রামগড়ের গান No ratings yet.

১৩২১ সালের বৈশাখের তাপদগ্ধে কাতর রবীন্দ্রনাথ একটু আরামের খোঁজে পাহড়ে যাওয়া মনস্থির করলেন। পাহাড়ের প্রতি টান ঠাকুর পরিবারের মজ্জাগত। দেবেন্দ্রনাথ জীবনের অনেকটাই পাহাড়ে কাটিয়েছেন। সংসারের কোলাহল এড়িয়ে ভ্রমণ করতে ভালবাসতেন, বহুবার হিমালয় ভ্রমণ করেছেন। হিমালয় ছিল তাঁর ঈশ্বরসাধনার আশ্রম। রবীন্দ্রনাথকে পাহাড়ের নেশা ধরিয়েছেন  স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ। ১৮৭৩ সালে তিনি সেই যে ১২ বছরের পুত্রকে হিমালয় ভ্রমণের সঙ্গী করে নিয়ে গেলেন, তারপর থেকে কী এক অজানা আকর্ষণে রবীন্দ্রনাথ বারবার ছুটে গিয়েছেন সমতল ছেড়ে পাহাড়ের নির্জন কোনে। সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে তিনি ছুটে যেতেন পাহাড়ের শান্ত প্রকৃতির কোলে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে । কোথায় যাননি?  হিমালয়, নৈনিতাল,  দার্জিলিং, কার্শিয়াং, শিলং, তিনধরিয়া, কালিম্পং  আরও কত যায়গায়। রবীন্দ্রনাথের মেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথও শেষ জীবনে রাঁচি শহরের কাছে মোরাদাবাদ পাহাড়ে কাটিয়েছেন ।

যাই হোক রবীন্দ্রনাথ ঠিক করলেন এবার কিছুদিন রামগড়ে থাকবেন। রামগড় নৈনিতালের কাছে একটা ছোট্টো নির্জন পাহাড়ি গ্রাম। ১৯২১ সালে রথীন্দ্রনাথ সেখানে একটা বাগানবাড়ি কিনে রেখেছিলেন। ইচ্ছে ছিল গরমের দিনগুলিতে মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকবেন। সদ্যকেনা বাড়িটির নাম স্নো ভিউ গার্ডেন্স। পরে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ এই বাড়ির নতুন নাম রেখেছেন হৈমন্তী।

২৭ বৈশাখ প্রতিমা দেবী, কন্যা মীরা আর জামাতা নগেন্দ্রনাথকে নিয়ে কবি রওনা হলেন রামগড়ের  পথে। সঙ্গে কতিপয় ভৃত্যও ছিল যথারীতি। পরে অ্যান্ডরুজ, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য কবি অতুলপ্রসাদ সেন এবং আরও কয়েকজন যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময়ে রথীন্দ্রনাথ অবশ্য বাড়ি ছিলেন না। তিনি বদরিকাশ্রম ভ্রমণ সেরে ফিরেছেন কিছুদিন পরে।

পাহাড়ের বড় বড় গাছগুলির জন্য প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য ভালোভাবে উপভোগ করা যেত না বলে রবীন্দ্রনাথের মনে একটা অতৃপ্তি ছিল। কিন্তু রামগড়ে সেই দৃষ্টিবাধা না থাকায় তাঁর হৃদয় আনন্দে কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। আসবার পরের দিনেই তাঁর জীবনদেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিবেদন করলেন সদ্যরচিত একটি গান, এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর।  

জোড়াসাঁকোয় প্রতি বছর মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথের জন্মোৎসব পালন করা হত। এবছর তাঁর ৯৮-তম জন্মদিন। যথারীতি শ্রদ্ধা ও নিয়মের সঙ্গে  ৩ জ্যৈষ্ঠ দিনটিকে স্মরণ করা হল উপাসনা আর প্রার্থনার মাধ্যেমে। এইদিনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন চরণ ধরিতে দিও গো আমারে গানটি।

কৃষ্ণকুমার ও লীলাবতী মিত্রের কন্যা কুমুদিনী। তিনি সুপ্রভাত নামের মাসিক পত্রিকাটির তিনি সম্পাদিকা। রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে দেবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ কথা রেখেছিলেন। প্রথম সংখ্যাতেই আত্মপ্রকাশ করেছিল তাঁর  বিখ্যাত কবিতা রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি এসেছে দুয়ার ভেদিয়া। সেই কুমুদিনীর বিবাহ স্থির হয়েছে শচীন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে ৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৩১ বঙ্গাব্দে। তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিপ্লবী ছাত্রনেতা। কবির কাছে অনুরোধ এসেছে বিবাহের শুভদিনে একটি আশীর্বাণী লিখে দিতে। এমন আবদার রবীন্দ্রনাথকে হামেশাই সামলাতে হয়। তিনি তাঁর অন্তরের আশীর্বাদ উজাড় করে উপহার দিলেন দুজনে এক হয়ে যাও, মাথা রাখো একের পায়ে গানটি।

যে রামগড়ের শান্ত নির্জন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে রবীন্দ্রনাথের প্রাণমন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, সমতলের কোলাহলমুখর জীবনের যন্ত্রণা থেকে ক্ষণিক মুক্তি পেয়েছিলেন, কোনো এক হঠাৎ বেদনার মেঘে সেই মন বিষাদে ভরে উঠেছিল । আর তারই অভিঘাতে রচিত হয়েছিল  আরও কয়েকটি গান ও কবিতা  

এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে (৫ জ্যৈষ্ঠ), সন্ধ্যা হল গো ও মা (৬ জ্যৈষ্ঠ), আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় (৭  জ্যৈষ্ঠ)। আর লিখলেন একটি কবিতা এবার যে ঐ এল সর্বনেশে গো, যা কবির আত্মবেদনাকে ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলেছে।

সঠিক কারণ জানা না গেলেও রবীন্দ্রনাথ মানসিকভাবে কতটা বিদ্ধস্ত ছিলেন তা বোঝা যায়  ৭  জ্যৈষ্ঠ অ্যান্ডরুজকে লেখা চিঠিতে। ‘I am struggling on my way through the wilderness. My feet are bleeding, and I am toiling with panting breath. Wearied, I lie down upon the dust and cry and call upon His name. I know I must pass through death.

অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লিখলেন, ‘ ঈশ্বর বারে বারে আমাকে নূতন নূতন জন্মের মধ্যে দিয়ে নিয়ে এসেছেন।  সংসারে থাকলে দুঃখ নেই কিন্তু সত্যের আশ্রয় নিলুম অথচ সত্য হলুম না এ কিছুতেই চলবে না। আগাগোড়া সত্য হতে হবে। কোথাও কিছু মমতা রাখলে চলবে না ‘

কিসের এই অস্থিরতা, এই আত্মবিশ্লেষণ ? হিমালয়ের উদার প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের চেতনার গভীরে কী এমন নির্দেশ পাঠিয়েছিল যা তাঁর কাছে মৃত্যুরযন্ত্রণার  সমান ?

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, যিনি অনেক আত্মজনের মৃত্যুশোক, সংসারের কুটিলতা, সামাজিক বিদ্বেষ   অতিক্রম করে এসেছেন তিনিও দ্রুত উত্তীর্ণ হলেন এই তীব্র মানসিক সংকট থেকে। নূতন ঊষাকে নিবেদন করে ১০ জ্যৈষ্ঠ রচনা করলেন এই তো তোমার আলোক-ধেনু গানটি।  

এছাড়াও আরও দুটি গান তিনি রামগড়ে থাকতে রচনা করেছেন ফুল ফুটেছে  মোর আসনের ডাইনে বাঁয়ে আর  আমার প্রাণের মাঝে যেমন করে। কিন্তু এগুলিতে সুর সংযোজিত  হয়নি। প্রসঙ্গত দুজনে এক হয়ে যাও গানটি ছাড়া রামগড়ে লেখা সবকটি গানই গীতিমাল্য কাব্যগ্রন্থে সংকলিত। রামগড়ে রচিত গান সম্বন্ধে ২০ জ্যৈষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে, ‘গান অনেক তৈরি হয়েছে। – প্রায় রোজই একটা না একটা চলছে। আমার মুস্কিল এই যে সুর দিয়ে আমি সুর ভুলে যাই। দিনু কাছে থাকলে তাকে শিখিয়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত মনে ভুলতে পারি। নিজে যদি স্বরলিপি করতে পারতুম কথাই ছিলনা। – তাই ভাবি এগুলো হ্যতবিশেষ কারো কাজে লাগবে না’

এই সময়ে অ্যান্ডরুজও মানসিক টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথের আহ্বান পেয়ে তিনিও এসে যোগ দিলেন হৈমন্তীর বাসিন্দাদের দলে।  এলেন অতুলপ্রসাদ। হৈমন্তী এখন জমজমাট। প্রতিদিন গানের আসর বসছে প্রশস্ত বাগানচত্বরে । উত্তরদিকে দিগন্তবিস্তৃত তুষারাবৃত পাহাড়ের সারি, হিমালয়ের দীর্ঘ তরুশ্রেণী, আর অলৌকিক সৌন্দর্যের হাতছানি। তারই মধ্যে চলছে রবীন্দ্রনাথের উদাত্ত কণ্ঠে একের পর গান । কবির অনুরোধে অতুলপ্রসাদও কিছু গান গাইলেন তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠে। বিশেষ করে মহারাজ কেওরিয়া খোলো – এই হিন্দি গানটি এত সুন্দর হয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথ  এমনকি অ্যান্ডরুজও তাতে গলা মিলিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই গান ভেঙে খেলার সাথি বিদায় দ্বার খোলো রবীন্দ্রসংগীতটি রচনা করেছিলেন।

গান রচনার পাশাপাশি একটা মজার ব্যাপারও ঘটেছিল। সকলেই জানেন রবীন্দ্রনাথ  হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতে ভালোবাসতেন। একদিন রামগড়ে এক কাঠের মিস্ত্রি হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে রবীন্দ্রনাথ তাকে ওষুধ দিয়ে ভালো করে তুললেন। তারপরে প্রতিদিন এত রোগীর আগমন হত যে রবীন্দ্রনাথেকে ডিসপেনসারি খুলে বসতে হয়েছিল। স্থানীয় মানুষেরা ভেবেছিলেন কলকাতা থেকে একজন বিখ্যাত ডাক্তার এসেছেন রামগড়ে।

অচিরেই রামগড়ের ছুটির দিন ফুরিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ আর অ্যান্ডরুজ পাহাড় থেকে নেমে এলেন, আতিথ্য গ্রহণ করলেন লখনৌতে অতুলপ্রসাদের বাড়িতে।

Rabindranath Tagore went to Ramgarh near Nainital district of Utterpradesh for rest in Rathindranath’s house. There he composed many Rabindra Sangeet and  few poems. Andrews and poet Atulpradas accompanied him. Tagore enjoyed the natural beauty of Himalaya. He composed many poems of Gitanjali and Geetimalya.

Please rate this

Join the Conversation

7 Comments

  1. অসাধারন প্রাপ্তিতে ভরে উঠছে প্রতি শনিবার। অপেক্ষায় থাকি কখন নূতন কোনো এক প্রসঙ্গের পথ বেয়ে সেই চিরদিনের ভালোলাগার সমুখে গিয়ে অভিভূত হব, প্রণত হব।
    আপনার এই একনিষ্ঠ নিবেদিত প্রয়াসের কাছে চিরকৃতঞ্জ। আপনি আমার সকৃতঞ্জ নমস্কার গ্রহন করুন।
    ~ সুব্রত মুখোপাধ্যায়

  2. অসাধারণ লিখেছেন। অনেক কিছু জানতে পারি নতুন করে।

  3. আপনার এই উদ‍্যোগকে স্বাগত জানাই। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনি সমৃদ্ধ হয়েছেন আমাদেরকেও করছেন। আপনাকে সশ্রদ্ধ নমস্কার।

  4. অত্যন্ত সুবিন্যস্ত এবং সুপরিকল্পিত এই ব্লগ। রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে লোকে জানতে উৎসাহিত হবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *