হুঙ্কার No ratings yet.

১৯০৮ সাল। স্বদেশী আন্দোলেন আগুন জ্বলছে সারা দেশে। ইংরাজের উৎপীড়নের শিকার হয়ে একের পর এক নেতা ও বিপ্লবী অকারণে কারারুদ্ধ হচ্ছেন। ইংরাজের The Code of Criminal procedure Act 1898 (Indian Penal Code 124A) ধারায় সংবাদপত্রগুলির স্বাধীনতা ইতিমধ্যেই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৯০৮ সালের জুন মাসে Newspaper Act  এর মাধ্যমে সেই আইনকে আরও কঠোরভাবে বলবৎ করবার ব্যবস্থা হল। বন্দেমাতরম এবং সন্ধ্যা নামের দুটি কাগজে ইংরাজ শাসনের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনামূলক লেখা ছাপানো হত। বন্দেমাতরম পত্রিকায় Traitor in the Camp প্রবন্ধটি ছাপানোর অজুহাতে গোটা প্রেসটিকেই বাজেয়াপ্ত করা হল। একই অজুহাতে বিহারিলাল চক্রবর্তীর ক্লাসিক প্রেসটিকেও  (সান্ধ্যর প্রকাশক) বন্ধ করে দেওয়া হল ১৯০৯ সালের ২০ জুন-এ। শুধু তাই নয় কাগজের সম্পাদক, প্রকাশক-সমেত সবাইকে পাঠানো হল কারাগারের অন্তরালে। এরপরে, দেশাত্মবোধক বই, পুস্তিকা ইত্যাদির লেখকরা রাজরোষের কোপে পড়লেন। বই বাজেয়াপ্ত করে তাদের জেলে পাঠানো শুরু হল। এইভাবে ইংরাজ সরকার সবার কণ্ঠরোধ করে বিপ্লবীদের মনোবল ভেঙে দিতে চেয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের রোষদৃষ্টি কেবলমাত্র বিপ্লবী এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কার্যকলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিত্বরাও ছিলেন তাদের সন্দেহ-বলয়ে। গ্রহের ফেরে রবীন্দ্রনাথকেও পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। আর এজন্য তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল যথেষ্ট দুর্ভোগ আর মানসিক উদ্বেগও । 

খুলনা নিবাসী, সেনহাটি জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক, হীরালাল সেনগুপ্ত ছিলেন কবি এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক। তাঁর শক্তিশালী লেখনীতে জন্ম নিয়েছিল অনেক  দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা। সেগুলি একত্র করে তিনি ‘হুঙ্কার’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন ৩১ জুলাই ১৯০৮ সালে। এতে নিজের রচনা ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম এবং রবীন্দ্রনাথের বাংলার মাটি বাংলার জল গানটি সংযোজিত ছিল। 

হুঙ্কার বইটিতে রাজদ্রোহীমূলক লেখা প্রচারের অপরাধে লেখক হীরালাল সেনগুপ্তকে গ্রেপ্তার করা হল। তাঁর বাড়ি তল্লাসীর সময়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটা চিঠি পাওয়া গেল, যাতে তিনি হুঙ্কার সম্বন্ধে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন। এই চিঠির ভিত্তিতেই রবীন্দ্রনাথ পুলিশের বিষ নজরে পড়লেন। তাঁর নামে পাঠানো হল আইনি নোটিশ।

কী ছিল রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে ? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানতে পারি, ‘বইখানি কবির নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল, কবি তা জানতেন না। বই হস্তগত হলে জানতে পাল্লেন। হুঙ্কার পড়ে কবি গ্রন্থকারকে পত্র লিখেছিলেন,তাতে উত্তেজনার প্রশ্রয় ছিল না, স্থির ধীর হয়ে দেশের কাজ করারই উপদেশ ছিল। – তার ভাবটা ছিল এই রকম মনে হয়, ঘরে আগুন লাগিয়ে তামাশা দেখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। – কবির সেই পত্রখানি গভর্মেন্টের হস্তগত হয়েছিল; ফলে ম্যাজিস্ট্রেটকোর্ট থেকে কবির আহ্বান এলো’।   

যথারীতি হীরালালের জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হল। এদিকে সরকার পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথকেও হীরালালের সঙ্গে আসামী হিসাবে চিহ্নিত করবার ষড়যন্ত্র হচ্ছিল। কিন্তু অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মতে এই অভিযোগ হাস্যকর, মামলা খারিজ হয়ে যেতে পারে। তখন কবিকে মামলার প্রধান সাক্ষী হিসাবে খুলনা আদালতে ডেকে পাঠানো হল। রবীন্দ্রনাথ তখন সবে শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরেছেন। ‘শরীর দুর্বল এবং অপটু, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হয়’। কিন্তু  তারই মধ্যে  নিমগ্ন সাধনায় সৃষ্টি করে চলেছেন গীতাঞ্জলির অসাধারণ কবিতাগুলি।  

সমন পেয়ে কলকাতা হয়ে ৪ ডিসেম্বর খুলনা পৌঁছোলেন। ওই দিনই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট জনস্টোনের আদালতে মামলা শুরু হল। সরকার ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া যাবে ‘হুঙ্কারের কবিতাগুলি উত্তেজক ও রাজদ্রোহকর’। কিন্তু মামলার শুনানীর সময়ে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন তার সারমর্ম হল, স্বাধীনতাকাক্ষী তরুণের পক্ষে উত্তেজক কবিতা বা গান লেখা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। ওকালতি তাঁর পেশা নয়, সুতরাং কবিতা বা গান কী পরিমাণে উত্তেজক হলে সেটা আইনত দণ্ডনীয় হবে সেটা তাঁর জানা নেই।   

মামলা লঘু হয়ে গেলেও হীরালালের গুরুদণ্ড হয়েছিল। তাঁকে ১৮ মাসের সশ্রম কারাবাস আদেশ দেওয়া হল। রবীন্দ্রনাথ ৬ ডিসেম্বর কলকাতা হয়ে শান্তিনিকেতন ফিরে এলেন। গল্পচ্ছলে বললেন, হীরালালের কারাবাসের ব্যবস্থা করে এলাম। মুক্তির পরে এখানে আস্তে বলেছি।  ১৯১০ সালে, কারামুক্তির পরে হীরালাল সেনগুপ্ত  শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

 

১৯১৮ সালের হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় রবীন্দ্রনাথ আর একবার বিব্রত হয়েছিলেন। ১৯১৪ হতে ১৯১৭ সালের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একটি সর্বভারতীয় প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ ঘটানোর পরিকল্পনা দানা বেঁধেছিল। এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলো চরমপন্থী ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী সংগঠনসমূহ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাদার দল, যারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য আমেরিকায় প্রচার চালাচ্ছিল এবং জার্মানির ভারত স্বাধীন কমিটি। মামলাটি হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। ষড়যন্ত্রের মূল চক্রী ছিলেন ডাঃ চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী। এই কাজের জন্য জার্মান সরকার চন্দ্রকান্তকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছিল। কিন্তু চন্দ্রকান্তের উপরে গুপ্তচরেদের কড়া নজর ছিল। ১৯১৭ সালের ৬ মার্চ আমেরিকান গবর্মেন্ট চন্দ্রকান্তকে গ্রেপ্তার করেন।  

১৯১৬ সালে জাপান-আমেরিকা ভ্রমণের সময়ে রবীন্দ্রনাথ জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ওকুমা এবং টেরাউচি-র সঙ্গে (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) দেখা করেন। আমেরিকায় থাকাকালীন কয়েকজন ভারতীয় বিপ্লবীও কবির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সানফ্রান্সিসকোতে এই মামলার বিচার শুরু হলে চন্দ্রকান্ত তাঁর সহযোগীদের নাম-পরিচয় ফাঁস করে দেন। এবং তিনিই এই ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে দেন। আমেরিকার সংবাদপত্রগুলিতে ‘জার্মান ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ জড়িত’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হল। এর ফলে নির্দোষ রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে নিউ ইয়র্কে, ঠাসা কর্মসূচি।  শেষ পর্যন্ত নানা চাপের মুখে, পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করে গোয়েন্দা পুলিশ রবীন্দ্রনাথকে ক্লিন-চিট দিতে বাধ্য হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ একবার নিজেই গ্রেপ্তারের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটিশ সমাজতান্ত্রিকথিয়োসফিস্ট, নারী অধিকার আন্দোলনকারী, লেখক, ভারতীয় স্বায়ত্ব শাসনের সমর্থক অ্যানি বেসান্ত (১৮৪৭-১৯৩৩) ব্রিটিশ শাসকের  ভারতরক্ষা আইন-এর (যার ফলে হাজার হাজার যুবককে বিনা বিচারে জেলে আটক করা হয়েছিল) প্রতিবাদে ১৯১৬ সালে ভোপালে হোমরুল লীগ স্থাপন করেন। শ্রীমতী বেসান্তের এইসমস্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ রাজদ্রোহাত্মক ঘোষণা করে ১৬ জুন ১৯১৭ মাদ্রাজে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। অ্যানি বেসান্তের গ্রেপ্তারের খবর রবীন্দ্রনাথকে  ক্ষুব্ধ ও বিচলিত করেছিল। New India পত্রিকায় তিনি তাঁর কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।

অ্যানি বেসান্ত

শ্রীমতী বেসান্তের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে, কলকাতা কংগ্রেসের নেতা ভূপেন্দ্রনাথ বসুর আহ্বানে অ্যালফ্রেড থিয়েটারে ১১ আগস্ট অনুষ্ঠিত একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ ভাষণ দিয়েছিলেন, যার ছত্রে ছত্রে  প্রকাশ পেয়েছে সমকালীন রাজনৈতিক পটভূমিকার ছবি আর দেড়শো বছরের ইংরেজ শাসনের সমালোচনার কথা। যেহেতু তাঁর বক্তব্য হোমরুল আন্দোলনের সমর্থক, তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জোড়াসাঁকোর বাসা থেকে বেরোনোর সময়ে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বেরিয়েছিলেন। নিজেই বলেছিলেন ‘আমাকে পুলিশ আজ নিশ্চয়ই গ্রেপ্তার করবে’।  অবশ্য বৃটিশ সরকার ‘নাইট’ রবীন্দ্রনাথকে ধরবার সাহস দেখাতে পারে নি।

এই প্রতিবাদ সভায় গাইবার জন্য তিনি দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী গানটি রচনা করেছিলেন। এবং সেটি  সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়েছিল।

তথ্যসূত্র | রবিজীবনী প্রশান্তকুমার পাল পঞ্চম ও ষষ্ট খণ্ড | রবিপ্রদক্ষিণ পথে সোমেন্দ্রনাথ বসু | রবীন্দ্রজীবনী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার

Please rate this

Join the Conversation

3 Comments

  1. বেশ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। কবি সম্বন্ধে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। ভালো লাগলো।

  2. কালের গর্ভে হারিয়ে যাবার আগে এই ঘটনা পরম্পরাগুলি সম্মুখে আনার জন‍্য আপনি ধন‍্যবাদার্হ। সমৃদ্ধ হলাম।

  3. Besh kadin bade apni swamahimay fire elen.khub prayojonio lekha.amader prajanma to batei,paraborti prajanmer ei tathyaguli jana khub darkar.
    Subhechha .

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *