ছাতু মাখিয়ে রবীন্দ্রনাথ 4.33/5 (27)

ছাতু মাখিয়ে রবীন্দ্রনাথ  ও রমণীচরিত্র

প্রসিদ্ধ কবিলেখক এবং উপন্যাসিক মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী। তাঁর লেখা অন্যতম উপন্যাস ‘ন হন্যতে’ তাঁকে বিশেষ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। মৈত্রেয়ী দেবী মংপুতে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে, ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চারবার তাঁর আতিথ্য গ্রহন করেছিলেন। মৈত্রেয়ী দেবী সেই দিনগুলির অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর লেখা ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে।

মৈত্রেয়ী দেবী

১৯৪০ সাল। রবীন্দ্রনাথ  রয়েছেন মংপুতে, মৈত্রেয়ী দেবীর শৈলকুটিরে। মংপুর উদার সৌন্দর্য, অখণ্ড অবসর আর স্নেহের মৈত্রেয়ীর আতিথ্যের আকর্ষণে রবীন্দ্রনাথ বার বার এসেছেন এই দুর্গম পাহাড়ি গ্রামটিতে।  এটি তাঁর চতুর্থবারের আগমন। কবির স্বভাবসিদ্ধ হাসিঠাট্টা, গান, গল্প  আর কবিতাপাঠে মংপুর দিনগুলি আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকত। মৈত্রেয়ী দেবী আর তাঁর বোন শ্রীমতী সুব্রতা দেবীর সঙ্গে নানা কৌতুক আর খুনসুটি করা ছিল রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় খেলা।  সুব্রতা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ মাসী, মাতৃস্বসা ইত্যাদি নামে সম্বোধন করতেন। এঁদের নিয়ে কতবার কত মজার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলি মৈত্রেয়ী দেবী অমর করে রেখেছেন তাঁর লেখায়।

একদিন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আচ্ছা তোমার ছাতু খাও না কেন? ছাতু জিনিসটা ভালো, আর তেমন করে মাখতে পারলে অতি উপাদেয় ব্যাপার হয়। একসময় ভাল ছাতু মাখিয়ে বলে আমার নাম ছিল, মেজদার টেবিলের ছাতু মাখতুম মারমালেড দিয়ে’। নিজের কৃতিত্ব জাহির করবার জন্য সাথে সাথে হুকুম দিলেন, ‘ছাতু নিয়ে এস, আজই ছাতুমাখা খেতে হবে।’  হুকুম তো হল কিন্তু দার্জিলিং, মংপু, কালিম্পং  কোথাও পাওয়া গেল না যবের ছাতু। অগত্যা বাড়িতেই তৈরি করে নেওয়া হল মুড়ির ছাতু। রবীন্দ্রনাথ বললেন তাইই সই। তিনি বসলেন ছাতু মাখতে । সে এক এলাহি কাণ্ড। নানা উপকরণ এল। এল মারমালেড, আদার রস, গোল্ডেন সিরাপ, দুধ, কলা মাখন আর কতকিছু। কবি সমস্ত মনোযোগ এক করে নিবিষ্ট মনে শুরু করলেন তাঁর হাতের খেলা। সবাই কবিকে ঘিরে অবাক হয়ে দেখছেন তাঁর ছাতু মাখার নৈপুন্য। হাসি চাপতে না পেরে মৈত্রেয়ী দেবী বলেই ফেললেন, ‘আপনার রসুনটাই বা বাদ যায় কেন ? একটু পেঁয়াজের রসও পড়ুক না’? রবীন্দ্রনাথ শুধু একবার কটাক্ষে তাঁর দিকে চাইলেন।

ছাতু

সন্ধেবেলা শুরু হল ছাতু খাওয়ার অনষ্ঠান। সবার প্লেটে প্লেটে বিশ্বকবির হাতের সেই অতুলনীয় ছাতু মাখা। খেয়ে বলতে হবে কেমন হয়েছে। কঠিন পরীক্ষা। কবি তাঁর প্রশ্ন নিয়ে এক এক জনের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। প্রথমেই ডাক পড়ল মৈত্রেয়ী দেবীর। তিনি বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একেবারে মুখোমুখি। তাই তাঁকেই হতে হল প্রথম গিনিপিগ। চামচে করে খেলেন একটুখানি ছাতুমাখা। তেমন কিছু ভালো লাগেনি, তবুও কবিকে খুশি করতে, একটু ইতস্তত করে মৈত্রেয়ী বললেন, ‘খুব চমৎকার, এতো রোজ খেলেই হয়।’ রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন পদটা মৈত্রেয়ীর মোটেই ভালো লাগেনি। শুধুমাত্র কবির মন রাখবার জন্যই মিছিমিছি সুখ্যাতি করা। 

এরপর মাসীর পালা। খেলেন কিন্তু পদটা তাঁর মোটেই ভালো লাগেনি। সটান বলে দিলেন ‘এতই কি ভালো ?‘ মানে তেমন ভালো হয়নি। রবীন্দ্রনাথ কপট দুঃখ করে বললেন, ‘তোমাদের ছাতুর দোষ গো ছাতুর দোষ, তা না হলে ভালো না হয়েই যায় না! মেজদার টেবিলে সবাই তো উৎসুক হয়ে থাকতেন, তারা কিছু কম শৌখিন ছিলেন । যাক্, কাল আর একবার চেষ্টা করতেই হবে। মাসীকে দিয়ে ভালো বলতেই হবে। আমি ছাতু মাখবো আর উনি অবজ্ঞা করে বলবেন, এতই কি ভালো, এও সহ্য করতে হবে বিশ্বকবির?” ছাতু মাখিয়ে বলে রবীন্দ্রনাথের যে প্রশ্নাতীত সুনাম তা কি আজ ধুলোয় মিশে যাবে মাসীর জন্য? । আজকের মাখাটা মাসীর ভালো লাগে নি, এতে তিনি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, খুবই ব্যাথিত হয়েছেন। ঠিক হল, আগামীকাল আবার ছাতু মেখে  মাসীর কাছে রবীন্দ্রনাথের নিজের যোগ্যতা প্রমান করবেন। মাসীর সার্টিফিকেট তাঁর চাইই।

পরেরদিন সুব্রতা আর মৈত্রেয়ী দেবী দুজনে সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে, যব ভেজে, যাঁতায় গুঁড়ো করে ছাতু তৈরি করে রেখেছিলেন। বিকালে রোজকার মত সুব্রতা দেবী বেড়াতে বেরিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। মাসী বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথ আবার ছাতু মাখতে শুরু করলেন।  তবে দুষ্টুমি করে কিছুটা মাখলেন খারাপ করে, যাতে মুখে দিলেই কড়কড় করে, খেতে বিস্বাদ লাগে। বাকিটা হল সুন্দর মসৃণ আর সুস্বাদু। মৈত্রেয়ী অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘আজ আর কিছুতেই বলতে পারবে না ভালো হয়নি। দেখো যত কড়কড় করুক, হাসিমুখে বলবে এতো অতি উত্তম’

ঠিক তাই। একটু পরে মাসী ফিরে এলেই  রবীন্দ্রনাথ হাসিমুখে তাঁকে ছাতুর প্লেট এগিয়ে দিলেন। দিলেন সেই কড়কড়ে করা খারাপ মাখাটা। উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলেন তাঁর মুখের দিকে। আসলে সুব্রতা দেবীকে পরীক্ষা করবার জন্যই রবীন্দ্রনাথ এই কান্ডটা করেছিলেন। মাসী প্লেটের ঢাকনা খুলে চামচে করে একটু মুখে দিয়ে, যেন অসাধারণ হয়েছে এমন ভাব করে বললেন, ‘বাঃ দারুন। আজ তো খুবই চমৎকার হয়েছে,  কালকের চেয়ে ঢের ভালো’

মাসীকে অপ্রস্তুত করে রবীন্দ্রনাথ আর মৈত্রেয়ী দেবী হো হো করে হেসে উঠলেন। মাসী বুঝতে পারলেন যে নিজের বোকামীতে তিনি নিজেই ফেঁসে গিয়েছেন। আগেরদিন সত্যি কথা বললেও আজ ছাতুমাখার যে মিথ্যে সুনাম করেছেন সেটা রবীন্দ্রনাথ ধরে ফেলেছেন।

আসলে মেয়েরা এমনিই, এমনি করেই তারা প্রিয়জনের মন দখল করেন। তাদের দুঃখ দিতে চান না, এজন্য মিথ্যা বলায় তারা দোষের কিছু দেখেন না। প্রিয়জনের মুখ চেয়ে, তাদের দেওয়া উপহার বা যেকোনো জিনিস, ভালো না লাগলেও, মুখে বলবে ‘খুব ভালো, চমৎকার’। এ অভিনয় মেয়েদের একান্ত নিজস্ব। কাল মাসী কবির ছাতুমাখার সমালোচনে করেছিলেন, সেটা ছিল তার চরিত্রবিরোধী কাজ। আজ ‘খারাপ মাখা’র প্রশংসা রমণীচরিত্রের  সঠিক পরিচয়।

তুমি খুশি থাকো আমার পানে চেয়ে চেয়ে

অবশেষে রবীন্দ্রনাথের  ‘ভালো করে মাখা ছাতু’র প্লেটটা শেষ করে  সুব্রতা দেবী বিড়ম্বনায় থেকে রেহাই পেলেন।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

Please rate this

Join the Conversation

3 Comments

  1. প্রতিদিন আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি এসব অসাধারণ গল্প পড়ে

  2. প্রতিটি ব্লগে আমাদের প্রিয় আপনি আরও কাছে এনে দিচ্ছেন। কাজটি সহজ নয়। আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি। ধন‍্যবাদ আপনাকে।

Leave a comment

Leave a Reply to Satyendu Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *