আজকের লেখায় একটি তথ্যগত ভুল আছে। সেটি কি?
অয়ি ভুবনমনোমোহিনী
১৮৮৫ সালের ২৫ ডিসেম্বরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের যাত্রার শুরু থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে কংগ্রেসের নিবিড় সম্পর্ক। সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় তো রীতিমতো চাঁদা দিয়ে কংগ্রেসের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকেও কংগ্রেসের নানা অধিবেশনে সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে। দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৭ সালে নাটোরে প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতি হয়েছিলেন। তাই ১৮৯৬ সালে যখন স্থির হল যে যখন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ অধিবেশন হবে কলকাতার বিডন স্কোয়ারে, তখন রবীন্দ্রনাথও এতে সামিল হতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চার দিনের অধিবেশন শুরু হয়েছিল ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখে রহমাতুল্লা সাহানির (১৮৪৭-১৯০২) সভাপতিত্বে। বিডন স্কোয়ারের সভায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ সহ ঠাকুরবাড়ির প্রায় ১২ জন সদস্য আংশগ্রহণ করেছিলেন।
এই সময়েই একটি অপ্রিয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে, রবীন্দ্রনাথের নিতান্ত অনিচ্ছায় সৃষ্টি হয়েছিল স্বদেশ পর্যায়ের অয়ি ভুবনমনোমোহিনী গানটি। অনুষ্ঠানের আগে একদিন হেমচন্দ্র মল্লিক ও বিপিন পাল রবীন্দ্রনাথকে এমন একটা গান লিখে দিতে অনুরোধ করলেন যাতে ‘দুর্গামূর্তির সঙ্গে মাতৃভূমির দেবীরূপটি’ মিলে যায়। তাঁরা শারদীয়া পূজাটিকে নতুনভাবে প্রচলন করতে চান আর সেইজন্যই একটি ভক্তি-উদ্দীপনা মূলক গানের খুব প্রয়োজন। আমরা জানি রবীন্দ্রপরিবার ব্রাহ্ম, নিরাকার ঈশ্বরের পূজারী। তাঁর পক্ষে এই অনুরোধ রাখা অসম্ভব। পুলিন বিহারী সেনকে লিখেছেন, ‘আমি অস্বীকার করে বলেছিলুম এ ভক্তি আমার আন্তরিক হতে পারে না, সুতরাং এতে আমার অপরাধের কারণ ঘটবে। বিষয়টা যদি কেবলমাত্র সাহিত্যক্ষেত্রের অধিকারগত হত তাহলে আমার ধর্মবিশ্বাস যাই হোক আমার পক্ষে তাতে সংকোচের কারণ থাকত না’। ফলে রবীন্দ্রনাথের লেখা অয়ি ভুবনমনোমোহিনী গানটি তাঁদের পছন্দ হয় নি।
ডিসেম্বরের কংগ্রসের সভায় অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে এই গানটি গাইতে দেখা যায়নি, বরং অনুষ্ঠানের শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম গানের প্রথম দুটি ছত্র নিজের দেওয়া সুরে গেয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ পিতৃস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘অধিবেশনের আরম্ভে বাবা একা এই গান গাইলেন, সরলাদিদি সঙ্গে অর্গান বাজিয়েছিলেন। তখন মাইক প্রভৃতি যন্ত্র আবিস্কৃত হয়নি। বাবার গলা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই প্যাণ্ডেলের বিপুল জনতার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পরিষ্কার শোনা গিয়েছিল।
এই গানটি সম্পর্কে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, ‘জোড়াসাঁকোর বাড়িতে (পৌষ ১৩০৩) কংগ্রেসের অভ্যাগতগণ আমন্ত্রিত হন। সেখানে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরও উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই অনুষ্ঠানে গানটি গাহিয়াছিলেন’। যদিও শ্রী প্রশান্ত পাল এই তথ্যটিকে ভুল প্রমাণ করেছেন।
১৯১৯ সালের অক্টোবরে তিন দিনের জন্য রবীন্দ্রনাথ গৌহাটিতে ছিলেন। তিনি সবে তাঁর নাইটহুড ত্যাগ (৩০ মে ১৯১৯) করেছেন। সেই সময়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে কার্জন হলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রতিভাষণের শেষে তাঁকে একটি গান গাইতে অনুরোধ জানালে প্রথমে ভগ্ন-কণ্ঠের দোহাই দিয়ে তিনি এড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবার একান্ত ইচ্ছায় অবশেষে কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গে গাইলেন অয়ি ভুবনমনোমোহিনী।
———-
অন্যান্য তথ্য | রচনা ডিসেম্বর ১৮৯৬ | রচনাস্থান কলকাতা | কবির বয়স ৩৫ বছর | স্বদেশ পর্যায় স্বরলিপিকার সরলা দেবী | কল্পনা কাব্যগ্রন্থে ভারতলক্ষ্মী শিরোনামে সংকলিত | ১৯০৫ সালে পি সে বোস কোম্পানী থেকে নিকোল রেকর্ডে এই গানটি রবীন্দ্রনাথ রেকর্ড করেন। এটিই সম্ভবত রবীন্দ্র-গানের সর্বপ্রথম রেকর্ড।
Sanibarer Blog is all about Rabindranath Tagore Songs Recitations Rabindra Sangeet done by Purnendu Bikash Sarkar
মার্চ, ১৯০৬ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ” অয়ি ভুবনমনোমোহিনী ” গানটি এইচ বসু ( সিলিন্ডার রেকর্ড ) রেকর্ড করেন ।
১৩০৩ বঙ্গাব্দে (1896) প্রভাতকুমার বর্ণিত জোড়াসাঁকোতে দ্বারকানাথ ও গান্ধিজীর উপস্থিতি বোধহয় ঠিক নয়। কারণ, প্রথমজন তখন গত, এবং দ্বিতীয়জন ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন নি।
খুব ভালো লাগলো দাদা.. অনেক অনেক ধন্যবাদ…😊🙏
‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী’ গানটি সম্পর্কে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় যে তথ্য দিয়েছেন সেটি ঠিক নয়। কংগ্রেসের অভ্যাগতগণ জোড়াসাঁকোয় আমন্ত্রিত হন ঠিকই কিন্তু সেখানে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর উপস্থিত ছিলেন না। কারণ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং দ্বারকা নাথ ঠাকুর প্রয়াত হয়েছেন ১লা আগষ্ট ১৮৪৬। কিন্তু ঘটনাটি ১৩০৩ বঙ্গাব্দ বা ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুষ্ঠানে গানটি গাহিয়াছিলেন।’ কিন্তু এককভাবে গান নি। এই গানটি যাঁরা সমবেত কন্ঠে গেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। তিনি লিখেছেন –
“প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে কলিকাতায় একবার কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। ভারতের নানা প্রদেশ হইতে বহুসংখ্যক প্রতিনিধিরা আসিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁহাদিগকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। প্রবাসীরা বাংলা জানেন না, অন্তত প্রাঞ্জল প্রচলিত বাংলা বোঝেন না অথচ অনেকেই সংস্কৃত জানেন; তাই সংস্কৃতবহুল একটি ভারত-সংগীত রচনা করিয়াছিলেন।তিনি নিজে আমাদের অনেককে সেই গানটি শিখাইয়াছিলেন। মনে আছে বহুকন্ঠে ও বহু বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আমরা সেই গানটি গাহিয়াছিলাম। আমাদের সকলকেই – পুরুষ ও মহিলা – শুভ্রবসন পরিধান করিতে হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে আমাদের নেতা। …….”
‘জোড়াসাঁকোর বাড়িতে(পৌষ ১৩০৩) কংগ্রেসের অভ্যাগতগন আমন্ত্রিত হন।সেখানে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরও উপস্থিত ছিলেন’। গান্ধী উপস্থিত ছিলেন কিন্তু দ্বারকানাথ উপস্থিত ছিলেন না। এই তথ্যটি ভূল। পৌষ১৩০৩ মানে ইংরেজি সাল ডিসেম্বর ১৮৯৬। দ্বারকানাথ ঠাকুর মারা গিয়েছিলেন ১৮৪৬ সালের ১লা আগস্ট মাত্র ৫১ বছর বয়সে।
এই ব্লগে আমি নবাগতা।নানা তথ্য পাঠ পড়ে সমৃদ্ধ হচ্ছি।
নমস্কার, শনিবারের ব্লগে আপনাকে স্বাগত। প্রতি প্রতি শনিবারের সকালে নতুন লেখা পোষ্ট করা হয়। ব্লগের লেখা ছাড়াও এখানে Quiz contest, গান, ভিডিও ইত্যাদি বিনোদন-মূলক পোষ্টও থাকে।
আশা করি আপনাকে নিয়মিত পাশে পাব। সম্ভব হলে বন্ধুদেরও জানাবেন। আর অবশ্যই ক্যুইজের প্রশ্নগুলির উত্তর দেবেন। শুভেচ্ছা নেবেন।
ডাঃ পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার