১৮৯২ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসে পৌঁছেছেন। রয়েছেন মনের আনন্দে, চলছে নতুন নতুন সৃষ্টির কাজ। তারই মধ্যে ২৭ জুন একটা প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের পূর্বাভাষ পেয়ে ২৬ জুন (পত্র ১০) মৃণালিনীকে ‘তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে আসতে’ পরামর্শ দিয়েছেন। প্রিয়জনদের জন্য ভালোবাসা মেশানো উদ্বেগ থেকে বোঝা যায় ‘কাব্য পড়ে যেমন ভাবো কবি তেমন নয় গো’। স্ত্রীর চিঠি থেকে রবীন্দ্রনাথ জানতে পেরেছিলেন সে সময় মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কিছু অশান্তি ঘটেছিল। লিখেছেন, ‘আমরা যদি সকল অবস্থাতেই দৃঢ় বলের সঙ্গে সরল পথে সত্য পথে চলি তা হলে অন্যের অসাধু ব্যবহারে মনের অশান্তি হবার কোন দরকার নেই। বোধহয় একটু চেষ্টা করলেই মনটাকে তেমন করে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। পৃথিবীতে যথার্থ সুখী হবার আর কোনো উপায় নেই।’ সেই সময় রবীন্দ্রনাথ নিজেই নানা কারণে মানসিক দ্বন্ধে বিপর্যস্ত। সুতরাং এটি কেবল উপদেশ নয়, নিজের মানসিক চাঞ্চল্য দমন করবার একধরণের স্বগত-কথনও বটে।
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথকে প্রায়ই নদীপথে যাতায়াত করতে হত। সমস্যাও হত মাঝে মাঝে। পাবনা যাওয়ার পথে এমনই এক নৌ-দুর্ঘটনার কথা জানিয়েছেন ২০ জুলাইয়ের চিঠিতে (পত্র ১১)। ‘আজ আর একটু হলেই আমার দফা নিকেশ হয়েছিল। তরীর সঙ্গে দেহতরী আর একটু হলেই ডুবেছিল। আজ সকালে পান্টি থেকে পাল তুলে আসছিলুম- গোরাই ব্রিজের নীচে এসে আমাদের বোটের মাস্তুল ব্রিজে আটকে গেল- সে ভয়ানক ব্যাপার’। অবশ্য পরের দিনেই ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন (ছিন্নপত্র ৬২), ‘কাল যে কাণ্ডটি হয়েছিল সে কিছু গুরুতর বটে। কাল যমরাজের সঙ্গে একরকম হাউ-ডু-ডু করে আসা গেছে। মৃত্যু যে ঠিক আমাদের নেক্সট-ডোর নেবার’ তা এরকম ঘটনা না হলে সহজে মনে হয় না’।
রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে পাবনার কাজ মিটিয়ে কলকাতায় ফিরবেন। কিন্তু তার আগেই মৃণালিনীর চিঠি থেকে জানতে পারলেন যে তাঁরা কিছুদিনের জন্য সোলাপুরে এসে থাকবেন। আসলে জোড়াসাঁকোর তখনকার পরিবেশ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা আর চরিত্র গঠনের অনুকূল ছিল না। তাই মৃণালিনী তাদের নিয়ে সোলাপুরে আসতে চেয়েছিলেন। হয়ত কিছু ব্যক্তিগত সংঘাতও ঘটেছিল। স্ত্রীকে শান্ত থাকবার পরামর্শ দিয়ে বোট থেকেই লিখলেন (পত্র ১২), ‘অসন্তোষকে মনের মধ্যে পালন কোরো না ছোট বৌ- ওতে মন্দ বই ভাল হয় না। প্রফুল্ল মুখে সন্তুষ্ট চিত্তে অথচ একটা দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে সংসারের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। নইলে সংসার বড় অন্ধকার হয়ে আসে।’ রবীন্দ্রনাথের কথায় তিনি নাকি নিজেই খুঁৎখুঁতে স্বভাবের, তাই স্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন তিনিও যেন সব ব্যাপারে খুঁৎখুঁত না করেন। নতুবা সমস্যা বেড়েই যাবে।
১৮৯৩ সালের ১০ মার্চ উড়িষ্যা থাকাকালীন মৃণালিনীকে লেখা চিঠিতে কেবলই মামুলি সংসারের কথা, ‘কাল ডিকিন্সদের বাড়ি থেকে আবার তাগিদা দিয়ে আমার কাছে এক একশো বিরাশি টাকার বিল এবং চিঠি এসেছে।’ ‘তুমিও তোমার পুত্রকন্যাদের সঙ্গে একত্র বসে সা রে গা মা সাধতে আরম্ভ করে দাও না, তার পরে বর্ষার দিনে আমি যখন ফিরে যাব তখন স্বামী স্ত্রীতে দুজনে মিলে বাদলায় খুব সঙ্গীতালোচনা করা যাবে। কি বল?’ নিজের সঙ্গীত বা সাহিত্যচর্চা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কখনও স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে জানা যায় না। অথচ, এমন কি বিয়ের পরেও তিনি তার সমস্ত গান কবিতা প্রথমেই নতুন বৌঠানকেই শোনাতেন, তাঁর মতামত কিম্বা প্রশংসার অপেক্ষায় থাকতেন। এ জন্য মৃণালিনী দেবীর মনে এক সূক্ষ্ম অভিমান ছিল, হয়ত কিছুটা হীনমন্যতায়ও। তবে এই চিঠিতে, এই প্রথম, রবীন্দ্রনাথ একটু দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে লিখেছেন, ‘সমুদ্রতীর এবং সমুদ্র তরঙ্গের উপর যখন কবিতা লিখচি তখন আর কাঠা বিঘের জ্ঞান থাকে না, তখন অনন্ত সমুদ্রের অনন্ত তীর চোদ্দ অক্ষরের মধ্যে। কবিত্বে এক পয়সা খরচ নেই (যদি না বই ছাপাতে যাই) আর সংসারটাতে পদে পদে ব্যয়বাহুল্য এবং তর্কবিতর্ক’। সম্ভবত জমিদারির কর্মজগত আর নিজের কাব্যজগতের টানাপোড়েন থেকেই তাঁর এই ভাবনা।
১৮৯৮ সালে ঢাকা থেকে শিলাইদহে এসে স্ত্রীর একটি চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বিভ্রান্তি হয়ে পড়েন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য আশ্রিতজনে দিনদিন জনাকীর্ণ, পারিবারিক কুটিল দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল, যা মৃণালিনী দেবী মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। এই পরিবেশে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও চরিত্র গঠনও সম্ভব ছিল না। এই অনুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ যে দীর্ঘ উত্তর দিয়েছেন (পত্র ১৬) তা দুজনের আগামীদিনের পরিকল্পনার এক মূল্যবান বিশ্লেষণ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ভাই তুমি অনর্থক মনকে পীড়িত কোরো না। শান্ত স্থির সন্তুষ্ট চিত্তে সমস্ত ঘটনাকে বরণ করে নেবার চেষ্টা কর। সকলেরই জীবনে বড় বড় সঙ্কটের সময় কোন না কোন কালে আসেই। ধৈর্য্যের সাধনা, সন্তোষের অভ্যাস কাজে লাগেই।’ এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ৩৬টি চিঠির মধ্যে দীর্ঘতম এই চিঠিটিতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এক গভীর জীবনদর্শনের কথা, যা নিয়ে আগে কখনো তিনি স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন নি। তাই তিনি অকপটে জানিয়েছেন, ‘তুমি জান না অন্তরের কি সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আমি এ কথাগুলি বলচি । তোমার সঙ্গে আমার প্রীতি, শ্রদ্ধা এবং সহজ সহায়তার একটি সুদৃঢ় বন্ধন অত্যন্ত নিবিড় হয়ে আসে, যাতে তার কাছে প্রতিদিনের সমস্ত দুঃখ নৈরাশ্য ক্ষুদ্র হয়ে যায়। …মনকে যথেচ্ছা খুঁৎখুঁৎ করতে দিলেই সে আপনাকে আপনি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। আমাদের অধিকাংশ দুঃখই স্বেচ্ছাকৃত’। রবিজীবনীর লেখক প্রশান্ত পালের মতে ‘তাঁর মতো সচল চিন্তাশক্তিসম্পন্ন প্রতিভাবান পুরুষের সঙ্গে দাম্পত্য জীবনযাপন মৃণালিনী দেবীর পক্ষে খুব সহজ ছিল না’। আড়ম্বরশূন্য ও কল্যাণপূর্ণ যুগ্মজীবনের আকাঙ্ক্ষায় রবীন্দ্রনাথ নিজ পরিবারটিকে ‘কলকাতার স্বার্থদেবতার পাষাণ মন্দির থেকে দূরে নিভৃত পল্লিগ্রামের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। ১৮৯৮ সালের আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহের এসে পদ্মার তীরে কুঠিবাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
শিলাইদহের দিনগুলি কাটছে নিরুদ্বিগ্ন শান্তি আর আড়ম্বরহীন সরল গ্রামীন জীবনযাপনের মধ্যে। গৃহশিক্ষক রেখে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, পদ্মানদীর উদার সৌন্দর্য উপভোগ, আর নিরন্তর সাহিত্য সৃষ্টির আনন্দে রবীন্দ্রনাথ বিভোর। কিন্তু
আগস্ট ১৯০০ থেকে ১৯০১ সালের জানুয়ারি সময়কার চিঠিগুলিতে রবীন্দ্রনাথ নিজের দার্শনিক চিন্তাভাবনা স্ত্রীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছেন। ভ্রাতুস্পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অসুস্থতার সময়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, ‘শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই’। সেই সময়ে নীতুর অসুস্থতা আর মৃত্যুভাবনার কারণে মৃণালিনীর উদ্বেগের অন্ত ছিল না।
১৯০০ সালের ডিসেম্বর। স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া কোনো একটা চিঠি পড়ে সংশয়ান্নিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন (পত্র ২২), ‘ভাই ছুটি তোমার সন্ধ্যা বেলাকার মনের ভাবে আমার কি কোন অধিকার নেই। আমি কি কেবল দিনের বেলাকার? তোমার যা মনে এসেছিল আমাকে কেন লিখে পাঠালে না? তোমার শেষের দু চার দিনের চিঠিতে আমার যেন কেমন একটা খট্কা রয়ে গেছে।’ এরপরেই আবার অনুরাগ করে লিখেছেন, ‘কাল রাত্রে প্রায় সমস্ত রাত স্বপ্নে দেখেছি যে তুমি আমার উপরে রাগ করে আছ এবং কি সব নিয়ে আমাকে বকচ। সেই স্বপ্নের রেশ নিয়ে আজ সকালেও মনটা কি রকম খারাপ হয়ে ছিল’। শত ব্যস্ততার মধ্যেও কবির মন মৃণালিনীতে কতটা আচ্ছন্ন হয়ে ছিল এই চিঠি তার আর একটি প্রমাণ।
শান্তিনিকেতনে নিজের স্বপ্নের বিদ্যালয় স্থাপনের সময় স্ত্রীকে সহকর্মী হিসাবে পাবার আকাঙ্ক্ষায় লিখেছেন (পত্র ২৪) , ‘যদি তুমি আমার সঙ্গে সকল রকম বিষয়ে সকল রকম শিক্ষায় যোগ দিতে পার ত খুসি হই – আমি যা কিছু জানতে চাই তোমাকেও তা জানাতে পারি – আমি যা শিখতে চাই তুমিও আমার সঙ্গে শিক্ষা কর তাহলে খুব সুখের হয়। জীবনে দুজনে মিলে সকল বিষয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে অগ্রসর হওয়া সহজ হয়।
শিলাইদহে মৃণালিনীকে সংসারের সমস্ত ঝক্কি সামলাতে হয়। বাচ্চাদের দেখাশুনো, রান্নাবান্না, বাগান করা, ঘরদোর পরিষ্কার করা – মৃণালিনীর হাঁপ ছাড়বার যেন ফুরসৎ নেই। রবীন্দ্রনাথের সংবেদী মন ব্যাকুল হয়ে থাকে তাঁকে একটু অবসর দিতে। তাই ঠিক করেছেন ‘আমরা এবার বোটে গিয়ে থাকব সেখানে চাকরের অভাব তুমি তেমন অনুভব করবে না – তপসি থাকবে, অন্যান্য মাঝিও থাক্বে, তোমার ফটিক থাকবে, পুটে থাকবে, বিপিন থাকবে, মেথর থাকবে – অনায়াসে চলে যাবে— ল্যাম্পের ল্যাঠা নেই, জল তোলার হাঙ্গাম নেই, ঘর ঝাড় দেওয়ার ব্যাপার নেই– কেবল খাবে স্নান করবে, বেড়াবে এবং ঘুমবে’। রবীন্দ্রনাথ কথা রেখেছিলেন, সপরিবারে বহুদিন পদ্মাবোটে বাস করেছেন। এই সময়ে রচনা করেছেন নৈবেদ্যর অনেক কবিতা।
বেশ কিছুদিন থেকেই মৃণালিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিতে নিজের ভাবনা, প্রকৃতি-বর্ণনা, জীবনদর্শন এবং সাহিত্যচর্চার কথাও স্থান পেতে শুরু করেছিল যা এতদিন আমরা ইন্দিরা দেবী এবং অন্যান্যদের লেখা চিঠিতেই দেখেছি। এখনকার চিঠিগুলিতে যেন স্ত্রীর সঙ্গে নিজের মানসিক বন্ধন আরও দৃঢ় করতে চেয়েছেন। লিখেছেন (পত্র ৩০), ‘পুণ্যাহের গোলমাল চুকে যাওয়ার পর থেকে আমি লেখায় হাত দিয়েছি। এখন এখানকার নির্জনতা আমাকে সম্পূর্ণ আশ্রয় দান করেছে, সংসারের খুঁটিনাটি আমাকে আর স্পর্শ করতে পারচেনা। নির্জনতায় তোমাদের পীড়া দেয় কেন তা আমি বেশ সহজেই বুঝতে পারচি—আমার এই ভাব সম্ভোগের অংশ তোমাদের যদি দিতে পারতুম তা হলে আমি ভারি খুসি হতুম, কিন্তু এ জিনিষ কাউকে দান করা যায় না’। এই চিঠি লেখবার সময় নিবিড় মেঘ জমে এসে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল । সম্ভবত এই প্রথম বর্ষার সৌন্দর্য্যের বন্দনা করে স্ত্রীকে লিখেছেন, ‘চারিদিকের সবুজ ক্ষেতের উপরে স্নিগ্ধ তিমিরাচ্ছন্ন নবীন বর্ষা ভারি সুন্দর লাগচে। বসে বসে মেঘদূতের উপর একটা প্রবন্ধ লিখচি। [এই] প্রবন্ধের উপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি একে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিষ করে রাখতে পারতুম তাহলে কেমন হত। এই মেঘের আয়োজন, এই শাখার আন্দোলন, এই অবিরল ধারাপ্রপাত, এই আকাশপৃথিবীর মিলনালিঙ্গনের ছায়াবেষ্টন! কত সহজ’!
শিলাইদহ থেকে কলকাতায় ফিরে, ১৫ জুলাই, রবীন্দ্রনাথ সদ্য বিবাহিতা মাধুরীলতাকে মজঃফরপুরে স্বামীগৃহে রেখে এসেছিলেন। ১৬ জুলাইয়ের চিঠিতে (পত্র ৩২) স্ত্রীকে তারই কৌতুকপূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন, ‘জামাতার প্রশংসা করে, লিখেছেন,’ শরৎকে যত দেখছি খুব ভাল লাগচে। ওর বাইরে কোনো আড়ম্বর নেই – ওর যা কিছু সমস্ত মনে মনে।
জমিদারি দেখাশুনার কাজে শিলাইদহ যাওয়ার পথের ১৯০২ সালের ১০ আগস্ট কুষ্ঠিয়ায় শ্যালক নগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ রাত্রিযাপন করেন। সেখানে শাশুড়িমাতার একান্ত অনুরোধে তাঁকে মাছও খেতে হয়েছিল। মৃণালিনীকে কৈফিয়ৎ দিয়ে (পত্র ৩৪) লিখেছেন, ‘খাওয়াটা বড় গুরুতর হয়েছে। তোমার মা কোনোমতেই ছাড়লেন না। অনেকদিন পর পীড়াপীড়ি করে মাছের ঝোল খাইয়ে দিলেন। মুখে কিন্তু তার স্বাদ আদবে ভালো লাগল না’। আসলে রবীন্দ্রনাথ বরাবরই নিরামিষ ভোজনে অভ্যস্ত ছিলেন। আমিষ পছন্দ করতেন না। সেজন্য সেদিন আমিষের স্বাদ তাঁর ভালো লাগে নি। যদিও পরবর্তীকালে রুগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে আবার আমিষাশী হতে
জমিদারির কাজ সমাপ্ত করে এবার শুধুমাত্র বিশ্রাম আর নির্জতার খোঁজে রবীন্দ্রনাথ বোটে করে পতিসরের দিকে যাত্রায় করেন। তাঁর শরীর তখন খুব দুর্বল। কলিগ্রাম থেকে লেখা চিঠিটিই (পত্র ৩৫) মৃণালিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের শেষ চিঠি। লিখেছেন, ‘পথে অনেক বিঘ্ন কাটিয়ে এখানে এসে পৌঁচেছি। মৃদু মন্থরগমনে চলতে চলতে বিলের মধ্যে পড়া গেল। সন্ধ্যার সময় চারি দিকে যখন অকূল জল ধূ ধূ করে মনের ভিতরটা একরকম উদাস হয়ে যায়। চারিদিক নিস্তব্ধ শূন্য ছবি – তারই মাঝখানে কেবল পালে বোট চলবার কুলকুল শব্দ। এরই উপরে যখন ক্ষীণ জ্যোৎস্না এসে পড়ে তখন মনে হয় যেন কোন একটা জনহীন মৃত্যু-লোকের মধ্যে আছি। এই বিশাল জলরাশির সমস্ত শান্তি আমার আমার হৃদয়ের উপর আবিষ্ট হয়ে আসে’। রবীন্দ্রনাথ কোলকাতাকে কোনোদিনই পছন্দ করতেন না। সেখানকার সহস্র গোলমাল তাঁর পক্ষে ছিল অসহনীয়। বাংলাদেশের নদীজলই তাঁর কাছে বয়ে আনত সঞ্জবনী বাতাস। তাই স্ত্রীকে লিখেছেন, ‘আমি বুঝেছি আমার হতভাগা ভাঙা শরীরটা শোধরাতে গেলে জলের উপর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমার আর অন্য উপায় নেই’।
বিচ্ছেদ
১৯০২ সালের ২৯ নভেম্বর মাসে কিছুদিনের রোগভোগের পর মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয় জোড়াসাঁকোর লালবাড়ির দোতলায় । সে-রাত্রে রবীন্দ্রনাথ ঘুমোতে পারেন নি, একাকী নির্জন ছাদে সারারাত পায়চারি করেছেন, অন্তরে বয়ে চলেছে ঝড়। পরদিন স্ত্রীর সদাব্যবহৃত চটিজোড়া রথীন্দ্রনাথকে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলম’। তবে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথের মনে ও ব্যবহারে এ অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল, মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু কবি অনেক শান্ত ভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর কথায় ‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়াছেন সেই শোককে তিনি নিষ্ফল করিবেন না – তিনি আমাকে শোকের দ্বারা মঙ্গলের পথে উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন’। তাছাড়া নাবালক সন্তানদের লালনপালন, শান্তিনিকেতনের কাজের ব্যস্ততায়, ঋণের বোঝায় তখন তাঁর এক মুহূর্ত অবসর ছিল না। পত্নীবিয়োগের পরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ (২৭টি কবিতা) আর কিছু গান। তবে কাদম্বরী দেবীর মত মৃণালিনীর মৃত্যুশোক রবীন্দ্রনাথের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।
চমৎকৃত হলাম। এমন তথ্যনিষ্ঠ অথচ সাবলীল লেখা পড়ে অনায়াসে সমৃদ্ধ হওয়া যায়। এই ধরণের লেখা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। একজন অসাধারণ কবির সাধারণ মানবিক সংসারজীবন ফুটে উঠেছে এখানে। সংক্ষিপ্ত আকারে এত সুন্দর একটি লেখার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।