ফিরতি পথ
টেমস জাহাজ ফিরতি পথে টেমস জাহাজ ছাড়ল ৯ অক্টোবর। এই জাহাজে যাত্রীদের ভীড় অনেক বেশী। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘নিরিবিলি কোণে চৌকি টেনে যে একটু লিখব তার জো নেই, সুতরাং সম্মুখে যা-কিছু চোখে পড়ে তাই চেয়ে দেখি।’ জাহাজে বাঙালি যাত্রী না থাকায় রবীন্দ্রনাথ বিদেশী নরনারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ পেয়েছেন অনেক বেশী। সহযাত্রী য়ুরোপীয় মহিলাদের চোখ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘ইংরেজ সুনয়নার চোখ মেঘমুক্ত নীলাকাশের মতো পরিষ্কার, হীরকের মতো উজ্জ্বল এবং ঘন পল্লবে আচ্ছন্ন, তাতে দেশের মেয়েদের মত আবেশের ছায়া নেই।’ অবশ্য একই সঙ্গে দেশের হরিণনয়না চোখেরও প্রশংসা করতে ভোলেননি। রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন ইংরেজ মেয়েদের চোখ নিয়ে বাঙালিরা প্রায়ই ঠাট্টা করে, বলে ওদের চোখ বিড়ালের চোখের মত। অথচ তারাই যখন বিদেশে যান – সেই বিড়াল চোখের প্রেমেই পড়েন। স্বদেশের হরিণনয়নের কথা আর মনে থাকে না।
এই জাহাজে গান গেয়ে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, বিশেষ করে বিদেশিনীদের কাছ থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘সেই সুন্দরী মেয়েটি যাকে আমার খুব ভালো লাগে আমি দেখছিলম ক’দিন ধরে সেও আমার সঙ্গে আলাপ করবার অনেক চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমার stupidity-বশত আমি ধরা দিই নি। সে কাল রাত্তিরে আপনি এসে বললে : Aren’t you going to sing? আমি কেবল বললম : Yes, বলে গান গাইতে গেলাম। আজ সকালে তার সঙ্গে আলাপ করলাম। তার মুখে এমন একটি প্রশান্ত গম্ভীর সমিষ্ট earnestness আছে- এমন সুন্দর চোখ নাক এবং ঠোঁট — আমার ভারি ভালো লাগে। আমার বোধ হয় আমাকেও তার মন্দ লাগেনা।’ সেদিন রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য গানের সঙ্গে ‘অলি বার বার ফিরে যায়’ গানটা গেয়ে ছিলেন। অনেক মেয়ে যেচে আলাপ করে বলেছেন, I say, Tagore, you sang awfully this evening, কিম্বা It is a treat to hear you sing. এইভাবে অসাধারণ কন্ঠস্বর আর কিছু গান রবীন্দ্রনাথকে বিদেশের মাটিতে সুগায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
জাহাজে আর একটি অস্ট্রেলিয়ান মেয়েকে রবীন্দ্রনাথের খুব ভালো লেগেছিল। তার নাম Miss Long । ‘সে India -তে বিয়ে করতে যাচ্ছে, একজন কার সঙ্গে engaged’, সে যখন কথা কয়, হাসে, এমন চমৎকার দেখতে হয় আমার ভারি ভালো লাগে – যেমন সুন্দর দেখতে তেমনই intellectual মুখের ভাব।’ এছাড়া আরও তিন অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে রবীন্দ্রনাথের মন কেড়েছিল, ‘তার প্রধান কারণ আমাকে তারা বিশেষ করে বেছে নিয়েছে, এবং মন্দ দেখতে না, এবং বেশ piano বাজায়।’ রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করেছিলেন যে বেশিরভাব ইংরেজ পুরুষ তাদের স্বদেশী সুন্দরীদের চাইতে অস্ট্রেলিয়ান মেয়েদের বেশী পছন্দ করে। তারা বলে, ‘They are so unaffected, childlike, they are not at all smart। বাস্তবিক ইংরেজ অল্পবয়সী মেয়েরা বড্ড বেশি smart বড্ড চোখমুখ নাড়া, বড্ড নাকেমুখে কথা, বড্ড খরতর হাসি, বড্ড চোখাচোখা জবাব।’
১৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ যখন জাহাজের ডেকে পায়চারি করছিলেন, একজন অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে তাঁর সঙ্গ নিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর কবির অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, কোনোমতে সেই রমণীর সঙ্গ ত্যাগ করে দূরে সরে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ সৌন্দর্যের পূজারি কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গ বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারতেন না। নিজেই স্বীকার করেছেন ‘আমি দেখেছি এরকম মেশামেশি বেশিক্ষণ আমি সইতে পারি নে। আজ সন্ধ্যের সময় সুন্দরীর সঙ্গে দুদণ্ড কথাবার্তা করে এমনি শ্রান্তি এবং বিরক্তি বোধ হতে লাগল, যে, কোনো ছুতোয় পালাতে পারলে বাঁচি এমনি মনে হল। সৌন্দর্য দেখতে এবং কল্পনা করতে বেশ লাগে, কিন্তু সৌন্দর্যের সঙ্গে পায়চারি করে small talk করতে আদবে ভালো লাগে না। আমি মনে মনে মেয়েদের এত ভালোবাসি, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভাব করতে পারি নে আশ্চয্যি! আমার আপনা-আপনি ছাড়া আর কারও সঙ্গে কখনও বন্ধুত্ব হবে না।’
১৭ অক্টোবর জাহাজ মাল্টা দ্বীপে পৌঁছালে রবীন্দ্রনাথ সহযাত্রী গিবস-এর সঙ্গে শহর পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন। অপরিচ্ছন্ন মাল্টা রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগে নি। রোমান ক্যাথেলিক চার্চে ঢুকে অস্বস্তি বোধ করেছেন। সেখান ‘একটিও ভালো দেখতে বড়ো মেয়ে দেখতে পেলুম না’ বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। যদিও খুব ছোটো ছোটো মেয়েদের জ্বলজ্বলে কালো চোখ দেখে নিজের মেয়ে আদরের বেলির কথা মনে পড়েছিল।
২০ অক্টোবর ব্রিন্দিসি বন্দর ছাড়িয়ে জাহাজ যখন দেশের দিকে চলেছে রবীন্দ্রনাথ আবার সমুদ্রপীড়ায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পরদিন একটু সুস্থ্ হয়ে Miss Long এর সঙ্গে যেচে আলাপ করলেন, অনেক গল্প করলেন এমন কি ‘সন্ধ্যের সময় এক-চোট নৃত্য হয়ে গেল’। সেদিনই সদ্য আলাপ হওয়া Miss Vivian কে রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হয়েছিল কারণ, সে ‘বেশ প্রশান্ত মৃদুস্বভাব মেয়ে – বেশ মেয়েলি রকমের পড়াশুনো ভালোবাসে, আমার সঙ্গে কবিতা নিয়ে অনেক কথা হল’।
ডিনার টেবিলের Mrs Smallwood কে দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে বিচিত্র ভাবনার উদয় হয়েছিল। ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে, গৌরবের দিন চলে গিয়েছে। এককালে খুব সুন্দরী ছিলেন, অনেকের উপর ‘খরতর শরচালনা করেছেন’, বহু পুরুষ এর কথায় নেচেছে, সেবা করেছে। আজ গল্প করবার কেউ নেই, কেউ আহ্বান করে না নাচের সঙ্গিনী হতে। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘যদিও সে নাকে মুখে কথা কয় এবং অচিরজাত বিড়ালশাবকের মতো ক্রীড়াচাতুরীশালিনী এবং তার প্রখরতাও বড়ো সামান্য নয়। অবিশ্যি, বয়স অল্পে অল্পে এগোয় এবং অনাদর ক্রমে ক্রমে সয়ে আসে। কিন্তু তবু, যে-সব মেয়ে চিত্তজয়োৎসাহে মত্ত হয়ে শরীরের প্রতি দৃকপাত করে নি, গৃহকার্য অবহেলা করেছে, ছেলেদের দাসীর হাতে সমর্পণ করে রাত্রির পর রাত্রি নৃত্যসুখে কাটিয়েছে, উগ্র উত্তেজনায় মত্ত হয়ে জীবনের সমস্ত স্বাভাবিক সুখের প্রতি অনেক পরিমাণে বীততৃষ্ণ হয়েছে, তাদের বয়স্ক অবস্থা কী শুন্য এবং শোভাহীন’! তুলনা করেছেন বাংলার মেয়েদের সঙ্গে, ‘আমাদের মেয়েরা এই উদগ্র আমোদমদিরার আস্বাদ জানে না তারা অল্পে অল্পে স্ত্রী থেকে মা এবং মা থেকে দিদিমা হয়ে আসে, পূর্বাবস্থা থেকে পরের অবস্থার মধ্যে প্রচণ্ড বিপ্লব বা বিচ্ছেদ নেই’।
জাহাজের বল-রুমে Miss Low আর Miss Hediest কে দেখেছেন তারা কী অবিশ্রামভাবে পুরুষদের খেলাচ্ছে। ‘আর কোনো কাজ নেই, আর কোনো ভাবনা নেই, আর কোনো সুখ নেই – সচেতন পুত্তলিকা – মন নেই, আত্মা নেই – কেবল চোখেমুখে হাসি এবং কথা এবং তীব্র উত্তর-প্রত্যুত্তর’। আবার অন্যসময় ইংরেজ পুরুষেরা যখন নিজেদের মধ্যে চুরুট-তাস-হাসিঠাট্টা নিয়ে জটলা করত তখন এই মক্ষিরানীরাই ‘ম্লানমুখে, সঙ্গহীন লজ্জায় এককোণে বেকার দাঁড়িয়ে থাকত।’ রবীন্দ্রনাথই তখন সঙ্গ দিয়ে, বাক্যালাপ করে তাদের প্রফুল্ল রাখবার চেষ্টা করতেন।
২৭ অক্টোবর। আর মাত্র সাত দিন। জাহাজ এখন Red Sea অতিক্রম করছে। হাওয়ায় দেশের গন্ধ। রবীন্দ্রনাথের মনে ‘নিশিদিন উল্টে পালটে কেবল কলকাতার ছবি’ ভেসে উঠছে। রোদের তাপ বেড়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়ে চেয়ে দেখছেন ‘ডেকের উপরে মেয়েরা সমস্ত দিন তৃষাতুর হরিণীর মতো pant করছে, রৌদ্রদগ্ধ ফলের মতো তাদের তাপক্লিষ্ট ম্লানমুখ দেখে দুঃখ হয়। তারা কেবল অতি ক্লান্তভাবে ধীরে ধীরে পাখা নাড়ছে, স্মেলিং সল্ট শুকছে এবং যুবকেরা পাশে এসে করুণ স্বরে কুশল জিজ্ঞাসা করছে’
বুধবার। জাহাজের ডেকে বসে রবীন্দ্রনাথ একটি ইংরাজি কাগজ পড়ছেন। তাতে আমাদের দিশি মেয়েদের দুরবস্থা সম্বন্ধে খুব কাতরভাবে লিখেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মনে করেন আমাদের মেয়েরা ইংরেজ মেয়েদের চাইতে ঢের বেশী সুখী। একজন বয়স্ক ইংরেজ মহিলা সংসারে নিজের স্থান খুঁজে পান না। অতিরিক্ত সাজগোজ, সভাসমিতি, কুকুরশাবক পালন ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের শূন্য জীবনকে ব্যাপৃত রাখতে হয়। কিন্তু ‘বাঙালি পরিবারের মধ্যে শিশুস্নেহ, গুরুভক্তি, সখিত্ব, বিচিত্র প্রবাহে তাদের নারীহৃদয়কে সর্বদা কোমল ও সরস করে রাখে।’
২ মাস এগারো দিন পরে ২ নভেম্বর রাত দুপুরের সময় জাহাজ এসে ভিড়ল বোম্বাই বন্দরে।
শনিবারের ব্লগের সমস্ত পাঠককে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ
খুব ভালো লাগলো। সমৃদ্ধ হলাম। এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা ছিল না। আন্তরিক ধন্যবাদ।