মৃত্যু মিছিল ২ 5/5 (1)

দ্বিতীয় পর্ব

বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (৬ নভেম্বর ১৮৭০ – ১৯ আগস্ট ১৮৯৯)

বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্মের সময়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। সম্পর্কে ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের বিশেষ  প্রীতিভাজন ছিলেন। বলেন্দ্রনাথ ‘ঠাকুর এন্ড কার কোম্পানীর’ অন্যতম অংশীদার ছিলেন। এছাড়া ‘বালক’ পত্রিকার সম্পাদনা, ব্রাহ্মসমাজের নানা দায়িত্ব পালন ইত্যাদির পরিশ্রম ও দুশ্চিন্তায় দুর্বল স্বাস্থ্য বলেন্দ্রনাথ ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একবার শিলাইদহে হিসাবপত্র সামলানোর কাজে এতই ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল যে নাওয়াখাওয়ার সময় ছিল না। সেই অনিয়ম আর অত্যাচারে কানের যন্ত্রণা বেড়ে গিয়ে জ্বরের কবলে পড়েন। স্থানীয় চিকিৎসায় কাজ না হওয়ায় তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। সে সময় রথীন্দ্রনাথও অসুস্থ ছিলেন। দুজনেরই  রোগ পরিচর্যার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বহু ডাক্তারের সম্মিলিত চিকিৎসা সত্বেও বলেন্দ্রনাথের শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হতে লাগল , জ্বরের সঙ্গে দেখা দিল নানা উপসর্গ। অবশেষে সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৮৯৯ সালের ১৯ আগস্ট মাত্র ২৯ বছর বয়সে বলেন্দ্রনাথ অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন।

বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর

বলেন্দ্রনাথের মা প্রফুল্লময়ী দেবী তাঁর ছেলের মৃত্যু-বর্ণনায়  লিখেছেন, ‘যেদিন সে জন্মের মত আমাকে তাহার বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া চলিয়া গেল, সেইদিন রবি (আমার ছোট দেওর) আসিয়া আমাকে বলিলেন তুমি একবার তার কাছে যাও, সে তোমাকে মা মা করিয়া ডাকিতেছে। আমি এক এক সময় তাহার যন্ত্রণা দেখিতে না পারিয়া পাশের ঘরে গিয়া বসিয়া থাকিতাম। রবির কথা শুনিয়া যখন তার কাছে গিয়া তার পাশে বসিলাম তখন তার সব শেষ হইয়া আসিয়াছে। মনে হইল আমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিল, তাহার পর একবার বমি করিয়া সব শেষ হইয়া গেল। তখন ভোৱ হইয়াছে। সূর্যদেব ধীরে ধীরে তাঁহার কিরণচ্ছটায় পৃথিবীকে সজীব করিয়া তুলিতেছিলেন, ঠিক সেই সময় তাহার দীপ নিভিয়া গেল’।  বলেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল।

নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১ ডিসেম্বর ১৮৬৭ – ১২ সেপ্টেম্বর ১৯০১)

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র নীতিন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র,  ডাকনাম নিতু। ঠাকুরবাড়ির গৃহসজ্জা, বিভিন্ন নাটকের মঞ্চসজ্জা, শিলাইদহের কুঠিবাড়ি পরিকল্পনা ইত্যাদিতে তাঁর কৃতিত্বের ছাপ রয়েছে। ১৯০০ সালের মাঝামাঝি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সম্ভবত তিনি  ‘লিভার সিরোসিস’ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের জরুরি কাজ ফেলে কলকাতায় ছুটে এসে দিনরাত রোগীর শিয়রে বসে সেবাশুশ্রূষা করেছেন। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের নাওয়াখাওয়া, নিজের দিকে তাকানোর কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। কিছুদিন পরে নীতীন্দ্রনাথ একটু সুস্থ হলে বিলেতে জগদীশচন্দ্রকে লিখলেন, ‘আমার একটি ভ্রাতুস্পুত্র সাংঘাতিক পীড়ায় আক্রান্ত বলিয়া আমি কলিকাতায় আসিয়াছি।  প্রায় আট রাত্রি ঘুমাইতে অবসর পাই নাই তাই আজ মাথার ঠিক নাই শরীর অবসন্ন । কাল হইতে তাহার বিপদ কাটিয়াছে বলিয়া আশ্বাস পাইয়াছি। এখন নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবার সময় আসিয়াছে । মনে করিয়াছি দুই-চারি দিন বোলপুর শান্তিনিকেতনে যাইব’।

সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবী শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ছাত্রদের হোস্টেল, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত। নিদারুণ অর্থাভাবের জন্য মৃণালিনী একটি একটি করে নিজের গয়না বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারই মাঝে নীতীন্দ্রনাথের অসুখ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উদ্বেগের অন্ত  নেই। ১৯০১ সালে আগস্ট মাসে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হল। খ্যাতনামা চিকিৎসকরা একযোগে অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি আর কবিরাজি চিকিৎসা, এমনকি শরীরে অস্ত্রোপচার করেও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। ১৯০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রাত দুটোর সময় ঈশ্বর তাঁকে  অনন্তলোকে আশ্রয় দিলেন। নীতীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রোগশয্যার পাশে থেকে পরিচর্যা করেছেন সান্ত্বনা দিয়েছেন। অসুখের কঠিন সময়ে লিখেছেন ‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়’ গান  আর ‘রোগীর শিয়রে রাত্রে ছিনু একা জাগি’ কবিতা।

মৃণালিনী দেবী

মৃণালিনী দেবী (১ মার্চ ১৮৭৪ – ২৩ নভেম্বর ১৯০২)

১৯০১ সালে ব্রহ্মাচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতনে চলে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের তখন তীব্র আর্থিক অনটন। বিদ্যালয়ের নতুন বাড়ি, হোস্টেল নির্মাণ, আসবাবপত্র, পাঠাগার তৈরি করা, ছেলেদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা, শিক্ষক নিয়োগ নানা কাজে রবীন্দ্রনাথের একেবারে জেরবার অবস্থা। স্বামীর কর্মযজ্ঞে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী।  কাজের বিরাট অংশ তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। একে একে সমস্ত গয়না বিক্রি করে দিলেন রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন- প্রকল্পের খরচের জন্য। দুর্বল অপুষ্ট শরীরে এত পরিশ্রম সহ্য হল না। ১৯০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নতুন বিদ্যালয়ের কাজে রবীন্দ্রনাথ তখন চুড়ান্ত ব্যস্ত, একমুহূর্ত বিশ্রামের অবকাশ নেই। তারই মধ্যে স্ত্রীর চিকিৎসা শুরু হল সাধারণ অসুখ ভেবে। কিন্তু দিনে দিনে রোগের তীব্রতা বাড়তে থাকায় ২৭ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ মৃণালিণীকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। জোড়াসাঁকোর লালবাড়ির দোতলায় মৃণালিণীর রোগশয্যা। তখনকার নামকরা চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টাতেও তেমন সুফল হল না। স্ত্রীর সেবাযত্নের সমস্ত ভার রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে তুলে নিলেন। পরে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার এখন সন্দেহ হয় তাঁর অ্যাপেণ্ডিসাইটিস হয়েছিল। তখন এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা ছিল না, অপারেশনের প্রণালীও আবিষ্কৃত হয়নি। তখনও কলকাতায় বিদ্যুতের প্রচলন হয় নি’। রবীন্দ্রনাথ হাতপাখা নিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত স্ত্রীকে অবিচলভাবে বাতাস করে তাঁকে একটু আরাম দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এত চেষ্টার পরেও ধরে রাখা গেল না। ১৯০২ সালে ২৯ নভেম্বর মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে ঊনিশ বসন্তের দাম্পত্যজীবনের ইতি ঘটিয়ে মৃণালিণী অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন। রেখে গেলেন পাঁচ ছেলেমেয়ে আর একচল্লিশ বছরের নিঃসঙ্গ কবিকে।

রথীন্দ্রনাথের লেখায়, ‘বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাক্‌রোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা। আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরানো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন । একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারা রাত জেগে কাটল । ভোরবেলায় অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সেরাত্রেও রবীন্দ্রনাথ ঘুমোতে পারেন নি, একাকী নির্জন ছাদে সারারাত পায়চারি করেছেন, অন্তরে বয়ে চলেছে ঝড়। পরদিন স্ত্রীর সদাব্যবহৃত চটিজোড়া রথীন্দ্রনাথকে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম’। তবে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথের মনে ও ব্যবহারে যে অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল, মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু কবি অনেক শান্ত ভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর কথায় ‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়াছেন সেই শোককে তিনি নিষ্ফল করিবেন না – তিনি আমাকে শোকের দ্বারা মঙ্গলের পথে উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন’। তাছাড়া নাবালক সন্তানদের লালনপালন, শান্তিনিকেতনের কাজের ব্যস্ততায়, ঋণের বোঝায় তখন তাঁর এক মুহূর্ত  অবসর ছিল না। পত্নী বিয়োগের পরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ আর কিছু গান। তবে কাদম্বরী দেবীর মত মৃণালিণীর মৃত্যু-শোক রবীন্দ্রনাথের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।

রেণুকা দেবী (২৩ জানুয়ারি ১৮৯১-১৪ সেপ্টেম্বর ১৯০৩)

মৃণালিনী দেবীর অসুখের  মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের অক্টোবর মাস থেকেই মেজো মেয়ে রেণুকা আর ছোটো মেয়ে মীরা দুজনে একই সঙ্গে আসুস্থ হয়ে পড়েন। রেণুকা বরাবরই রুগ্ন। প্রথমে অল্প অল্প জ্বর, খুসখুসে কাশি আর সোরথ্রোট  দিয়ে শুরু হলেও কিছুদিন পরে তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছাল। তখন চিকিৎসকের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৩ সালে মার্চ মাসে তাঁকে হাজারিবাগে নিয়ে যান স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায়। কিন্তু অসুখের কোনো উন্নতি না হওয়ায় ঠিক হল তাঁকে এবার আলমোড়ায় নিয়ে যাওয়া হবে। ততদিনে জানা গিয়েছে রেণুকার অসুখটি কালব্যাধি যক্ষারোগ, যার  চিকিৎসা তখন একেবারেই অজানা ছিল। বৈশাখ মাসের ২১ তারিখে (৪ মে ১৯০৩) শান্তিনিকেতন থেকে যাত্রা করে, পথে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগের পর, আলমোড়া পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মোগলসরাই যখন পৌঁছান গেল ষ্টেশনমাষ্টার বললেন আমাদের গাড়ি মেলে যাইবে না, প্যাসেঞ্জারে জুড়িয়া দিবেন। … যে সময় বেরিলি পৌঁছিবার কথা তাহার বারো ঘণ্টা পরে পৌছিলাম। সেখানে একদিনও অপেক্ষা না করিয়া সেইদিনই কাঠগোদামে আসিতে হইল – সেখানে না পাইলাম থাকিবার জায়গা, না পাইলাম আলমোড়া-যাত্রার কুলি -সেই দ্বিপ্রহর রৌদ্রে অনাহারে রেণুকাকে লইয়া এক্কায় চড়িয়া রাণীবাগ নামক এক জায়গায় ডাকবাংলায় গিয়া কোনমতে অপরাহে আহারাদি করা গেল। যাহা হউক পথের সমস্ত কষ্ট বর্ণনা করিয়া কি হইবে? কোনপ্রকারে গম্যস্থানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি-রেণুকার জ্বর বাড়িয়াছে, কিছুদিন বিশ্রামের পর এখানকার জলবায়ুর ফলাফল বুঝা যাইবে’

আলমোড়ার জল হাওয়ায় প্রথমদিকে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও আগস্ট মাসে শুরু হল যমে-মানুষে টানাটানি। আর সময় নষ্ট না করে রবীন্দ্রনাথ মেয়েকে নিয়ে ২৯ আগস্ট কলকাতায় ফিরে আসেন। ফেরবার সময়েও পথের দুর্দশা রবীন্দ্রনাথের পিছু ছাড়ে নি। কলকাতায় রেণুকার অবস্থা দিনদিন অবনতি হচ্ছিল।  রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, আর কোনো আশা নেই, সে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। ডাক্তারের আনাগোনা বাড়ল, রোগীর গায়ে রোদ লাগাবার জন্য লাল বাড়ির তিন তলায় তৈরি করা হল কাঁচের ঘর। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যার্থ করে ১৯০৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মাত্র এগারো বছরের জীবনে ইতি  ঘটিয়ে মরণের ডাকে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথের আদরের রানী চিরবিদায় নিলেন।  রবীন্দ্রনাথ এই মৃত্যুকে অত্যন্ত শান্তভাবে, স্থৈর্যের সঙ্গে মেনে নিয়েছিলেন। রোজকার জীবনে এর কোনো প্রভাব পড়ে নি। মেয়ের মৃত্যুর দিনেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার শেষে রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী যখন রেণুকার অসুখের কথা জিজ্ঞাসা করলেন, কবি শুধু শান্তভাবে বলেছিলেন, ‘সে আজই মারা গিয়েছে’।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকু

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৫ মে ১৮১৭ – ১৯ জানুয়ারি ১৯০৫)

রবীন্দ্রনাথের জীবনে চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে দেবেন্দ্রনাথে ভূমিকা অপরিসীম।  তিনি তাঁর ‘আত্মমগ্ন ভাবুক কণিষ্ঠ পুত্রের মধ্যে বিশেষ এমন কিছু দেখেছিলেন যা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই ‘নিজের ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে রেখে পুত্রের ব্যক্তিত্বের যথাযত উন্মেষ ঘটানোর আকাঙ্ক্ষায়’ সেই কিশোর বয়সে রবীন্দ্রনাথেকে তাঁর হিমালয় ভ্রমণের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন।

মধ্যজীবনের পর থেকেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর একটু একটু করে ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। ১৮৮৫ সালে, ৬৭ বছর বয়সে বোম্বাইয়ের বান্দোরা অঞ্চলের সমুদ্রতীরে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে কিছুদিন বাস করছিলেন। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন।  রবীন্দ্রনাথ তখন নাসিকে সত্যেন্দ্রনাথের বাসায় কাব্যরচনায় নিমগ্ন। পিতার অসুখের খবর শুনে তড়িঘড়ি চলে এসেছেন বান্দোরায়, আপ্রাণ সেবা করেও মহর্ষিকে সুস্থ করতে না পেরে নিয়ে এলেন  তাঁর চুঁচুড়ার বাড়িতে। সেখানে ১৮৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে রবীন্দ্রনাথ সমস্ত কাজ ফেলে বারবার চুঁচুড়ায় ছুটে গিয়েছেন অসুস্থ পিতার সেবাশুশ্রূষা করবার জন্য। পিতার এই কঠিন সময়ে রবীন্দ্রনাথের দিনগুলি কেটেছে অবর্ণনীয় মানসিক উদ্বেগে। সকলের মিলিত প্রচেষ্টা ও প্রার্থনায় ঈশ্বর মুখ তুলে চাইলেন, মহর্ষী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে নতুন জীবন ফিরে পেলেন, মহর্ষি ফিরে এলেন কলকাতায়। কিন্তু ১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে দেবেন্দ্রনাথ আবার ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তখন তাঁর  বয়স ৮৯ বছর। নানা শারিরীক সমস্যায় জর্জরিত, কোনো চিকিৎসাতেই আর সাড়া দিলেন না। ১৯ জানুয়ারি  দুপুর ১. ৫৫ মিনিটে তিনি পাড়ি দিলেন অনন্তলোকে।

দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর কারণে সে বছরের ৫৭তম মাঘোৎসবের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব হয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেছিলেন ‘যিনি এই গৃহের স্বামী ছিলেন, তাঁহার মত্যুতে এই গৃহের কর্মপ্রবাহ সহসা স্তব্ধ হইতে পারে, সংসারযাত্রায় সমস্ত রথচক্র সহসা অবরুদ্ধ হইতে পারে, পরিজনবর্গের উৎসাহ উল্লাস সহসা ম্লান হইতে পারে – কিন্তু এই গৃহস্বামী যাঁহাকে তাঁহার চিরজীবনের স্বামী বলিয়া বরণ করিয়াছিলেন, তাঁহার উৎসব তা লেশমাত্র ক্ষুগ্ন হইতে পারে না’।

শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১২ ডিসেম্বর ১৮৯৬ – ২৪ নভেম্বর ১৯০৭)

রবীন্দ্রনাথের আদরের কণিষ্ঠ পুত্র শান্তশিষ্ট শমীন্দ্রনাথ যেন রবীন্দ্রনাথেরই ছায়া। শান্তিনিকেতনের  ঋতু উৎসবের সূচনা তাঁরই হাত ধরে। কিন্তু সে ছিল বড়ই রুগ্ন। একবার শান্তিনিকেতনে লাইব্রেরির বই গোছাতে গিয়ে  তাঁর জ্বর হয়েছিল। মজার কথা হল, জ্বরজারি হলে সে কষে গান আর কাব্যালোচনা করত। ১৯০৭ রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন কলকাতায়। কনিষ্ঠা কন্যা মীরা  আর শমীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে। মীরা তখন বেশ অসুস্থ। পূজোর ছুটিতে  শমীকে কোথায় রাখবেন সেই চিন্তায় রবীন্দ্রনাথ খুব বিব্রত ছিলেন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক সুবোধচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে দিল্লী পাঠাবেন ভেবেও সরে আসেন। কারণ তখন সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ চলছিল। শেষে বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের শ্বশুরবাড়ি মুঙ্গেরে পাঠাবেন বলে তাঁকে চিঠি লিখে পাঠান। চিঠিতে কবি লিখেছিলেন, ‘শমী কোলকাতা পছন্দ করে না, সেখানে যেতেও চায় না অথচ ছুটিতে শান্তিনিকেতনে তাঁর একলা ঠেকে। শমী এত অল্প জায়গা জোড়ে এবং এত নিরুপদ্রব যে তার আগমনে তোমাদের মুঙ্গের সহরের শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা নেই।’ ১৬ অক্টোবর বিজয়াদশমীর দিন বন্ধু সরোজচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে শমীন্দ্রনাথ মুঙ্গেরে যান । কিন্তু নিয়তির  এমনই  নির্দেশ যে মুঙ্গের থেকে তাঁর আর  ফিরে আসা হল না।

নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি মুঙ্গের থেকে খবর এল শমী খুব অসুস্থ, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। ১৭ নভেম্বর একজন চিকিৎসককে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মুঙ্গের রওনা হন। বন্ধু ভূপেন্দ্রনাথ ও শ্রীশবাবুও পৌঁছে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন চিকিৎসায় একটু উন্নতি হলেই তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সে আশা আর পূর্ণ হল না। অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি সব চিকিৎসা বিফল করে ২৪ নভেম্বর রাতেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে গেল মাত্র এগারো বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ সে সময় পাশের ঘরে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। এই কঠোর মৃত্যুশোকে তাঁর দুচোখে অশ্রুর ধারা নেমে এল, নিঃশব্দে, কোনোরকম বহিঃপ্রকাশ ছাড়াই। পরবর্তীকালে মীরা দেবীকে লেখা চিঠিতে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর স্মরণে লিখেছেন, ‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে । শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি – সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল । যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। যা ঘটেচে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে’। এই চিঠি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনার এক দলিল হয়ে রয়েছে। কাদম্বিনী দত্তের চিঠির উত্তরে লিখেছেন, ‘ঈশ্বর আমাকে বেদনা দিয়াছেন কিন্তু তিনি তো আমারে পরিত্যাগ করেন নাই – তিনি হরণও করিয়াছেন পূরণও করিবেন। আমি শোক করিব না – আমার জন্যও শোক করিও না’। ১৩ ডিসেম্বর তিনি রচনা করলেন একটি সংগীত ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে’। সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে শোককে জয় করবার প্রার্থনা।

(আমার সদ্য প্রকাশিত দিনগুলি তাঁর বই থেকে পুনর্লিখিত। প্রকাশক বইওয়ালা ব্যুক ক্যাফে শান্তিনিকেতন) 

আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত

Please rate this

Join the Conversation

1 Comment

  1. এত অল্প সময়ের মধ্যে এত গুলি মৃত্যু আমার শরীর মন মস্তিষ্ক অবস হয়ে আসছিল। সম্পূর্ন পড়া হলো না। তাই চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

Leave a comment

Leave a Reply to রঞ্জন কুমার সরকার। Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *