রবীন্দ্রনাথের ভৃত্যকুল No ratings yet.

রবীন্দ্রনাথের ভৃত্যকুল প্রথম পর্ব

বলা যায় জন্মমুহূর্ত থেকেই রবীন্দ্রনাথ ভৃত্যহস্তে সমর্পিত। ভৃত্যদের সম্পূর্ণ অধীন হয়েই কেটেছিল তাঁর শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলি।  তারপরেও, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অসংখ্য ভৃত্য তাঁকে সেবা করবার সুযোগ পেয়েছে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিশাল পরিবারের ছোটো ছেলেমেয়েদের প্রতি আলাদা ভাবে নজর রাখা বা স্নেহযত্ন প্রকাশ করবার রীতি ছিল না, বোধহয় সম্ভবও ছিল না। উপরন্তু সেকালে অভিজাত গৃহে জন্মের পরে শিশুদের মায়ের কাছে রাখবার রীতিও ছিল না। সরলা দেবী লিখেছেন, ‘সেকালের ধনীগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলতি ছিল – শিশুরা মাতৃস্তনের পরিবর্তে ধাত্রীস্তনে পালিত ও পুষ্ট হত। ভূমিষ্ট হওয়ামাত্র মায়ের কোলছাড়া হয়ে তারা এক একটি দুগ্ধদাত্রী দাই ও এক একটি পর্যবেক্ষণকারী পরিচারিকার হস্তে ন্যস্ত হত, মায়ের সঙ্গে তাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকত না’। তাই জন্মের পরেই রবীন্দ্রনাথকে ধাত্রী দিগম্বরীর হাতে ন্যস্ত করা হল।

রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন মাত্র আড়াই বছর তখন (২২ জ্যৈষ্ঠ ১২৭১) তাঁর এবং দাদা সোমেন্দ্রনাথে দেখভাল করবার জন্য ভৃত্য কালিদাসকে নিযুক্ত করা হয়েছিল মাসিক ৭টাকা বেতনে। আবার, ১২৭৩-এ রবীন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথের জন্য নদেরচাঁদ  নামে একজন নতুন ভৃত্যের আগমন হল। একই সময়ে নিযুক্ত হয়েছে ভাগ্নে সত্যপ্রসাদের ভৃত্য মাধব দাস সকলের মাইনে মাসিক ৩ টাকা।  শিশু রবীন্দ্রনাথ, দাদা সোমেন্দ্রনাথ আর প্রায় সমবয়সী ভাগ্নে সত্যপ্রসাদের স্কুলে যাতায়াত, স্নানাহার, খেলাধূলা ইত্যাদির দায়িত্ব পালন করতে হত এই পর্বের ভৃত্যদের।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা গ্রন্থে কেবলমাত্র ঈশ্বর, শ্যাম আর বেঁটে গোবিন্দর কথা লিখেছেন,কিন্তু এরা ছাড়াও আরও অনেক ভৃত্যের কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে  রবীন্দ্রনাথের ছোটোবেলার দিনগুলিতে। যেমন কিশোরীনাথ, স্বরূপ সর্দার, প্যারী দাসী ইত্যাদি। অবশ্য ঠাকুরবাড়ির কোনো ভৃত্যেরই চাকরি পাকা ছিল না। বলা যায় ঘনঘনই তাদের বদল করা হত। তাই ১২৭৪ সালের পৌষে  কালিদাস ও নদেরচাঁদের পরিবর্তে দ্বারি দাসকে নতুন ভৃত্য নিযুক্ত হল।  আবার কিছুদিন পরেই, ১২৭৫ সালের ফাল্গুনী মাসে, দ্বারির জায়গায় এল গোবিন্দ দাস। যদিও পরের মাসেই তার চাকরির জবাব হয়ে গিয়েছিল তবুও রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিকথায় তার উল্লেখ করেছেন, ‘বেঁটে কালো গোবিন্দ কাঁধে হলুদ রঙ্গের ময়লা গামছা ঝুলিয়ে আমাকে নিয়ে যায় স্নান করাতে’

ভৃত্যদের উপরে সন্তানদের দেখাশোনার ভার ছেড়ে দিয়ে অভিভাবকরা নিশ্চিন্ত থাকতেন, ব্যস্ত থাকতেন নিজেদের নানা কাজ নিয়ে। বাচ্চারা কিভাবে বড় হচ্ছে, তারা শরীরের দিকে কিরকম নজর দিচ্ছে, পড়াশুনো ঠিকমত করছে কিনা ইত্যাদি কোনো ব্যাপারেই অভিভাবকদের  তেমন গরজ থাকত না। ফলে ভৃত্যদের ছিল পোয়াবারো। তারা নিজেদেরই মনিব মনে করত। তাদের আচার আচরণে ছেলেদের প্রতি স্নেহ, দয়ামায়া তো ছিলই না বরং ব্যবহার ছিল নির্মম। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা, ভয় দেখানো ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘মার খাইয়া আমরা কাঁদিতাম, প্রহারকর্তা সেটাক শিষ্টোচিত বলিয়া গণ্য করিত না। বস্তুত সেটা ভৃত্যরাজদের বিরুদ্ধে সিডিশন। আমার বেশ মনে আছে, সেই সিডিশন সম্পূর্ণ  দমন করিবার জন্য জল রাখিবার বড় বড় জালার মধ্যে আমাদের রোদনকে বিলুপ্ত করিয়া দেবার চেষ্টা হইত’। আসলে এইসব ভীতিপূর্ণ শাসনে ছেলেরা ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকত, কোনো রকম ছেলেমানুষ-সুলভ বায়না বা দুষ্টুমি করতে সাহস পেত না। এতে ভৃত্যদের কাজের অনেক সুরাহা হত, তাদের দায়িত্বভার অনেকটাই লাঘব হয়ে যেত।

চাকরবাকরদের থাকবার জন্য জোড়াসাঁকোয় ছিল আলাদা মহল বা ঘরদোর। যার পোষাকি নাম তোষাখানা।  তোষাখানার পাশে ছিল একটা বড় ঘর। সেখানে কাঁচের সেজে রেড়ির তেলের মিটমিটে আলো, দেওয়ালে গণেশমার্কা ছবি, কালীমায়ের পট আর মেজের উপরে ময়লা মাদুর। এই ঘরটিই ছিল রবীন্দ্রনাথদের ছেলেবেলার লীলাক্ষেত্র  আর চাকরদের আড্ডাখানা।  এখানেই সন্ধ্যা বেলায় মিটমিটে আলোয় রামায়ন-মহাভারত পাঠের আসর বসত। আসর জমাত ‘জনৈক লেখাপড়া জানা ভৃত্য‘। সে  রামায়নের কুশলবের বীরত্বগাথা পড়ে শোনাবার সময়ে আবির্ভাব হত দেবেন্দ্রনাথের অনুচর কিশোরীর চাটুজ্যের। রাত হয়ে যাচ্ছে এই অজুহাতে  হাত-পা ছুঁড়ে সে দাশুরায়ের পাঁচালি পড়ে সভাভঙ্গ করে দিত।

ঈশ্বর বা ব্রজেশ্বর,  রবীন্দ্রনাথ যাকে তৎকালীন ভৃত্যদের যিনি সর্দার বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সে কাজে যোগ দিয়েছিল ১২৭৬ সালে। ব্রজেশ্বর ছিল একাধারে গ্রাম্য পাঠশালার গুরুমশাই, শুচিবাইগ্রস্থ, আফিমখোর আর লোভী। তার মূল দায়িত্ব ছিল ছেলেদের খাবারের তদারকী করা। কেমন সেই তদারকি? ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমরা খেতে বসলে একটি একটি করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত আর দেব কি। কোন উত্তরটা তার মনের মত সেটা বোঝা যেত তার গলার সুরে। আমি প্রায়ই বলতুম চাই নে। সে আর পীড়াপীড়ি করত না’। এর ফলেই রবীন্দ্রনাথের অল্প খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, সারাজীবন তিনি ছিলেন স্বল্পহারী। ছেলেদের জলখাবারের খরচ মনিবরাই যোগাতেন কিন্তু ব্রজেশ্বর তার বেশীরভাগটাই নিজের জন্যই ব্যয় করত। আর যেহেতু সে নিয়মিত আফিম খেত, তাই ছেলেদের বরাদ্দ দুধের প্রায় সবটাই খেয়ে,  নিজের স্বাস্থ্যরক্ষা করতে তার কোনো সংকোচ বা অপরাধবোধ ছিল না।  ব্রজেশ্বর ছিল অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির ভৃত্য। কথা বলত সাধু ভাষায়, খুব ঝোঁক দিয়ে, ঘাড়টা সামান্য বেঁকিয়ে। অশুচি হয়ে যাবার ভয়ে পুকুরে স্নান করত নিতান্ত অনিচ্ছায়, হাটবার সময়ে নিজের ছায়া এড়িয়ে চলত আর নিজের পরনের কাপড়চোপড়গুলিকেও যেন অবিশ্বাস করত। ব্রজেশ্বর মসিক পারিশ্রমিক ছিল পাঁচ টাকা   

একটু বড় হলে ১২৭৬ সালের ১৩ শ্রাবণ শ্যাম দাস নিযুক্ত হন রবীন্দ্রনাথের নতুন ভৃত্যরূপে। শ্যামের বাড়ি যশোরে, ভাষা খাঁটি পাড়াগেঁয়ে। ‘তার রঙ ছিল শ্যামবর্ণ, বড়ো বড়ো চোখ, তেল কুচকুচে লম্বা চুল, মজবুত দোহারা শরীর। তার স্বভাবে কড়া কিছুই ছিল না, মন ছিল সাদা । ছেলেদের প’রে তার ছিল দরদ’। সে ডাকাতের গল্প শোনাত। শ্যামের কাছে শোনা রঘুডাকাতের গল্পের স্মৃতি পরবর্তীকালে বীরপুরুষ কবিতায় কাব্যরূপ পেয়েছে। শ্যাম দাসের কাজ ছিল মাঝেমাঝে ছেলেদের স্কুলে আনা-নেওয়া করা আর টুকিটাকি ফাইফরমাশ খাটা। আর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় উল্লিখিত শ্যাম চাকর, যে তাঁকে এক জায়গায় বসিয়ে খড়ির গণ্ডি কেটে রামায়নের সীতা হরণের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখত, শ্রী প্রশান্ত পালের অনুমান, সেটি হয়ত ছোটোবেলার অন্য কোনো চাকরের কীর্তি।   

যুবক রবীন্দ্রনাথের খাস চারকের নাম ছিল উমাচরণ নন্দী। সে যশোরের লোক, বুদ্ধিমান, কর্মঠ আর আমুদে। কবির প্রিয় এই ভৃত্যটির হাবভাবে মনে হত সেই যেন রবীন্দ্রনাথের অভিভাবক। রবীন্দ্রনাথও সেটা উপভোগ করতেন। একবার শিলাইদহে থাকাকালীন দ্বারি বিশ্বাস নামক এক ব্যক্তি তার গাছের উৎকৃষ্ট মর্তমান কলা আর আর দুটো অতিকায় কাঁঠাল রবীন্দ্রনাথকে প্রণামী হিসাবে দিয়ে গেলে, উমাচরণ সেগুলি একতলার জালের আলমারির মধ্যে রেখে দিয়েছেলেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফিরে এসে দেখলেন যে ফলগুলি প্রায় পচে গিয়েছে। উমাচরণের তলব পড়লে, সে এসে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াল। রবীন্দ্রনাথ খানিকটা বকাবকি করে বললেন, ‘যা বাজার থেকে সরু চিঁড়ে আর ঘন দুধ কিনে তোরা সবাই মিলে এগুলো খেয়ে নে। কেন বাপু অমন সুন্দর জিনিসগুলো পচিয়ে ফেলে দিবি’ ? এমনই উদার মন ছিল উমাচরণের মনিবের।   ১৩১৩ সাল নাগাদ একবার উমাচরণ পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার মুক্তির জন্য সুবোধচন্দ্র মজুমদারকে অনুরোধ করেছিলেন।  সেই সময়ে কালীগ্রামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের যোগ দেবার কথা ছিল, যাত্রার প্রস্তুতিও চলছিল যথারীতি।  কিন্তু  উমাচরণের মুক্তির চিন্তায় সেবার আর যাওয়া হল না। নিজের এই ভৃত্যটিকে রবীন্দ্রনাথ এতই ভালোবাসতেন যে তার জন্য অত্যন্ত জরুরি সভায় যোগদান বাতিল করতে পিছপা হন নি। উমাচরণ অকালে মারা গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে কবি খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, …তার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। … ওর জীবন আমার জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। এবার দেশে ফিরে গেলে উমাচরণের অভাবে আমার জীবন যাত্রা কত দুরূহ হবে তা বেশ কল্পনা করতে পারছি। 

রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা অমূলক ছিল না।  কিছুদিনের মধ্যেই আগমন ঘটল নতুন ভৃত্য সাধুচরণ-এর। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষটি ছিল ‘কম কথা বেশী কাজ’এর লোক। রবীন্দ্রনাথের ভৃত্যদের সঙ্গে সবসময় এক হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠত। হাসি ঠাট্টা আর মন খুলে কথা বলতেই তিনি আনন্দ পেতেন। তাই সাধুচরণের মেজাজি ব্যবহারে কবি মোটেই খুশি হতেন না। ক্ষিতিমোহন সেনের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘আর বলেন কেন ! ও কি আমার ভৃত্য?  যা গম্ভীর, মনে হয় ও আমার গার্জেন। কথা তো শুনতে পাই না, তবে যখন শুনি, গর্জন শুনি’। মোটের উপর কাজকর্মে তুখোড় হলেও সাধুচরণের উপর রবীন্দ্রনাথ মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিছুদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ তাকে জবাব দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

সাধুচরণ  বিদায় নিলে তার জায়গায় এল ভৃত্য ভোলানাথ। সুঠাম চেহারা, কাজের মানুষ। তার পরিপাটি গোঁফজোড়াটি ছিল দেখবার মত। রবীন্দ্রনাথ তাকে খুবই পছন্দ করতেন। এমনকি কয়েকবার বিদেশভ্রমণও তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেজন্য ভোলানাথের দেমাকের অন্ত ছিল না। দেশে ফিরে এসে ভোলানাথ পরিচিত সবাইকে তার বিদেশ-অভিজ্ঞতার কথা শোনাত, বেশ কিছুটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে। তবে রবীন্দ্রনাথকে বিদেশীরা কেমন সম্মান করত, তাকে দেখতে কী ভয়ঙ্কর ভীড় হত, কোন জার্মান সাহেব তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল এইসব বলবার সময়ে ভোলানাথের বুক গর্বে ফুলে উঠত।

আর ছিল বিপিন। সে এক জবরদস্ত মানুষ। শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে থাকবার সময়ে তার আগমন। ভৃত্য বলে তাকে  মনেই হত না। রবীন্দ্রনাথের দেখাশুনো কার ছাড়াও অভিজ্ঞ আমলার মত সেরেস্তার কাজেও সে ছিল তুখোড়। কারও কাজে সামান্য পান থেকে চুন খসলেই সে হৈ চৈ বাধিয়ে, চিৎকার, চেঁচামেচি করে এক কাণ্ড ঘটিয়ে দিত। তাই বিপিন কাছে থাকলে সবাই তটস্থ হয়ে থাকতে হত। শান্তশিষ্ট রবীন্দ্রনাথ এসব পছন্দ করতেন না, বলতেন, বিপিনের সর্বমত্যন্তম গর্হিতম

প্রসন্ন-র কথা না বললে রবীন্দ্রনাথের ভৃত্যকুল-ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাব। সম্ভবত  রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহে থাকবার সময়ে (১৩০৫-০৬) তাকে ভৃত্য হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রসন্নর নামের সঙ্গে  চরিত্রের মিল অসাধারণ। সে সদা-প্রফুল্ল, সদা-প্রসন্ন, ধীরস্থির মানুষ, রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। প্রসন্নর উপস্থিত বুদ্ধি আর কর্ম-তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথ একবার চরম বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। শিলাইদহে থাকবার সময়ে রবীন্দ্রনাথ পদ্মার বুকে তাঁর প্রিয় পদ্মাবোটে থাকতে ভালোবাসতেন। সেবার মৃণালিনী দেবী, বলেন্দ্রনাথ এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে তিনি বাস করছেন সেই বোটে। সেদিন আকাশভরা জ্যোৎস্নায় পদ্মায় চর অপার্থিব সৌন্দর্য্যে মায়াময় হয়ে উঠেছে। কবি সবাইকে নিতে হাঁটতে বেরোলেন সেই ধূ ধূ প্রান্তরে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বলেন্দ্রনাথ আর মৃণালিনী দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দুরে চলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ব্যাপারটা খেয়াল করলেন, তখন রাত হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও তাঁরা ফিরলেন না দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রসন্নকে খুঁজতে পাঠালেন। মৃণালিনী দেবী প্রফুল্লকে ভীষণ স্নেহ করতেন, তিনি ছিলেন তার ছোটমা। বলেন্দ্রনাথ, সবার প্রিয় বলু, তখন নেহাতই কিশোর। এই অচেনা জায়গায় না-জানি তাঁরা কোন বিপদে পড়েছেন ভেবে কবির মত প্রসন্নও ভেবে আকুল। গফুরকে (পদ্মাবোটের মাঝি) সঙ্গে নিয়ে প্রসন্ন বেরিয়ে পড়ল, হাতে একটা লণ্ঠন। এদিকে রাত বেড়ে চলেছে, জ্যোৎস্নার আলো মরে আসছে। প্রসন্ন আর গফুর সারা চরময় চষে বেড়াচ্ছে হারানো দুজনের খোঁজে। বোটের কাছে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখছেন মরীচিকার মত দুটি আলো কেবল এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তিনি চেঁচিয়ে ডাকছেন, ‘বলু, প্রসন্ন, গফুর’ । সে ডাক দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে – কোনো সাড়া নেই। কেবল মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে প্রসন্নের ক্ষীণ কণ্ঠের হাঁক ‘ছোটমা  ছোটমা’। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, শুধুই নিষ্ফল হাঁকাহাঁকি। এবার রবীন্দ্রনাথ রীতিমত ভয় পেয়ে গেলেন। পদ্মার জল  নেমে যাচ্ছে। এখানে ওখানে জেগে উঠছে চোরাবালি। রয়েছে সাপের ভয়ও।

অনেকক্ষণ পরে একটা ছোট ডিঙি নৌকায় প্রফুল্ল ফিরে এল দুই হারানো মানিককে সঙ্গে নিয়ে। তার কাছ থেকে জানা গেল দুজনের হারিয়ে যাবার রোমাঞ্চকর বর্ণনা। বলু হয়েছিল মৃণলিনীর গাইড। কিন্তু পথভুলে বলুবাবু কালকাপুর চরের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। আর একটু হলেই পাবনা জেলার কোনো অচেনা প্রান্তের পৌঁছে যেতেন। ভাগ্যিস প্রফুল্ল আর গফুর ওদের দেখতে পেয়েছিল। সে যাত্রায় প্রফুল্লদের জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর হারানিধিদের ফিরে পেয়েছিলেন।  

আগামী পর্বে বনমালী ও অন্যান্যেরা

ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার

Please rate this

Join the Conversation

11 Comments

  1. অপূর্ব সঙ্কলন। ভৃত্য নিয়ে এত গপ্পো সত্যিই আমার অজানা ছিল।
    বনমালী ওরফে নীলমণির গপ্পো শোনার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম।

  2. কবিগুরুর জীবনের যে অধ্যায়গুলো অনালোচিত থেকে গিয়েছে,বিভিন্ন গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে উল্লিখিত থেকেছে,অথচ এই পর্ব ছিল কবিগুরুর জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত,এই রকম অনেক কিছু তথ্য এমন সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য রবীন্দ্র-পূজারী শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার মহাশয়কে সাধুবাদ জানাই।
    বর্তমান অচলায়তন অবস্থায় ওঁনার এই শনিবারের ব্লগ আমাদের মতো সমস্ত রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষদের সঠিক দিশা প্রদান করে চলেছে।

    1. শনিবারের ব্লগ এবং লেখাগুলি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।

  3. খুব সুন্দর। এত বিস্তারিত ও সংগঠিতভাবে জানা ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে যা জানতাম তা সম্পূর্ণভাবে জানতাম না। আপনাকে আন্তরিক ধন‍্যবাদ। সমৃদ্ধ হলাম।

  4. Khub bhalo laglo.amader chokh erie jaoa ei sadharon manusgulir galpo ato chamotkar bhabe tule dhara apnero baro moner parichayk.Abanindranath ‘amar chhelebalaa’boite ekei ‘bhrityarajaktantro’bolechhilen.eder galpo aro shonar janno apekshay roilam.dhanyabaad o shubhechha.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *