জোড়াসাঁকো নাট্যশালা 4.57/5 (7)

জোড়াসাঁকো নাট্যশালা

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ। সূচনা হয়েছে বাংলার নবজাগরণের ইতিহাস। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ একগুচ্ছ যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী মনীষীর  উদ্দ্যোগে বাংলার শিক্ষা-সাহিত্য-রাজনীতির দ্রুত পট পরিবর্তন ঘটতে লাগল। আর সেই কর্মযজ্ঞের অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। একের পর এক নতুন নতুন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকল কবিতা-গান-প্রবন্ধ-গল্প-সমালোচনা এবং আরও অনেক সাহিত্য-মণিমুক্তা। সেই মহেন্দ্রক্ষণে সূচনা হয়েছিল বাংলা থিয়েটারের উত্থান। ইংরেজি থিয়েটারের হাত ধরে সবে তার হাঁটি হাঁটি পথ চলা, এখানে ওখানে থিয়েটার চর্চা আর মঞ্চায়ণ। আর সেই আবহেই ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’-র সূচনা আর তা নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা।

রাজা রামমোহন রায়

রবীন্দ্রনাথের ছোটোবেলায় জোড়াসাঁকোর পরিবেশ ছিল ‘আনন্দরসে পরিপূর্ণ’। ওস্তাদেরা আসতেন গান শোনাতে, বস্‌ত যাত্রার আসর, নাচগানে ঝলমল করত বৈঠকখানা বাড়ি। গুণেন্দ্রনাথ আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘কিম্ভুতমার্কা নাটক’ লিখে মহা উৎসাহে তার মহড়া দিতেন সেই বাড়ির দালানে। আর মহর্ষিভবনের দোতলা থেকে শিশু রবীন্দ্রনাথ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন সেইসব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার দিকে।

সালটা ১৮৬৫। রবীন্দ্রনাথের বয়স সবে তিন বছর। বাংলা থিয়েটারের সেই ঊষাকালে দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত নামজাদা লেখকদের নাটক জনসাধারণের মধ্যে অসীম আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘গোপাল উড়ের যাত্রা’ তেমনই একটি হাস্যরসাত্মক রচনা। তৎকালীন কলকাতায় অনেক ধনী বাড়িতেই থিয়েটারের দলকে আমন্ত্রণ জানানো হত নিছক বিনোদনের উদ্দেশে। সেবার জোড়াসাঁকোতেও বসেছিল গোপাল উড়ের যাত্রার আসর। আর সেই নাটক দেখেই উৎসাহিত হয়ে বাড়ির পাঁচজন তরুণ প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’ নামে একটা নাটকের দল। যদিও প্রথমে এর পরিচয় ছিল ‘শখের থিয়েটার’ হিসাবেই। এই পাঁচজন হলেন গুণেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কৃষ্ণবিহারী সেন, অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী আর সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।

যাত্রাপালা

ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে থিয়েটারের যোগবন্ধনের শুরু অনেক আগে, সেই দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই। তিনি ছিলেন ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’ এবং সাঁ-সুসি থিয়েটার’এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। নানা সময়ে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়িতেও নাটকের আসর বসত। সেখানে মহা সমারোহে অভিনয় হত মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ ইত্যাদি নাটকের।

গোপাল উড়ের যাত্রা দেখবার পরের দিন সকালে, প্রাতঃরাশের আড্ডায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের ডেকে নিজের ভাবনা অর্থাৎ নতুন থিয়েটারের দল তৈরির কথাটা পাড়লেন। প্রস্তাবে সায় দিয়ে সবাই হৈ হৈ করে উঠলেন। নামকরণও হয়ে গেল সাথে সাথে। প্রসঙ্গত জোড়াসাঁকো নাট্যশালার উদ্দ্যোক্তা পাঁচজনকে বলা হত ‘কমিটি অফ ফাইভ’। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক দিয়েই শুরু হল জোড়াসাঁকো নাট্যশালার পথ চলা। এই নাটকে অহল্যাবাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দর্শকদের কাছ থেকে বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। এরপরের নাটক মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ও  অত্যন্ত  গৌরবের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল।

মধুসূদন দত্ত

দুটি নাটকের সফল মঞ্চায়নের পরে নতুন নাটকের খোঁজে, ‘ইণ্ডিয়ান ডেইলি নিউজ’ পত্রিকায় ১৮৬৫ সালের ২২ জুন একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। সেখানে বহুবিবাহ প্রথাকে অবলম্বন করে একটা ‘নাটক-রচনা প্রতিযোগীতা’র আহ্বান করে ঘোষণা করা হয়েছিল যে  নির্বাচিত নাটকের লেখককে দুশো টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু কোনো কারণে উদ্যোক্তারা এই অভিনব প্রতিযোগীতা বাতিল করে তৎকালীন প্রসিদ্ধ নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্নকে নতুন নাটক লেখার দায়িত্ব দিলেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন কিছুদিনের মধ্যেই বহুবিবাহ-সহ নানা সামাজিক কুপ্রথাকে অবলম্বন করে রচনা করলেন নব-নাটক  শিরোনামের লোকশিক্ষা-মূলক নাটকটি। 

১৮৭৩ সালের বৈশাখ মাসে ‘নব-নাটক’এর অভিনয় জোড়াসাঁকো নাট্যশালার অন্যতম কীর্তি। সাত আট মাস ধরে মহাসমারোহে নাটকের মহড়া চলেছিল। নানা চরিত্রে অংশ নিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবেরা। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মনে পড়ে, খুব যখন শিশু ছিলাম বারান্দার রেলিং ধরিয়া এক একদিন সন্ধ্যার সময় চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতাম। সমুখের বৈঠকখানাবাড়িতে আলো জ্বলিতেছে, লোক চলিতেছে, দ্বারে বড়ো বড়ো গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইতেছে। কী হইতেছে ভালো বুঝিতাম না, কেবল অন্ধকারে দাঁড়াইয়া সেই আলোকমালার দিকে তাকাইয়া থাকিতাম। মাঝখানে ব্যবধান যদিও বেশি ছিল না, তবু সে আমার শিশুজগৎ হইতে বহুদূরের আলো।’

বৈঠকখানা বাড়ির দোতলায় মঞ্চস্থ নাটকের স্টেজটাকে সাজানো হয়েছিল বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা নানা ধরণের ছবি, রঙিন কাপড়, ফুল আর লতাপাতা দিয়ে। ছিল দেওয়ালে গেঁথে রাখা জীবন্ত জোনাকির মালা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপরে ভার পড়েছিল কনসার্ট বাজানোর আর নটীর ভূমিকায় অভিনয় করবার। অন্যান্য চরিত্রাভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন অক্ষয় মজুমদার, নীলকমল মুখোপাধ্যায়, যদুনাথ মুখোপাধ্যায় এবং অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়। তখনকার দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী মেয়েদের ভূমিকাতে ছেলেরাই অভিনয় করেছিলেন। শোনা যায়, তাঁদের সাজপোশাক এতটাই নিখুঁত হয়েছিল যে সাহেবরা পর্যন্ত তাঁদের মেয়ে ভেবে ভুল করেছিলেন। অসাধারণ কমেডিয়ান অক্ষয়কুমার মজুমদার অভিনয় করেছিলেন নাটকের মুখ্যচরিত্র গবেশবাবুর ভুমিকায়।

সেবার হয়েছিল আর এক কাণ্ড। প্রথমদিন, মেয়েদের ভূমিকায় যেসব ছেলেদের অভিনয় করবার কথা ছিল, স্টেজে নামবার আগে দর্শকদের মুখোমুখি হবার ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। দু’একজন তো মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। শেষে পারিবারিক ডাক্তার দ্বারিকবাবুকে ডেকে আনা হল তাঁদের চাঙ্গা করে তোলবার জন্য। নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল বৈঠকখানা বাড়ির বাগানে। মেয়েরা জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে দেখতেন সেই অভিনয়। নবনাটকের প্রধান চরিত্র গবেশবাবুর চরিত্রাভিনেতা অক্ষয় মজুমদারকে এক বৃদ্ধ দর্শকের কাছে যাচ্ছেতাই কথা শুনতে হয়েছিল। কারণ নাটকে ছিল গবেশের স্ত্রী আত্মহত্যা করবেন, নাটকের রসে বুঁদ বৃদ্ধ ভেবেছিলেন সত্যিই গবেশবাবু তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলেছেন। 

তবে নাটকটি এতই উচ্চাঙ্গের হয়েছিল যে সভাপতি প্যারীচাঁদ মিত্র লেখককে পাঁচশ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো নাট্যশালার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। টানা নয় রাত্রি এই নাটক অভিনীত হয়েছিল। তবে এই নাটকের নবম তথা শেষ অভিনয়টি হয়েছিল জোড়াসাঁকোর বদলে ব্যারিষ্টার জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়িতে। সমাজের বহু গণ্যমান্য দেশিবিদেশি অতিথিকে নাটক দেখবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ছিল অসামান্য আতিথেয়তা আর নৈশভোজের ব্যবস্থা। 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নাট্যশালার কাজে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তাদের সতর্ক করে লিখেছেন, ‘তোমাদের নাট্যশালার দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছে – সমবেত বাদ্য দ্বারা অনেকের হৃদয় নৃত্য করিয়াছে – কবিত্ব রসের আস্বাদনে অনেকে পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছে। নির্দ্দোষ আমোদ আমাদের দেশের যে একটি অভাব, তাহা এই প্রকারে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হইবে। পূর্ব্বে আমার সহৃদয় মধ্যমভায়ার উপরে ইহার জন্য আমার অনুরোধ ছিল, তুমি তাহা সম্পন্ন করিলে। কিন্তু আমি স্নেহপূর্বক তোমাকে সাবধান করিতেছি যে, এ প্রকার আমোদ যেন দোষে পরিণত না হয়।’ এরপর ১৮৬৭ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বোম্বাই চলে গেলে জোড়াসাঁকো নাট্যশালার আয়ু দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। 

Please rate this

Join the Conversation

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগছে। বাংলা রঙ্গমঞ্চের সূচনাপর্বের এই ইতিহাস আজকের পাঠকের কাছে তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনি করছেন, ধন্যবাদ । আমাদের সংস্কৃতিচর্চায় ক্লাব কালচারের যে সদর্থক ভূমিকার পরিচয় এইধরনের উদ্যোগ ও পারিবারিক আড্ডা ,সমিতির কাজে পাওয়া যায় তা আজ ফিরে দ্যাখা খুবই দরকার।
    আপনার আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই ॥

  2. নতুন করে আবার সব জানলাম। অনেক আগে পড়া ও জানা বিষয় বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছিল। আপনার লেখায় তা আবার সামনে এল। আপনার অসামান্য পরিশ্রমকে কুর্নিশ। ধন‍্যবাদ।

Leave a comment

Leave a Reply to Pranati Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *