রবীন্দ্রনাথের ভৃত্যকুল (শেষ পর্ব)
আর এক ভৃত্য মহাদেব–কে নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। রবীন্দ্রনাথ সাধারণত রাত্রে শোবার সময়ে জানলা খুলে রাখতেন। সেদিন গরমকাল, আকাশে জ্যোৎস্না। মহাদেব শুয়েছে কবির ঘরের বাইরে খোলা দরজার সামনে। রাত গভীর, চরাচর নিঝুম। মাঝরাতে খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে কবির মুখে। ঘুম ভেঙে গেল। মহাদেবকে ডেকে বললেন, ‘ওরে চাঁদটা ঢেকে দে তো । ঘুম হচ্ছেনা’। মহাদেব তো ভেবেই পাচ্ছে না কিভাবে চাঁদকে ঢাকবে। জীবনে এমন উদ্ভট কথা সে কখনও শোনে নি। তখন রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধি দিলেন, ‘আচ্ছা এক কাজ কর। ঐ জানলাটা বন্ধ করে দে’। মহাদেব জানলা বন্ধ করতেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। নিজের বোকামির জন্য মাথা চুলকিয়ে মহাদেব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঝগড়ু জোড়াসাঁকোর অতি পুরাতন ভৃত্য । ঠাকুরবাড়ির অনেক ঘটনার সাক্ষী, বিশ্বস্ত আর স্নেহপ্রবণ এই ভৃত্যটিকে রবীন্দ্রনাথ ভীষণ ভালোবাসতেন। তার কাজ ছিল অল্প, রবীন্দ্রনাথের ঘর ঝাড়পোঁছ করা আর টুকটাক ফাইফরমাস খাটা। কিন্তু ঠাকুরবাড়িতে তার অসীম প্রতাপ, যেন পরিবারেরই এক গুরুজন। অনেকেই তাকে সমঝে চলতেন। শেষ বয়সে বৃদ্ধ ঝগড়ু সবাইকে পুরোনো দিনের গল্প শোনাত, শান্তিনিকেতনের গল্প, শমীন্দ্রনাথের গল্প, মৃণালিণীর গল্প আরও কতকিছু। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বখ্যাতি নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা ছিল না, কিন্তু তাঁর জীবনের দুঃখ আর শোকতাপগুলিই ঝগড়ুকে ব্যথিত করত। এই ঝগড়ুকে রবীন্দ্রনাথ অমর করে রেখেছেন তাঁর এক ছেলেমানুষী ছড়ায়। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় নাতনী, যার ডাক নাম পুপে, তাঁর কাছে বাঘের গল্প শোনবার জন্য প্রায়ই বায়না করত। বাঘের গল্পে পুপের ছিল সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ। এজন্য রবীন্দ্রনাথকে একটা ছড়াও লিখতে হয়েছিল বাঘ নিয়ে । তাতে রয়েছে ঝগড়ুর কথা।
রবীন্দ্রনাথের ভৃত্যদের মধ্যে সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র উড়িষ্যার বনমালী, বনমালী পারুই। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ কুড়ি বছরের নিত্যসঙ্গী। ভৃত্য হিসাবে বনমালী কবে নিযুক্ত হয়েছিলেন সেটা জানা না গেলও, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সে সারাক্ষণ তার বাবামশায়ের সেবা করে গিয়েছে। তাদের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কটা পৌঁছে গিয়েছিল স্নেহ-ভক্তি আর ভালোবাসার পর্যায়ে। বনমালীর সরল হাসিখুশি ব্যবহার, রসবোধ, হাসিঠাট্টা উপভোগ করবার ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই তো তিনি বনমালীকে আদর করে ‘নীলমনি’ বলে ডাকতেন। বনমালী ‘লম্বা’কে বলত ‘নাম্বা’, ‘নিদ্রা’কে ‘লিদ্রা’, ‘ন্যাপকিন’কে ‘ল্যাপকিন’ এমনই আরও কতকিছু। তাই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যখন তখন মস্করা করতেন, বনমালীর সামনেই। সে বেচারা একটুও রাগত না, বরং মুচকি হেসে উপভোগই করত।
ভোরের আলো ফুটবার অনেক আগেই কাঠের উনুন জ্বালিয়ে বনমালী চা নিয়ে হাজির হত কবির সামনে। বনমালীর হাতের চা খেয়ে রবীন্দ্রনাথের দিন শুরু। তারপর সারাদিন সে ছায়ার মত লেগে থাকত তাঁর সঙ্গে। তার মনিবের কখন কি প্রয়োজন, মেজাজের তাপমাত্রা, শরীরের ভালোমন্দ, খাবারের খুঁটিনাটি সবকিছু থাকত বনমালীর নখদর্পনে। তাই এই প্রিয় ভৃত্যটির উপরে নিজেকে সমর্পন করে রবীন্দ্রনাথ চিন্তামুক্ত হতে পেরেছিলেন।
বনমালীকে কিছুক্ষণ দেখতে না পেলেই কবি অস্থির হয়ে পড়তেন। একবার, কোনো এক বিশেষ প্রয়োজনে বনমালী দেশে গিয়েছে, কিন্তু নানা ঝামেলায় ফিরতে দেরি হচ্ছে। সে সময়ে কবি খুবই অসুস্থ , একেবারে শয্যাশায়ী। তার মধ্যেই রোজ হাজারবার খোঁজ নিচ্ছেন বনমালী ফিরল কিনা। বনমালী আর ফেরে না, কবির দুশ্চিন্তা আর উতকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। অবশেষে দেশের কাজ মিটিয়ে বনমালী ফিরে এলে তার মুখ থেকে সবকিছু জেনে কবি নিশ্চিন্ত হলেন।
রবীন্দ্রনাথ দেশবিদেশের নানা ভ্রমণে বনমালীকে সঙ্গী করেছেন। তবে তার সবচেয়ে পছন্দের শহর ছিল বোম্বাই। ছোটোখাটো চেহারার বনমালীর গায়ের রং চাপা, বরং বলা ভালো বেশ কালো। বনমালীর বদ্ধমূল ধারণা বোম্বাই গেলে ফর্সা হওয়া যায়, চেহারা খোলতাই হয়। সেই প্রমান সে নাকি পেয়েছে বাবামশায়ের সঙ্গে কয়েকবার সেখানে গিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাট্টা করে বলতেন, ‘চল, বোম্বাইতে গিয়ে থাকি এবার তোতে আমাতে’। শুনে তার চোখমুখে খুশি উপচে পড়ত।
শান্তিনিকেতন মানেই সংস্কৃতির নন্দনকানন। সেখানে আকাশে বাতাসে গান, নানা অনুষ্ঠান, নাটক-অভিনয় লেগেই রয়েছে তার বাবামশাইকে কেন্দ্র করে। সেই কাননে বনমালীর স্থান হয়েছিল একবার। কবির শেষ জন্মদিনে অনুষ্ঠিত বশীকরণ নাটকে বনমালী অভিনয় করেছিল চাকরের ভুমিকায়। তার সপ্রতিভ অভিনয় রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল। তারিফ করে সবাইকে বলেছেন, ‘আমার নীলমণির কত গুণ তাই দেখো। বাঁদরটা আমার কাছে থেকে থেকে নাটক করতেও শিখে গেল’।
পোষাক এবং সাজগোজের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রুচিবান। বিভিন্ন নাটকের মঞ্চাভিনয়ে অভিনেতাদের পোষাক-পরিকল্পনা তাঁরই নির্দেশে করা হত। একবার বনমালীকে তিনি নিজের হাতে সাজিয়েও ছিলেন। রানী চন্দ সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, ‘হায়দ্রাবাদের পথে ভিজেনাগ্রামে যাচ্ছেন গুরুদেব একদিনের জন্য, রাজমাতা ললিতাদেবীর আমন্ত্রণে। ভোর রাতে ভিজেনাগ্রাম স্টেশনে ট্রেন থামল। দেখি, ট্রেনের করিডোরে দাঁড়িয়ে গুরুদেব তাঁরই একটা কালো ভেলভেটের টুপি বনমালীর মাথায় পরিয়ে থেবড়ে থুবড়ে ঠিক করে দিচ্ছেন। বনমালীকে পরিয়েছেন গুরুদেব নিজেরই একটা সিল্কের পাজামা। বললেন, রাজবাড়িতে যাচ্ছিস – তোর ঐ সাজে যাবি নাকি? আমার পাজামা টুপি পরে সেজে নে’।
গ্রামের মানুষ নানারকম অলৌকিক কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। একবার বনমালী রবীন্দ্রনাথকে তার গ্রামের সিদ্ধপুরুষ মণিবাবা’র মহিমা বর্ণনা করে বলেছিল, কাউকে বিষাক্ত সাপে কামড়ালে, মাত্র তিনবার মণিবাবার নাম উচ্চারণ করলেই সে বিষ সাথে সাথে নেমে যাবে। মণিবাবার নামের এত গুণ। শুনে রবীন্দ্রনাথ গম্ভীরভাবে অনিল চন্দ্রকে বললেন, ‘যেখান থেকে পারিস একটা কেউটে সাপ জোগাড় করে আন। এনে সাপটাকে দিয়ে বনমালীকে কাটা। তারপর তিনবার কেন আমি তিনশবার বলব মণিবাবা, মণিবাবা, মণিবাবা’। শুনে সবাই হেসে উঠত, বনমালীও।
বনমালীকে রবীন্দ্রনাথ অপত্যস্নেহে ভালোবাসতেন। তার সুখদুঃখ, অভাব-অনটনের খোঁজ রাখতেন নিয়মিত। তার সঙ্গে রসিকতা যেমন করতেন, শাসনেও কঠোর হতেন দরকার হলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনের অসংখ্য ভৃত্যদের মধ্যে বনমালীকে সবচেয়ে পছন্দ করতেন তার হাসিমুখ আর পরিহাস উপভোগ করবার ক্ষমতার জন্য। একবার অসুস্থতার কারণে বনমালীকে ছুটি দিয়ে রামচরিত-কে রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। রামচরিত অত্যন্ত বিশ্বাসী আর করিতকর্মা। কিন্তু তার ছিল ‘গম্ভীর মুখ আর একজোড়া প্রকাণ্ড গোঁফ’, যা রবীন্দ্রনাথের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। কিছুদিন পরেই তাকে বিদায় দিয়ে কবি বলেছেন, ‘ওর মুখ দেখলে যে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। ও খুব ভালো কাজ করে, কিন্তু কোনো ঠাট্টা তামাশা ওর সঙ্গে করতে পারিনে, ঠাট্টা করলে ও হাসতে জানে না, শুধু কাজ নিয়ে আমি কি করব? আমার নীলমণি আর কিছু পারুক না পারুক পেট ভরে হাসতে জানে’। কিছুদিন পরেই বনমালীকে আবার ফিরিয়ে আনা হল।
অনেকের মনে করেন রবীন্দ্রনাথ হে মাধবী দ্বিধা কেন গানটি বনমালীকে উদেশ্য করে লিখেছেন। গল্পটা এইরকম, একবার শান্তিনিকেতনে কবির ঘরে গানের মহড়া চলছে। এমন সময় বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে ঢুকবে কি না ভাবছে। রবীন্দ্রনাথ নাকি তখন এই গানটি গেয়েছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘- না হয় সেদিন গেছেই, তাই বলে কি এমনই দুর্দশা হয়েছে যে বনমালীকে দেখে গাইব – ভীরু মাধবী তোমার দ্বিধা কেন’?
তবে রবীন্দ্রনাথ অনেক কবিতায় তাঁর ভৃত্যদের নাম উল্লেখ করেছেন। বাঘের ছড়ায় ঝগড়ুর মত বনমালীকে নিয়েও লিখেছেন অনেক কবিতা।
১৯৪১ সালের জুলাই মাসের ২৫ তারিখ । অসুস্থ কবিকে ট্রেনের বিশেষ সেলুন করে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হচ্ছে অপারেশনের জন্য। বনমালী তার আগে কিছুদিনের জন্য দেশের বাড়ি গিয়েছিল। বদলি রামচরিতকেও কবি বিশেষ পছন্দ করতেন না। তাই বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি নিজেই গোছগাছের টুকটাক নির্দেশ দিচ্ছেন। এতদিন বনমালীই এই কাজটা সামলাত। তার অনুপস্থিতিতে কবি আজ যারপরনাই বিব্রত। এমন সময় মুশকিল-আসানের মত বনমালী এসে হাজির হল। কবি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, তুই তো কিছুদিন ছিলই না, জিনিসপত্র কোথায় কি গেছে। ঠিক করে দেখে শুনে নিস কিন্তু আমার যা যা লাগে। ট্রেনে বিশেষ সেলুন জুড়ে রবীন্দ্রনাথকে জোড়াসাঁকো নিয়ে আসা হল, সঙ্গে বনমালী।
নির্দিষ্ট দিনে অপারেশন হয়ে যাবার পর এসে গেল সেই অভিশপ্ত বাইশে শ্রাবণ, এক মৃত্যুহীন প্রাণের অমৃতলোকে যাত্রার দিন। এ ক’দিন নিঃসঙ্গ বনমালী কবির ঘরের দুয়ারের এককোণে পড়েছিল একরাশ বুকভরা শূন্যতা নিয়ে। তার আজীবনের মালিক, সাথী, গুরুদেব আর তকে নীলমণি বলে ডাকবেন না, হাসিঠাট্টা, বকাবকি, আদর কিছুই করবেন না। সবকিছু শেষ হয়ে গেল চিরদিনের মত। অভিমানে বনমালী স্তব্ধ হয়ে রইল। নির্মলকুমারী লিখেছেন, দেখি বনমালী দূরে এককোণে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে। এ অসুখের কদিন দিনে রাতে ছায়ার মতো সে তার বাবামশায়ের ঘরের আশেপাশে ঘুরেছে, যখন যা দরকার করে দিয়ে গেছে। আজ সব মান্য লোকদের মাঝে তার কোনো অধিকার নেই যেন খাটের কাছে এগিয়ে আসিবার । আমি ডাক দিয়ে বললাম–বনমালী, তুমি গুরুদেবের কাছে এগিয়ে এসে ওঁকে ভালো করে চেয়ে দেখো। বেচারা ভিড় সরিয়ে এগিয়ে খাটের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। কতদিন কত সেবা ও করেছে। ওর মনিব তার সাধারণ মনিব ছিলেন না, কাজেই প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধটা স্নেহ-ভক্তির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল । কত হাসিঠাট্টায় বনমালীর প্রতি তার স্নেহের প্রকাশ তা নিজের চোখে দেখেছি। আজ থেকে বনমালীর কাছে এ বাড়ির কাজ নিরর্থক মনে হবে।
এরপরে বনমালী বেশীদিন জোড়াসাঁকোয় থাকে নি। রবীন্দ্রনাথের কিছু বই, ছবি আর পেনসন নিয়ে ফিরে গিয়েছিল নিজের দেশের বাড়িতে। বনমালী পড়াশুনো জানত না, তবুও গুরুদেবের লেখা আরও বই সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছিল একটা ছোট্টো রবীন্দ্র-গ্রন্থাগার। তার প্রভুর ছবিগুলো অনেক যতনে সাজিয়ে রেখেছিল সেখানে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর অসংখ্য স্মৃতি নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলি কেটেছিল রবীন্দ্র-ভৃত্যকুলের এক উজ্জ্বল চরিত্র, বনমালীর।
বিস্মৃতির আড়ালে থাকা সেই সব চরিত্র,যারা ছিলেন কবির সর্বক্ষণের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, ইতিহাসের পাতা থেকে এই বর্ণহীন মানুষগুলোর কথা প্রাঞ্জল ভাবে পরিবেশনার গুণে তা হয়ে ওঠে আরও বর্ণময়।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বনমালী সম্পর্কে জানতাম (তাও এত বিস্তারিত নয়)। এঁরা বরাবর আড়ালেই থেকে গেছেন। আজ এখান থেকে সমৃদ্ধ হলাম।
Khub bhalo laglo.banamalir charitra apner lekhar gune jibanta hoye utthechhe.kobir sange tar samparko r kobir proti babamaalir antorik saral bhalobasa o shraddhaa apluto korlo.chahidahin ati sadharon ei manustir kache matha nato hoye ase.
Shubhechha janai.