রবির চিঠি মৃণালিনীকে No ratings yet.

কটা সময় দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠি। ডাক-পিয়নের সাইকেলের ঘণ্টি আর ‘চিঠি আছে’ হাঁক শোনবার জন্য সকাল থেকেই অধীর প্রতীক্ষার কথা এখনও অনেকেরই মনে আছে। প্রিয়জনের কাছ থেকে আসা চিঠি বয়ে আনত দূরের সুবাস। মামুলি কথা বা সাধারণ খবরাখবরের জন্য ছিল পোষ্টকার্ড। একটু বেশি লেখবার জন্য ইনল্যাণ্ড আর মনের কথা উজাড় করে দেওয়া হত  এনভেলাপে। চিঠি, তা ছোটো-বড় যাই হোক না কেন প্রাপকের কাছে তার আদর ছিল ঈর্ষণীয়।  প্রেমিকের চিঠি হলে দিনের মধ্যে কতবার যে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়া হত, গোপনে! খুশির খবরে বাড়িতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত। আর ছিল টেলিগ্রাম। হাতে পেলেই মনে হত কোনো দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে বুঝি। মনে আছে সেই লাল রঙের ডাকবাক্সের কথা?  চিঠির উপরে ঠিকানা লিখে ডাকবাক্সে জমা দিয়ে শুরু হত উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা।

মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে সেই স্মৃতি আজ অতীত। চিঠি লেখা আর চিঠি পাবার রোমান্টিকতা উধাও।  দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ এখন সেকেন্ডের ব্যাপার। কিন্তু তার মধ্যে থাকে না প্রাণের স্পর্শ, তাদের জমিয়ে রাখা যায় না ভবিষ্যতের জন্য। তাই ভাবের সেই আদানপ্রদানের কোনো ঐতিহাসিক মূল্য থাকে না। অথচ ইতিহাসের নিরিখে চিঠির গুরুত্ব অসীম।

চিঠি সময়ের দলিল, একজন মানুষের আত্মপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম,  সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক  পটভূমিকার বিশ্বস্ত দর্পণ। 

রবীন্দ্রনাথ জীবনের কত সহস্র চিঠি লিখেছেন তার ঠিকঠিকানা নেই। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, চেনা-অচেনা শত শত মানুষকে তিনি ক্লান্তিহীন চিঠি লিখেছেন সারাজীবন ধরে। তার অনেকগুলিই হারিয়ে কিম্বা নষ্ট হয়ে গেলেও যেগুলি পাওয়া গিয়েছে তাইই আমাদের কাছে সম্পদ। সেই রত্নগুলি সংকলিত হয়েছে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র’-এর ১৮টি খণ্ডে ।

১৮৯০ থেকে ১৯০২ সালের মধ্যে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা  রবীন্দ্রনাথের ৩৬টি চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে আমাদের এই পর্বের আলোচনা। বয়সে প্রায় ১৩ বছরের ছোটো স্ত্রীকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লেখবার সময় নানা আদরের নামে সম্বোধন করতেন, যেমন ‘ভাই ছোটো বৌ’, ‘ভাই ছোটো গিন্নী’, ‘ভাই ছুটি’  ইত্যাদি। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সম্বোধনটি হল ‘ভাই ছুটি’। ৩৬টির মধ্যে ৩০টি চিঠিতেই তিনি এটি ব্যবহার করেছেন।  সম্ভবত বয়স আর মানসিক দূরত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে কিছুটা স্নেহের চোখেই দেখতেন। প্রতি চিঠির নীচে সাক্ষরে লিখতেন ‘তোমার রবি’, ‘রবি’ কিম্বা শুধুই ‘- তোমার’

আলোচ্য চিঠিগুলি পড়লে বোঝা যায় মৃণালিনীকে তিনি আরো অনেক চিঠি লিখেছিলেন, যেগুলির কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। প্রত্যুত্তরে লেখা মৃণালিনীর প্রায় সমস্ত চিঠিই রবীন্দ্রনাথ নিজেই নষ্ট করে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। স্বামীকে লেখা মৃণালিনীর মাত্র ৩টি চিঠি পাওয়া গিয়েছে।   

মৃণালিনী দেবী

১৮৮৯ সালের ২৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী, বেলা এবং রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য শিলাইদহে গিয়েছিলেন। তখনই সেখানকার প্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত। সেখানেই রচিত হয়েছিল পদ্মাকেন্দ্রিক রচনাগুলি (সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি ইত্যাদি)। এরপরে ১৮৯০ সালের ১৩ জানুয়ারি আবার শিলাইদহে এসেছেন জমিদারি দেখাশোনার কাজে। সেখানে মাসাধিককাল একাকী থাকবার সময় রবীন্দ্রনাথের বিরহী চিত্ত উন্মুখ হয়ে থাকত স্ত্রীর চিঠির জন্য। 

হয়ত সংসারের দায়িত্ব আর আলসেমির জন্য মৃণালিনী সবসময় উত্তর দিতে পারতেন না। কিন্তু সাজাদপুরে থাকবার সময় তাঁর একটা চিঠি পেয়েই ‘ভাই ছোটবউ’ সম্বোধন করে লিখলেন (পত্র ১), যেমনি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত। ভালমানষির কাজ নয়। কাকুতি মিনতি করলেই অমনি নিজমূর্তি ধারণ করেন আর দুটো গালমন্দ দিলেই একেবারে জ। স্ত্রীর চিঠি না পাওয়ার অভিমান ! এছাড়াও রয়েছে নানা ছোটোখাটো একেবারে সাংসারিক কথা। যেমন বেলি খোকার জন্য এক-একবার মনটা ভারি অস্থির বোধ হয়। বেলিকে আমার নাম করে দুটো ‘অড’ খেতে দিও।  এই চিঠি থেকে গৃহী রবীন্দ্রনাথকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়। চিঠিতে ধরা পড়েছে গৃহস্থ রবীন্দ্রনাথের একটি সুন্দর ছবি। অথচ প্রায় একই সময়ে ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে (ছিন্নপত্র ১২) রয়েছে বৃষ্টির ঘনঘটা আর কোনো এক সাহেব অথিতিকে আপ্যায়নের বিড়ম্বনার কৌতুকময় বর্ণনা।

১৮৯০ সালের ২২ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ বোম্বাই থেকে ‘শ্যাম’ জাহাজে  য়ুরোপ যাত্রা করেন। ২৯ আগস্ট সেই জাহাজ থেকে মৃণালিনীকে লিখেছেন দ্বিতীয় চিঠিটি, এডেন বন্দরে পৌঁছাবার আগে  দীর্ঘ ৭ মাস পরে।  এই চিঠিতে (পত্র ২) আবার সেই রবীন্দ্রনাথের দেখা পাই যিনি আমাদের মত একেবারে ঘরোয়া মানুষ। লিখেছেন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড়ো খাটে একধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তোমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম—বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কিনা। তার পর বেলি খোকাকে হাম দিয়ে ফিরে চলে এলুম দেশে ফেরবার সময় বাচ্ছাদের জন্যে কি রকম জিনিস নিয়ে যাব বল দেখি

আট দিন পরে ৬ সেপ্টেম্বর ম্যাসালিয়া জাহাজ থেকে যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন (পত্র ৩) তোমাকেও একদিন এই পথে আসতে হবে জান ? এখানে তিনি ছোটো গিন্নীকে ‘ছুটকি’ বলে সম্বোধন করেছেন। হয়ত রবীন্দ্রনাথের বাসনা ছিল তাঁকে একবার বিলেতভ্রমণে নিয়ে আসবেন, কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি।

এছাড়া রয়েছে ছোটোখাট টুকটাক কথাবার্তা । আমি অনেকগুলো অদরকারি কাপড় চোপড় এবং সেই বালাপোষখানা  মেজ  বোঠানের হাত দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি – সেগুলো পেয়েছ তো আমার সেই আঙ্গুল কেটে গিয়েছিল এখন সেরে গেছে – কিন্তু খুব দুটো গর্ত হয়ে আছে – ভয়ানক কেটে গিয়েছিল ।

( জাহাজে একদিন ব্রেকফাস্টের সময় ছুরি দিয়ে রুটি কাটবার সময় আঙ্গুল কেটে গিয়েছিল – স্ত্রীকে সেকথাই জানিয়েছেন, একটু উদ্বিগ্ন করে তাঁর সমবেদনা পাবার আশায়), অনেকদিন বাদে কাল পর্শু দুদিন স্নান করেছি’।  এছাড়াও চিঠিতে ছিল মৃণালিনীর স্বাস্থ্যের জন্য দুশ্চিন্তা আর খোকার কথা। জাহাজে যাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য একদিন নাচগানের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেই সূত্রে লিখেছেন একটা মেয়ে বেড়ে নেচেছিল । একেবারে আমাদের বৈঠকি আড্ডার ভাষা যেন ।

৯ সেপ্টেম্বর প্যারিসের  আইফেল টাওয়ারে উঠে  পিকচার পোষ্টকার্ডের সংক্ষিপ্ত চিঠি (পত্র ৪) লণ্ডনে গিয়ে  চিঠি লিখব। ছেলেদের জন্য হামি। প্রায় সব চিঠিতেই তিনি স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের হামি পাঠিয়েছেন। কিন্তু প্রায় একমাস লণ্ডনের কাটালেও সেখান থেকে মৃণালিনীকে চিঠি লেখবার আর সময় পান নি।

 

২ নভেম্বর কলকাতায় ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সময়ে তাঁর য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি, কাব্যগ্রন্থ মানসী  প্রকাশিত হয়। ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে জমিদারির কাজে শিলাইদহে পৌঁছে ১৩ জানুয়ারি কলিগ্রাম থেকে মৃণালিনীকে লিখেছেন (পত্র ৫), আজ আমি কলিগ্রামে এসে পৌঁছুলাম। পথের সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন, জানিয়েছেন মশার ভয়ানক অত্যাচারের কথা, চলন বিলটা তাঁর একেবারেই ভালো লাগেনি। আর মেয়ে মাধুরীলতার চিঠি পেয়ে (তখন তার বয়স মোটে ৫ বছর) লিখছেন, আমার মিষ্টি বেলুরাণুর চিঠি পেয়ে তখনি বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার জন্যে তার আবার মন কেমন করে। তার ত ঐ একটুখানি মন, তার আবার কি হবে ?…কাল রাত্তিরে আমি খোকাকে স্বপ্ন দেখেছি — তাকে যেন আমি কোলে নিয়ে চটকাচ্চি, বেশ লাগচে

শ্রী প্রশান্ত পালের কথায় ‘পিতৃস্নেহ রবীন্দ্রনাথের  সৃষ্টিমূলক রচনায় খুব বেশী প্রকাশ পায়নি, সেই মনটি ধরা পড়েছে এই ধরণের কিছু কিছু পত্রে’।

এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ প্রায় মাসাধিককাল সাহজাদপুরে ছিলেন আর মৃণালিনী দেবীকে লিখেছেন মোট ৫টি চিঠি । প্রতিটি চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথের নিবিড় গৃহস্থ জীবনের ছবি স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। যেমন একদিন লিখেছেন (পত্র ৬), আজ সকালে এ অঞ্চলের একজন প্রধান গণৎকার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সমস্ত সকাল বেলাটা সে আমাকে জ্বালিয়ে গেছে বেশ গুছিয়ে লিখতে বসেছিলুম বকে বকে আমাকে কিছুতেই লিখতে দিলে না। সে বলেছিল কবি ষাট বাষট্টি বছরের বেশী বাঁচবেন না। সেকথা সবিস্তারে স্ত্রীকে জানিয়ে, আবার সান্ত্বনা দিয়েছেন, যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না। এখনো কিছু না হোক ত্রিশ চল্লিশ বৎসর আমার সংসর্গ পেতে পারবে। ততদিনে সম্পূর্ণ বিরক্ত ধরে না গেলে বাঁচি।  কিন্তু হায়, মাত্র এগারো বছর পরেই রবীন্দ্রনাথের সংসর্গ ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল না-ফেরারা জগতে।

অন্য একটা চিঠিতে (পত্র ৭) দেখা যায় তাঁর কৌতুকপূর্ণ অনুযোগ: আচ্ছা, আমি যে তোমাকে এই সাহাজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখনমারা ঘের্ত্ত, সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্বন্ধে কোন রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বল দেখি ? আমি দেখছি অজস্র উপহার পেয়ে পেয়ে তোমার কৃতজ্ঞতা বৃত্তিটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে, প্রতি মাসে নিয়মিত পনেরো সের করে ঘি পাওয়া তোমার এমনি স্বাভাবিক মনে হয়ে গেছে যেন বিয়ের পূর্বে থেকে তোমার সঙ্গে আমার এই রকম কথা নির্দিষ্ট ছিলএছাড়া ভালো আমের কথা, চাকরবাকর আর ভোলার মা’র কথাও রয়েছে কোনো কোনো চিঠিতে। স্ত্রীর শরীরস্বাস্থের কথা জানবার জন্য লিখেছেন আজকাল তুমি দুবেলা খানিকটা করে ছাতে পায়চারি করে বেড়াচ্ছ কি না আমাকে বল দেখি। এবং অন্যান্য সমস্ত নিয়ম পালন হচ্ছে কি না, তাও জানাবে

রবীন্দ্রনাথ বরাবরই স্বল্পাহারী। তাঁর খাবারের পরিমাণ দেখে সকলে অবাক হয়ে যেত। তার বর্ণনাও রয়েছে সেদিনের চিঠিতে, ভাত ছেড়ে দিয়েছি বলে সবাই আমাকে ভারি ধার্মিক মনে করে – আমার কুষ্টিতে লেখা আছে কি না যে বিনা চেষ্টায় আমার যশ এবং আর দুই একটা জিনিষ হবে

শিলাইদহ কুঠিবাড়ি

২০ জুনের চিঠিটা (পত্র ৮)  নেহাতই মামুলি। জানিয়েছেন বাড়ি ছেড়ে মাসখানেক দূরে থাকলে তাঁর বাড়ির দিকে মন টানতে থাকে। হোম-সিকনেস আর কি ? এছাড়া ছিল গতদিনের বৃষ্টি আর গিন্নির শরীরস্বাস্থ্যের খবর। কিন্তু পরের চিঠিতেই আবার দুরন্ত অভিমানী অনুযোগ।

বাড়ি থেকে দূরে থাকলে মৃণালিনীর চিঠি পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ কতখানি আকুল হয়ে থাকতেন তার হদিশ পাওয়া যায় সাহাজাদপুর থেকে এই লেখা (পত্র ৯) চিঠিতে, তোমাদের মত এত অকৃতজ্ঞ আমি দেখিনি। পাছে তোমাদের চিঠি পেতে একদিন দেরি হয় বলে কোথাও যাত্রা করবার সময় আমি একদিনে উপরি উপরি তিনটে চিঠি লিখেচি। কিন্তু আজ থেকে নিয়ম করলুম চিঠির উত্তর না পেলে আমি চিঠি লিখব না। এ রকম করে চিঠি লিখে লিখে কেবল তোমাদের অভ্যাস খারাপ করে দেওয়া হয়। এতে তোমাদের মনেও একটুখানি কৃতজ্ঞতার সঞ্চার হয় না। তুমি যদি হপ্তায় নিয়মিত দুখানা করে চিঠিও লিখতে তা হলেও আমি যথেষ্ট পুরস্কার জ্ঞান করতুম

আসলে মৃণালিনী দেবী খুব একটা চিঠিপত্র লিখতেন না, লিখলেও প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বিশেষ কিছুর উল্লেখ থাকত না। আর সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের অভিমান। দূরে থাকলে মৃণালিনীর চিঠির প্রত্যাশায় তিনি প্রতিদিন চাতকের মত ডাকের দিকে চেয়ে থাকতেন। “ডাকের সময় ডাক এল – খান তিনেক চিঠি এল – অথচ তোমার চিঠি পাওয়া গেল না”,   “কাল তো তোমার চিঠি পাওয়া যায় নি। আজও চিঠি পাই নি মনে করে টেলিগ্রাফ করতে উদ্যত হয়েছিলুম”।     “বড় হোক ছোটো হোক ভালো হোক মন্দ হোক একটা করে চিঠি আমাকে রোজ লেখনা কেন”?    “আজ একদিনে তোমার দুখানা চিঠি পেয়ে খুব খুসি হলুম”।

নানা সময়ে লেখা এইসব বাক্যবন্ধ থেকে বোঝা যায় স্ত্রীর চিঠি পাবার জন্য কবির ব্যাকুলতার কথা। তাই তিনি লিখেছেন, দূরে থাকার একটা প্রধানত সুখ হচ্ছে চিঠি। জিনিসটা অল্প বলে তার দামও বেশী।  

বিদেশবাসের এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ মৃণলিনী দেবীকে অত্যন্ত মামুলি আর কেজো ধরণের সাকুল্যে ৫টি চিঠি লিখলেও একই সময়ে ইন্দিরা দেবীকে যে ৭টি  চিঠি লিখেছেন  (ছিন্নপত্র : ২৩, ২৪, ২৫,২৬,২৭,২৮,২৯) তার প্রতিটিতে ধরা পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ আর প্রকৃতির পটভূমিকায় তার মূল্যায়ন। ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-তরঙ্গের যে মিল আমরা লক্ষ করেছি তেমনটি বোধহয় মৃণালিনীর সঙ্গে ছিল না।

(ক্রমশ)

আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ

Please rate this

Join the Conversation

3 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। মৃণালিনী দেবী ও কবির দাম্পত্য জীবনের এমন সুন্দর একটি লেখা বহুদিন পড়িনি। ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. রবীন্দ্রনাথ স্বল্পাহারী আবার তাঁর প্রাত:রাশের বিবরণ (বনফুল) ভোজনবিলাসী। কোনটা সঠিক

  3. মহামানবদের অন্তরঙ্গ মানব হিসাবে চিনতে পারি তাঁদের ব‍্যক্তিগত চিঠিপত্রের মাধ‍্যমে। এখানে কবির আরও ব‍্যক্তিগত পরিচয় পাই তাঁদের দাম্পত‍্য চিঠিপত্রগুলি থেকে। আপনি এই বিষয়টিকে আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। আগামী অংশের জন‍্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছি। ধন‍্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *