জোড়াসাঁকোর তেতলার ঘরে পিতা দেবেন্দ্রনাথ আরামকেদারায় বসে রয়েছেন, সামনে নতমুখে দাঁড়িয়ে বালক রবীন্দ্রনাথ। মুণ্ডিতমস্তক। মাত্র চারদিন আগেই তাঁর উপনয়ন হয়েছে । আর সেই কারণেই মাথার এই অবস্থা। ভ্রমণ পিপাসু দেবেন্দ্রনাথ বহুবার হিমালয়ে গিয়েছেন, আবারও যেতে চলেছেন। জানতে চান রবীন্দ্রনাথ এবারে তাঁর সঙ্গী হতে চায় কিনা। ঘটনাটা ১৮৭৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি। বালকের বয়স মাত্র ১২ বছর। জোড়াসাঁকোর কঠিন অনুশাসনে যার জগত চার দেওয়ালের ভিতরেই সীমাবদ্ধ সেই খাঁচার পাখি পেয়েছে অজানা আকাশে ওড়বার ডাক। পিতার প্রস্তাবে মনের তীব্র আলোড়ন চেপে রেখে শুধু বলেছিলেন ‘চাই’। কিন্তু সেই আবেগ তিনি প্রকাশ করেছেন বহু বছর পরে লেখা জীবনস্মৃতিতে। ‘চাই’ এই কথাটা যদি চিৎকার করিয়া আকাশ ফাটাইয়া বলিতে পারিতাম, তবে মনের ভাবের উপযুক্ত উত্তর হইত’।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ পিতা-পুত্রের যাত্রা শুরু। তার আগে জমা কাপড়, বইপত্র, অন্যান্য সবকিছু গুছিয়ে নেবার পালা। ছিল নতুন পোষাক আর জরি দেওয়া টুপিও। প্রথম গন্তব্য বোলপুর। রেলপথে সেখানে পৌছালেন সন্ধ্যা নাগাদ। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রথম ট্রেন-ভ্রমণ। বোলপুরের উদার পরিবেশ, উন্মুক্ত আকাশ, সীমাহীন প্রান্তর আর অবাধ স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথের কবিত্বশক্তি বিকাশের পথটিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এখানেই তিনি রচনা করেছেন ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ নামের বীরগাথাটি।
এরপরে সাহেবগঞ্জ, দানাপুর , এলাহাবাদ, কানপুর ইত্যাদি ঘুরে তারা অমৃতসরে এসে পৌঁছালেন মার্চ মাসের শেষাশেষি। সেখনে পিতার শাসনে ইংরাজি, সংস্কৃত ইত্যাদি ‘নানা বিদ্যার আয়োজন’ এর সাথে সাথে চলত উপাসনা, গানের চর্চা আর প্রাতঃভ্রমণ। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির অত্যন্ত পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। সেখানে প্রতিনিয়ত শিখদের গ্রন্থসাহেব পাঠ ও ধর্মসংগীত গাওয়া হয়। দেবেন্দ্রনাথ প্রায়ই সেই উপাসনায় যোগ দিতেন, এমনকি বন্দনাগানও গাইতেন। রবীন্দ্রনাথ সেখানে শ্রোতা মাত্র। উপাসনার সবকিছু না বুঝতে পারলেও একটি বিশেষ শিখ ভজন তাঁর বালকমনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। আর সেই অভিঘাতেই সৃষ্টি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম গান, যা নিয়ে অনেকদিন পর্যন্ত বিতর্কের শেষ ছিল না।
বিখ্যাত শিখ ভজনটি হল গুরু নানকের লেখা ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের এই ভজনটির তিনি প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ করে ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ গানটি রচনা করেন । কিন্তু বিতর্ক কেন? কারণ অনেকের ধারণা ছিল এটি রবীন্দ্রনাথ নয়, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা। ‘ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপি’তে গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা হিসাবে উল্লেখিত রয়েছে । ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীও এটিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বলে লিখেছেন তাঁর ‘রবীন্দ্রসংগীতের ত্রিবেণীসংগম’ প্রবন্ধে। অথচ ‘রবীন্দ্রনাথ মনে করেন এটি তাঁহার রচনা’। এবং পরে গীতবিতানে এটি রবীন্দ্রনাথের রচনা হিসাবেই সংকলিত হয়েছে।
এই বিতর্কের সমাধান কিছুটা অনুমান নির্ভর। ১৮৭২ সালে ধর্মতত্ব পত্রিকায় ভাদ্র সংখ্যায় এবং পরে তত্ববোধিনীর ফাল্গুন.১৮৭৩ সংখ্যাতে নানকের ভজনটি বাংলা-অক্ষরে (অনুবাদ নয়) প্রকাশিত হয়েছিল। অমৃতসরে তত্ববোধিনী ওই সংখ্যাটি রবীন্দ্রনাথের নজরে আসে এবং তিনি সেটা পড়েওছিলেন। ভজনের মর্মার্থটি পিতা তাকে সহজভাবে বুঝিয়ে দেওয়ায় তার রেশটি তাঁর মনের গভীরে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তাই স্বর্ণমন্দিরের উপাসনায় যেদিন এই ভজনটি শুনলেন তখনই তাঁর কবিমন আপ্লুত হয়ে উঠল। তিনি সেটির অনুবাদ করে রচনা করলেন বিতর্কিত গানটি।
রবীন্দ্রনাথের রচনাটিতে ১৮৭৫ সালে সুরসংযোগ করে আদি ব্রাহ্মসমাজের ৪৫ তম বাৎসরিক উপাসনার সময়ে গাওয়া হয়েছিল। সুরারোপের সময়ে রবীন্দ্র-অনুবাদের মাত্র প্রথম ছয়টি ছত্র ব্যবহৃত হয়েছিল।
গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,
তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে।
ধূপ মলয়ানিল, পবন চামর করে,
সকল বনরাজি ফুলন্ত জ্যোতি রে।
কেমন আরতি, হে ভবখণ্ডন, তব আরতি
অনাহত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে।
অবশেষে আশ্বিন ১৩৫৭ সালে গীতবিতান তৃতীয় খণ্ডে পূজা ও প্রার্থনা বিভাগে সংকলিত হয়ে সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটল। নরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘সঙ্গীত কল্পতরু’ বইটিতেও এই গানটি রবীন্দ্রনাথের নামেই সংকলিত হয়েছে। সেখানে নানকের মূল রচনাটিও রয়েছে। নরেন্দ্রনাথ নানা সময়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান শ্রীরামকৃষ্ণকে গেয়ে শোনাতেন। তাদের ভিতরে অন্যতম গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক গানটি গেয়েছিলেন ১৮৮৫ সালের ৯ মে ।
Wonderful Dr Sarkar. Great initiative. Khub bhalo laglo. Best wishes