রবীন্দ্রনাথের কন্যাদায়
সাল ১৯০১, একত্রিশ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথ। তখনই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের অন্যতম নক্ষত্র। রচনা করে ফেলেছেন পাঁচ শতাধিক রবীন্দ্রসংগীত, দশটি কাব্যগ্রন্থ, একাধিক নাটক, উপন্যাস, ছোটো গল্প, অসংখ্য প্রবন্ধ। দু’বার ঘুরে এসেছেন বিলেত। সামলাচ্ছেন শিলাইদহের জমিদারি। প্রতিষ্ঠা করতে চলাছেন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মাচর্যাশ্রম। দুই পুত্র আর তিন কন্যার জনক। বাংলার শিক্ষিত-সমাজ তাঁকে নিয়ে আলোড়িত। আভিজাত্যপূর্ণ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এহেন ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল বড়মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ের সময়। ভোগ করতে হয়েছিল অপমান, অবিশ্বাস, লাঞ্ছনা আর অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা। সেই সঙ্গে অর্থকষ্টও।
বাল্য-বিবাহের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ বরাবরই সোচ্চার ছিলেন। তাঁর ‘স্পষ্ট সমর্থন ছিল যৌবন-বিবাহের প্রতি’। কিন্তু মাত্র চোদ্দো বছর বয়সেই তিনি আদরের বড় মেয়ে বেলার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কেন ? তখন রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে ঋণগ্রস্থ। বন্ধু লোকেন পালিতের কাছে ৫০০০ টাকা ঋণী। প্রায় নিঃসম্বল অবস্থায় স্ত্রীর গয়নাও বিক্রি করতে হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য অনুযায়ী পরিবারের সকলের বিয়ের খরচের অনেকটাই দেবেন্দ্রনাথই বহন করতেন। সম্ভবত সেই কারণে রবীন্দ্রনাথ এই আর্থিক সুযোগটি নিতে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে।
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ শ্রদ্ধার মানুষ। তাঁর তৃতীয় পুত্র শরৎকুমার প্রেসিডেন্সি কলেজের অত্যন্ত কৃতী ছাত্র। সুদর্শন, বিনয়ী, বিলেত ফেরত, মজঃফরপুরে ওকালতি ব্যবসায় জমজমাট পসার। সুতরাং বিয়ের বাজারে তিনি যথেষ্ট মূল্যবান। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে শরৎকুমারের সঙ্গে মাধুরীর বিয়ে হোক।
১৩০৭ এর শ্রাবণ মাসে রবীন্দ্রনাথ বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে জানালেন মনের বাসনা। প্রিয়নাথ বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রতিবেশী। আবার বিহারীলালের অন্য পুত্র অবিনাশ আর হৃষীকেশও রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। তাই কবি ভেবেছিলেন এই শুভকাজটি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।
একমাস হয়ে গেল, প্রিয়নাথের দিক থেকে কোনও খবর নেই। হতাশ রবীন্দ্রনাথ প্রিয়নাথকে লিখলেন, ‘শরতের আশা তুমি এখনো ছাড়ো নি? আমি তো সে অনেকদিন উৎপাটিত করে ফেলেছি’। আসলে তখন চলছিল দরকষাকষি। পাত্রের বাজারদর বিবেচনা করে কুড়ি হাজার টাকা বরপণ চাওয়া হয়েছিল। ভাবা যায় ১৯০১ সালে কুড়ি হাজার টাকা বরপণ? প্রিয়নাথ জানতেন ধারদেনায় জর্জরিত রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই তিনি বেলার জন্য অন্য একটি পাত্রের সন্ধানও দিয়েছেলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাতে রাজি হন নি। শরৎকুমারকেই তিনি জামাই করতে চান। বরং মাড়োয়ারীদের কাছ থেকে আট শতাংশ সুদে তিন বছরের জন্য কুড়ি হাজার টাকা ঋণের ব্যবস্থা করতে বললেন প্রিয়নাথকে ।
রবীন্দ্রনাথের মনে আশানিরাশার দোলা। শরৎ কি এই বিয়েতে রাজি আছে? সে তো বেলাকে দেখেইনি। বাড়ির অন্যরা কি ভাবছেন? লোকেন পালিতের কাছেও পাঁচ হাজার টাকা ধার রয়েছে। সেটা শোধ করবার জন্য সদ্যরচিত ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের সত্ত্ব ছয় হাজার টাকায় বিক্রির চেষ্টা চলছে। এদিকে সাম্প্রতিক দুর্ভিক্ষের কারণে জমিদারির আয়ও তলানিতে, ফলে দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে টাকা পাওয়া যাবে কি? তীব্র মানসিক উৎকণ্ঠায় প্রিয়নাথকে লিখলেন, ‘বেলার যৌতুক সম্বন্ধে কিছু বলা শক্ত। মোটের উপর ১০০০০পর্যন্ত আমি চেষ্টা করতে পারি। সেও সম্ভবতঃ কতক নগদ এবং কতক Installmentএ। … সাধারণত বাবামহাশয় বিবাহের পর দিন ৪/৫ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে আশীর্বাদ করে থাকেন। … বিশ হাজার টাকার প্রস্তাব আমি তাঁর কাছে উত্থাপন করতেই পারব না’।
প্রিয়নাথ কিন্তু আশা ত্যাগ করেন নি। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে। লেখালেখি ও জমিদারির কাজে নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই। তা সত্বেও প্রিয়নাথের ডাকে কলকাতায় চলে এলেন বরপণ নিয়ে পাত্রপক্ষের সঙ্গে একটা রফায় আসতে। অনেক টানাপোড়নের পর পাত্রপক্ষ দশ হাজার টাকায় রাজি হলেন। কিন্ত দাবি করলেন একটি লজ্জাজনক সর্ত। বিয়ের অন্তত তিন দিন আগে পণের সব টাকা নগদে মিটিয়ে দিতে হবে! কী অপমান! মহর্ষী পরিবারের প্রতি কী অবিশ্বাস! অন্য কেউ হলে তৎক্ষণাৎ এই সম্পর্কে ভেঙে দিতেন। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত (!) রবীন্দ্রনাথ মাথা নীচু করে মেনে নিলেন এই অপমান। ভেবে দেখলেন না যে এই প্রস্তাব পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রতি কতটা অশ্রদ্ধা আর অস্মমানের সমান।
এখানেই শেষ নয়। রবীন্দ্রনাথের এই ধরণের মূঢ়তার কথা শুনে দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে জানালেন বিবাহের আগে তিনি কিছুতেই যৌতুক বা বরপণ দেবেন না। রবীন্দ্রনাথ পড়লেন মহা সঙ্কটে। একদিকে টাকার চিন্তা অন্যদিকে পরিবারের মানসম্মান। অবশেষে উভয় পরিবারের বন্ধু কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জামিনদার হতে রাজি হলে সমস্যার একটি আপাত সমাধান পাওয়া গেল। আশ্বস্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ফিরে গেলেন।
রবীন্দ্রনাথ জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি বিয়ের ব্যাপারটা সেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে প্রাণনাথের চিঠি থেকে জানতে পারলেন যে পাত্রপক্ষ আরও দু’হাজার টাকা অতিরিক্ত দাবী করেছে। দিশাহারা রবীন্দ্রনাথ তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন তাঁর চিঠিতে, ‘আমি আর কিছু বলিব না। – বাগবিতণ্ডা মনস্তাপ পরিতাপ যথেষ্ট হইয়া গেছে, এখন অশান্তিকে বিশ্রাম দেওয়া যাক। আমাদের বাড়িতে অনেক বিবাহ হইয়া গেছে, আমার কন্যার বিবাহেই প্রত্যেক কথা লইয়া দরদস্তুর হইল, ইতঃপূর্বে এমন ব্যপার আর হয় নাই। এ ক্ষোভ আমার থাকিবে। দশ হাজারের উপর আরও দুই হাজার চাপাইয়া ব্যাপারটাকে আরও কুৎসিত করা হইয়াছে। – আমাকে পাক দিয়া মোচড় দিয়া নিংড়াইয়া লওয়া হইল। – এ বিবাহে আমার এবং বেলার মার উভয়ের মনের মধ্যে একটি ক্ষতরেখা রহিয়া গেল, এমন কি তিনি কন্যার মাতা হইয়াও এ বিবাহে যথেষ্ট উৎসাহী হন নাই’। রবীন্দ্রনাথের মত মানুষ, কতটা মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন, এই চিঠিই তার প্রমাণ।
যাইহোক প্রিয়নাথের মধ্যস্ততায় রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হওয়ার পরে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে এক শুভদিনে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘পাকাদেখা’ অর্থাৎ বিয়ের প্রাথমিক আনুষ্ঠানিক কাজ সম্পন্ন হল। কিন্তু তার আগে রবীন্দ্রনাথের অজ্ঞতার কারণে এক বিষম বিভ্রাট ঘটতে চলেছিল। বিয়ের আগে ‘কনেদেখা’ বলে একটা পর্ব থাকে। সাধারণত পাত্রপক্ষ কন্যাপক্ষের বাড়ি আসেন মেয়ে দেখতে। কিন্তু এক্ষেত্রে পাত্রপক্ষ প্রস্তাব দিয়েছিল কন্যাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে দেখাতে হবে। এবং কী আশ্চর্য রবীন্দ্রনাথ বিনাবাক্যে সেই লজ্জাজনক প্রস্তাবও মেনে নিলেন! মৃণালিনীদেবী সেকথা শুনে প্রতিবাদ করলে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারটা বোধগম্য হল। প্রিয়নাথকে লিখলেন, ‘আমি দেখিতেছি, সাংসারিক কর্মের সম্বন্ধে আমি নিতান্ত গর্দ্দভ এবং অনভিজ্ঞ। …. বিবাহের পূর্বে কন্যাকে অন্য বাড়িতে দেখাইতে লইয়া যাওয়া যে সর্ব্বপ্রকার শিষ্ট প্রথার বিরুদ্ধে, তাহা আমার গৃহিণী সম্পূর্ণরীপে প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন’।
প্রিয়নাথ এই জটিল সমস্যাটিরও সমাধান করে ফেললেন। ২৮শে জ্যৈষ্ঠ ঠাকুরবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী শরতকুমার ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষীত হন। এবং পয়লা আষাঢ় মাধুরীলতার সঙ্গে শরতকুমারের বিবাহ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল।
মধুরেণ সমাপয়েৎ ।
পুনশ্চঃ
১৯১৩ সালে পারিবারিক বিবাদের কারণে শরৎকুমার এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি হয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পরেও তারা একবারও দেখা করতে আসেন নি। বরং মাধুরীলতার অসুস্থতার সময়ে শরৎকুমার নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে অপদস্থ ও অপমান করেছেন।
মাধুরীলতার বিয়ের দেড় মাসের পরেই (২৪ শে শ্রাবণ) মাত্র ১০ বছর বয়সে রেণুকা দেবীর সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহ হয়। এই বিবাহে বরপণের পরিবর্তে সত্যেন্দ্রনাথের দাবী ছিল ‘উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা যাওয়ার খরচ’। বিবাহের ২ বছর পরেই যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর সময় বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
ছোট মেয়ে মীরা দেবীর বিবাহ হয় নগেন্দ্রনাথ গঙ্গপাধ্যায়ের সঙ্গে ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৪ । এখানেও বিয়ের আগে যথেষ্ঠ গোলমাল ও ঝঞ্ঝাট হয়েছিল। বিয়ের দিন থেকেই নগেন্দ্র নানা দুর্ব্ব্যহার শুরু করছিলেন যা পরবর্তীকালে মীরার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথ কৃষিবিদ্যা শিক্ষার্থে জামাতাকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন। পরে পারিবারিক অশান্তির কারণে ১৯২০ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ
রবীন্দ্রনাথের মেয়েদের কারুরই বিবাহিত জীবন সুখের হয় নি। তাঁর জীবদ্দশাতেই মাধুরীলতা ও রেণুকার জীবনাবসান হয়। তদোপরি কণিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ও স্ত্রী মৃণালিনীকেও হারান। এত ব্যক্তিগত শোকের পরেও তিনি বলেছেন “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে, তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে”। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথ – একমেবাদ্বিতীয়ম!
সংক্ষিপ্ত সুন্দর রচনা।