্যপ্রসাদ আর সোমেন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হলেও, স্কুলের মোহ প্রথমদিনেই ঘুচে গিয়েছিল। আসলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার ভিত গড়ে উঠেছিল বাড়ির পরিবেশে, গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। মূল কাণ্ডারী ছিলেন সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি স্বেচ্ছায় রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য ভাইদের, এমনকি ঠাকুরবাড়িতে নবাগত বালিকা গৃহবধূদের পড়াশোনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আর ছিলেন একাধিক গৃহশিক্ষক। তাঁদের নিয়েই  আমার এই পর্যায়ের আলোচনা। আজ  দ্বিতীয় পর্ব।

১৮৭৩ সালের ফাল্গুন মাসে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যেয়ের পরিবর্তে ইংরাজি শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেন আনন্দচন্দ্র  বেদান্তবাগীশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর  সহপাঠীরা এক অস্থির সময়ের মধ্য  দিয়ে চলেছিলেন। একের পরে এক স্কুল বদল করেও কোথাও তাঁদের মন বসানো  যাচ্ছিল না। তাই ঠাকুরবাড়িতে একের পর এক গৃহশিক্ষকের আগমন।  আসলে  গৃহশিক্ষকদের এই ঘন ঘন  পরিবর্তন ছিল অভিভাবকদের এক ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তবে জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যই সবচেয়ে বেশীদিন (১৮৭৩-১৮৭৬) টিঁকে থেকে পড়াবার সুযোগ পেয়েছিলেন।

ছেলেরা স্কুলে না গেলেও স্কুল-পাঠ্যক্রমের বইগুলি থেকেই তিনি তাঁর ছাত্রদের পড়াতেন। অভিভাবকদের নির্দেশে জ্ঞানচন্দ্র তাঁদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর কোনো  প্রচেষ্টাই সফল হয়নি। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘ইস্কুলের পড়ায় যখন তিনি কোনোমতেই আমাকে বাঁধিতে পারিলেন না, তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া অন্য পথ ধরিলেন । আমাকে বাংলায় অর্থ করিয়া কুমারসম্ভব পড়াইতে লাগিলেন। তাহা ছাড়া খানিকটা করিয়া ম্যাকবেথ আমাকে বাংলায় মানে করিয়া বলিতেন এবং যতক্ষণ তাহা বাংলা ছন্দে আমি তর্জমা না করিতাম ততক্ষণ ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিতেন। সমস্ত বইটার অনুবাদ শেষ হইয়া গিয়াছিল।’

১৮৭৬ সালের ২১ এপ্রিল মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশানের সুপারিন্টেণ্ডেট ব্রজনাথ দে মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে ‘সোমবাবুদিগের ইংরাজি পড়াইবার মাষ্টার’ হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্রথমদিকে তাঁর পড়ানো রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগলেও, কিছুদিন পরে তাঁর ‘শিক্ষার বিপুল আয়োজন’  ছাত্রদের সম্পূর্ণ দুরধিগম্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মানুষ  হিসাবে ব্রজনাথ ছিলেন ‘অতি সরস, অতি সহাস্য, অতি মজাড়ে। তাঁর কোনো শাসন ছিল না, বরঞ্চ অহেতুক পুরস্কার ছিল’।  প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ব্রজনাথ দে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সঞ্জীবনী সভার একজন উৎসাহী সদস্য। 

অভিভাবকেরা রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে পড়াশুনোর মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইলেও মাঝে মাঝেই তিনি নানা অজুহাতে পালিয়ে বেড়াতেন। একবার ব্রজনাথ বাবুর হাত থেকে মুক্তির পাবার জন্য, ১৮৭৬ সালের মে মাসে,  জ্যোতিদাদার সঙ্গে শিলাইদহে পালিয়েও গিয়েছিলেন। জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথকে ড্রয়িং শেখাবার জন্য কালীদাস পালকে মাসিক আট টাকা বেতনে নিয়োগ করা হয়েছিল । কিন্তু সে  সময় রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার দিকে কোনো ঝোঁক না থাকায়  এক মাস পরেই তাঁকে বিদায় করা হল। মজার ব্যাপার, প্রথমজীবনে ছবি আঁকা সম্বন্ধে ভীতি থাকলেও জীবনের শেষ প্রান্তে সেটিই রবীন্দ্রনাথের শিল্পীমনের উজ্জ্বল সাক্ষর হয়ে রয়েছে।

সংস্কৃত পড়াবার জন্য পণ্ডিত হেরম্ব তত্ত্বরত্ন নিয়োজিত হলেন ১২৮১ সালের বৈশাখ মাসে। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ‘মুকুন্দং সচ্চিদানন্দং’ থেকে আরম্ভ করে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের সূত্র মুখস্থ করেছিলেন। এই সময়ে ক্যাম্বেল মেডিকেল কলেজের জনৈক ছাত্র একটি নরকঙ্কাল নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অস্থিবিদ্যা শেখাতে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অস্থিবিদ্যার হাড়ের নামগুলো এবং বোপদেবের সূত্র, দুয়ের মধ্যে কাহার জিত কাহার হার ছিল তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারি না। আমার বোধহয় হাড়গুলিই কিছু নরম ছিল।’ এই নর কঙ্কালের স্মৃতি থেকেই রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে ‘কঙ্কাল’ গল্পটি লিখেছিলেন। 

১৮৭৪ সালের মে মাসে হেরেম্ব তত্ত্বরত্নের জায়গায় সংস্কৃত শিক্ষক হিসাবে হরিনাথ ভট্টাচার্য’র আগমন। তিনি সাকুল্যে সাত মাস সংস্কৃত পড়াবার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মাইনে মাসিক আট টাকা। হরিনাথ ভট্টাচার্য এবং হেরেম্ব তত্ত্বরত্ন দুজনেই পড়াবার সময় ছিল সন্ধ্যাবেলা। তবে জীবনস্মৃতিতে অঘোরনাথবাবুর সান্ধ্য ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ যে ক্লান্তি আর ঘুমের কথা উল্লেখ করেছেন, সংস্কৃত পড়বার সময় বোধহয় তেমনটা ঘটেনি।

১৮৭৪ সালের ৯ নভেম্বর হরিনাথ ভট্টাচার্যের  জায়গায় রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণকে নিয়োগ করা হল নতুন সংস্কৃত শিক্ষক হিসাবে অচিরেই তিনি ঠাকুর পরিবারের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সরোজিনী নাটকের প্রুফ দেখতে সাহায্য করেছেন, রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিদ্যাসাগরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

প্রথম থেকেই সংস্কৃত ব্যাকারণের ভীতি রবীন্দ্রনাথকে তাড়া করত। রামসর্বস্ব কিছুদিন  ব্যার্থ চেষ্টা করে অবশেষে তাঁকে শকুন্তলা পড়াতে শুরু করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে বিদ্বজ্জন সমাগম সভায় রবীন্দ্রনাথ ‘প্রকৃতির খেদ’ নামে যে কবিতাটি পাঠ করে সকলের বাহবা কুড়িয়েছিলেন, সেটি রামসর্বস্বর তাগিদেই লেখা। রামসর্বস্ব ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৬ পর্যন্ত শিক্ষকতার পরে, অবসর নিয়ে মেট্রোপলিটন স্কুলে যোগ দিলে, চৈত্র মাসে  দিননাথ ন্যায়রত্নকে  নতুন সংস্কৃত শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করা হল।

শুধু গান রচনাই নয়, গায়ক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী। তাঁর গান শোনবার জন্য শ্রোতারা পাগল হয়ে থাকতেন। কিন্তু গানের জন্য তাঁর কোনো প্রথাগত তালিম ছিল না। কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমাদের পরিবারে শিশুকাল হইতে গানচর্চার মধ্যেই আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। আমার পক্ষে তাহার একটা সুবিধা এই হইয়াছিল, অতি সহজেই গান আমার সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। তাহার অসুবিধাও ছিল। চেষ্টা করিয়া গান আয়ত্ত করিবার উপযুক্ত অভ্যাস না হওয়াতে, শিক্ষা পাকা হয় নাই। সংগীতবিদ্যা বলিতে যাহা বোঝায় তাহার মধ্যে কোনো অধিকার লাভ করিতে পারি নাই।’  রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই ঠাকুরবাড়ির আবহাওয়া ছিল সংগীতরসে পূর্ণ। কিশোর বয়সে দেবেন্দ্রনাথ ওস্তাদের কাছে  গানবাজনার চর্চা করেছেন। তাঁর পুত্ররাও সংগীতচর্চায় ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান।

বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী, যদু ভট্টের মত নামজাদা সংগীতশিল্পীরা পাকাপাকিভাবেই জোড়াসাঁকোয় বাস করতেন। বিষ্ণুচন্দ্র ছিলেন জোড়াসাঁকোর বেতনভুক গায়ক। এঁর কাছেই প্রতি রবিবার সকালে সংগীতচর্চা করতে হলেও প্রথমদিকে তাঁর শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ শোভন মনে করতেন না, তাঁর বাঁধা-ধরা শিক্ষায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠতেন।  দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং সত্যেন্দ্রনাথের লেখা অনেক গানে বিষ্ণুচন্দ্র সুরারোপ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে মধুর গান শুনে দেবেন্দ্রনাথ মুগ্ধ  হয়ে, তাঁর শিক্ষাগুরু বিষ্ণুচন্দ্রকে পুরস্কৃত করেছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের নানা অনুষ্ঠানে বিষ্ণুচন্দ্রই ছিলেন মুখ্য গায়ক।

১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে যদুভট্ট (যদুনাথ ভট্টাচার্য) কিছুদিনের জন্য রবীন্দ্রনাথকে গান শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনিও ছিলেন মাসিক বেতনের গায়ক। তাঁর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তার পরে যখন আমার কিছু বয়েস হয়েছে তখন বাড়িতে খুব বড় ওস্তাদ এসে বসলেন যদু ভট্ট। একটা মস্ত ভুল করলেন, জেদ ধরলেন আমাকে গান শেখাবেনই; সেইজন্যে গান শেখাই হল না। ‘  রবীন্দ্রনাথকে গান শেখানো ছাড়াও যদুভট্টকে  জোড়াসাঁকোবাড়ির নানা প্রয়োজনে সাহায্য করতে দেখা গিয়েছে।

আর ছিলেন   শ্রীকণ্ঠ সিংহ।  জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ এঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংগীত শিক্ষক না হলেও কবির সংগীতজীবনে শ্রীকণ্ঠবাবুর পরোক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য। ১৮৭৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তিনি জোড়াসাঁকোর পাকাপাকি বাসিন্দা। দেবেন্দ্রনাথের সমবয়সী এবং রবীন্দ্রনাথের গানের একনিষ্ট  ভক্ত শ্রীকণ্ঠবাবুর সম্পর্কে কবি লিখেছেন, ‘বৃদ্ধ একেবারে সুপক্ক বোম্বাই আমটির মতো — অম্লরসের আভাসমাত্র বর্জিত — তাঁহার স্বভাবের কোথাও এতটুকু আঁশও ছিল না। মাথা-ভরা টাক, গোঁফদাড়ি কামানো স্নিগ্ধ মধুর মুখ, মুখবিবরের মধ্যে দন্তের কোনো বালাই ছিল না, বড়ো বড়ো দুই চক্ষু অবিরাম হাস্যে সমুজ্জ্বল। তাঁহার স্বাভাবিক ভারী গলায় যখন কথা কহিতেন তখন তাঁহার সমস্ত হাত মুখ চোখ কথা কহিতে থাকিত। ইনি সেকালের ফারসি-পড়া রসিক মানুষ, ইংরেজির কোনো ধার ধারিতেন না। তাঁহার বামপার্শ্বের নিত্যসঙ্গিনী ছিল একটি গুড়গুড়ি, কোলে কোলে সর্বদাই ফিরিত একটি সেতার, এবং কণ্ঠে গানের আর বিশ্রাম ছিল না।’  শ্রীকণ্ঠবাবুর গাওয়া হিন্দিগান থেকে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি ব্রহ্মসংগীত রচনা করেছেন। গায়ক যদুভট্ট একবার আকণ্ঠ মদ্যপান করে শ্রীকণ্ঠবাবুর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে যখন তাঁকে জোড়াসাঁকো থেকে বিদায় করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, শ্রীকণ্ঠবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিলেন, ‘ও তো কিছু করে নাই, মদে করিয়াছে’   

(আগামী সংখ্যায় তৃতীয় পর্ব)

Please rate this

Join the Conversation

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো।আপনার সরস পরিবেশনা সরস্বত লেখায় অন্য মাত্রা এলে দেয়। তবে প্রথম পর্ব পাইনি,কারণ বুঝতে পারলামনা।
    ভালো থাকবেন। পরবর্তী লেখার অপেক্ষায়।

  2. খুব সুন্দর। আপনার পরিশ্রমী উপস্থাপনা আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সমৃদ্ধ করে চলেছে। আপনাকে অকুন্ঠ ধন‍্যবাদ।

Leave a comment

Leave a Reply to Pranati Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *