ইন্দিরা দেবীর কথায় ঠাকুরবাড়ির দুই শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ। বিসর্জন নাটকের অভিনয়ে প্রথম পর্যায়ে (১৮৯০-১৯০০) রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করতেন রঘুপতির চরিত্রে। উত্তরকালে ১৯২৩ এ অ্যাম্পায়ার রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ে তিনি ছিলেন জয়সিংহের ভূমিকায়।
দুই বয়সে দুই চরিত্রে অভিনয়ের Photograph দুটি নিশ্চয়ই আপনাদের সকলের স্মৃতিতে রয়েছে। প্রথমটিতে উন্নত ললাট, দাম্ভিক-দৃপ্ত অথচ ঋজু ব্যক্তিত্বের আকস্মিক বিপন্নতায় হাহাকাররত রঘুপতি, রবীন্দ্রনাথ। দ্বিতীয়টিতে ৬২ বছরের চিরনবীন যুবা রবীন্দ্রনাথ জয়সিংহ-বেশে মঞ্চে আসীন।
জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতি
প্রথম ছবিতে জয়সিংহ অরুনেন্দ্রনাথ, যিনি ঐ দৃশ্যে মহড়ায় বক্ষে ছুরির আত্ম- আঘাতে কাতরাচ্ছিলেন দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ‘ও কি হচ্ছে? অমন করে পা নাড়ছ কেন?’ অরুনেন্দ্র : ‘বুকে ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করলে খিঁচুনির মত হবে না ?’ রবীন্দ্রনাথ : ‘না না ওসব চলবে না। অতবাস্তব অভিনয়ে কাজ নেই।
রবীন্দ্রনাথ পরিমিতিবোধসমম্পন্ন পরিচালক। তিনি জানেন কোন পরিস্থিতিতে কতখানি বাস্তবতা অভিনয় কাঙ্ক্ষিত। আমরা এই ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। পরিমিত হতে গিয়ে সজীবতাকে নষ্ট করেছি। যা রবীন্দ্রনাট্যাভিনয়ের স্বাভাবিক সহজাত প্রাণবন্ততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতি করছে।
অথচ মজার কথা হল রবীন্দ্রনাথ যখন শিক্ষক নির্দেশক তখন তিনি পরিমিতির কথা বললেও পূর্বোক্ত দৃশ্যে চরিত্রে এতটাই যুক্ত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে আবেগে মঞ্চের বিরাট কালীমূর্তিকে তুলে মঞ্চপার্শে ছুড়ে ফেলেন। এরপরেই মর্মবেদনা প্রকাশের কর্মফলে তাকে মাসাধিককাল কোমরের ব্যথায় কষ্ট পেতে হয়।
১৯২৩-এ জয়সিংহের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ
সেই অভিনয়ে ঝুনু, রানু ও দিনু সকলেই সুখ্যাতি পেয়েছিলেন।
ঝুনু – সাহানা দেবী / ভৈরবী
রানু – অধিকারী, মুখোপাধ্যায় / অপর্ণা |
দিনু – দিনেন্দ্রনাথ / রঘুপতি
প্রথম অংক | তৃতীয় দৃশ্য | রাজসভায় বলি বন্ধের নির্দেশ পেয়ে ক্ষুব্ধ রঘুপতি মন্দিরে ফিরে এসেছেন। জয়সিংহ – গুরুদেব !
রঘুপতি – যাও যাও!
জয়সিংহ – আনিয়াছি জল
রঘুপতি – থাক, রেখে দাও জল | জয়সিংহ – বসন!
রঘুপতি – কে চাহে বসন!
জয়সিংহ – অপরাধ করেছি কি?
প্রতি মহড়ায় রবীন্দ্রনাথ অক্লেশে হাঁটু মুড়ে বসে এই সংলাপ বলতেন, এতে অভ্যস্ত তিনি। কিন্তু মঞ্চে এই অংশে গুরুচরণে নত হয়ে তিনি আর উঠতে পারছেন না। দিনেন্দ্রনাথ বিষয়টি বুঝতে পেরে রঘুপতির সংলাপের মধ্যেই জয়সিংহের হাত ধরে বললেন, ‘জয়সিংহ এভাবে নত হয়ে বসে থাকলে চলবে না – ওঠো …’ বলে রবীন্দ্রনাথকে টেনে উঠিয়ে দিলেন।
রবীন্দ্রনাথ মঞ্চের বাইরে এসে দিনেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘দিনু, তুই আমাকে রক্ষা করেছিস, না-ধরে ওঠালে আমি কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না‘। তারপর সঙ্গী হল হাঁটুর যন্ত্রণা। সময়ের সঙ্গে সে ব্যথা মিলিয়ে গেল। নাট্যের মর্মকথা ও মঞ্চসাফল্যের তুলনায় তুচ্ছ এই দুর্ঘটনাগুলি হয়ত মনে রাখবার মত নয়।
বিসর্জন-এর বর্হিবেদনার থেকে অর্ন্তবেদনাজাত আবাহনের সুরটি চিরকালীন হয়ে রইল। যে আবাহন মন্ত্রগীতে রয়েছে আশা, আলো, প্রার্থনা, আনন্দের আয়োজন, অমৃতস্বরূপের আকাঙ্ক্ষা ও প্রাণময় সুন্দর সদর্থক ভবিষ্যত। মনে হয়, চিরকালের অসময়ে বিশেষত বর্তমান বিশ্বের সংকটে এই গান অতি প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।স্বল্পকথায় খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।আসলে শিল্পীর জীবনে এই দুই বেদনা চিরায়ত সঙ্গী।
দারুন লাগল দাদা
নতুন কিছু জানলাম
গায়ে কাঁটা দিল!
তিমির দূয়ার কি সাহানাদেবীর গাওয়া?
শুনেছি বহুরূপী’র ‘বিসর্জন’ নাকি জনপ্রিয় হয়নি!