রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই আমাদের পথ চলা। প্রতি মুহূর্তে তিনি আমাদের এগিয়ে চলবার প্রেরণা, দুঃখকে জয় করবার আশ্বাস আর জীবনকে উপভোগ করবার মন্ত্র। তাঁর গান শুনে আমাদের দিন শুরু হয় আর দিন শেষ হয় সেই গানের সুরেই। আমি পেশায় চক্ষু চিকিৎসক। সারাটা দিন কেটে যায় অসংখ্য রোগীর চোখের চিকিৎসা আর অপারেশনের ব্যস্ততায়। কিন্তু আমি অনুভব করি তিনি যেন আমাকে সবসময়ে আগলিয়ে রাখেন পরম মমতায়। তাই দিনের শেষে মনের গভীরে গুনগুণ করে ওঠে ‘তুমি খুশি থাক, আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাক’।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার কৌতূহলের শেষ নেই। তিনি আমার কাছে এক অপার বিস্ময়। একুশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তির চুড়ান্ত উন্মেষক্ষণেও, একশ ষাট বছরের এক সৌম্য বৃদ্ধ আজও কিভাবে আমাকে মহগ্রস্ত করে রেখেছেন ভেবে দিশাহারা হয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথের বিপুল রচনাসম্ভার আমাদের এক অনন্ত উপহার। কিন্তু আজকের এই শ্বাসরুদ্ধ ব্যস্ত জীবনে নিভৃতে বসে সেগুলি পড়বার অবকাশ খুবই অল্প। তাই প্রয়োজন হয়েছে তাঁর গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধগুলিকে ডিজিটাল ভাবে সকলের হাতের নাগালে নিয়ে আসবার।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার সখ্যতা সেই কিশোর বয়স থেকেই। কিন্তু তাঁকে গভীর ভাবে জানবার জন্য পড়াশুনো আর গবেষণার শুরু প্রায় তিন দশক আগে। নিজের বেসুরো গলার আক্ষপ থেকেই গীতবিতান আর সঞ্চয়িতা পড়বার অভ্যাষ আমার। আর গান শোনবার জন্য ছিল ক্যাসেট আর সিডির সংগ্রহ। কিন্তু সমস্যা হত সেই সংগ্রহ থেকে মনের মত গানটা সময়মত খুঁজে পেতে। এই ভাবনা থেকেই আমি ক্যাসেটের গানগুলিকে ডিজিটাল-কনর্ভাট করে, এর সঙ্গে প্রতিটা গানের তথ্যগুলি সংযোগ করে গীতবিতান আর্কাইভ নামে একটি ডিভিডি সংকলন করেছি । গান শোনবার সীমাবদ্ধতা থেকে রবীন্দ্রনাথের গানগুলিকে সহজ-অনুসন্ধান-যোগ্য করে সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছে গীতবিতান আর্কাইভ যা আজ পৃথবীর অসংখ্য রবীন্দ্রপ্রেমীর নিত্যদিনের সঙ্গী, রবীন্দ্রনাথকে আপন করে পাবার প্রযুক্তিনির্ভর অবলম্বন। শুধু গান শোনাই নয়, একই সাথে দেখা যায় গানের কথা, স্বরলিপি, রচনাকাল, রচনাস্থান, কবির বয়স, স্বরলিপিকার, সুর-তাল, গান রচনার ইতিহাস ইত্যাদি নানা খবরাখবর।
রবীন্দ্রনাথ যত গান লিখেছেন সেগুলি সবই আমরা শুনেছি বা পড়েছি। কিন্তু তাঁর কবিতার সংখ্যা কত? হাতে গোনা শ’দেড়েক কবিতা ও সেগুলির আবৃত্তির মধ্যেই আমাদের চলাচল। অথচ সাতান্নটি কাব্যগ্রন্থে সংকলিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রায় ৩৫০০টি কবিতা। পাঁচ বছরের গবেষণা ও পরিশ্রমে ২০১৮ সালে আমি সেই কবিতাগুলিকে একটা পেনড্রাইভে সংকলন করেছি। এটির নাম রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভ। এই আর্কাইভে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ৩৫০০টি কবিতা, প্রতিটি কবিতার যাবতীয় তথ্য, ২৪৫ জন শিল্পীর ৫০০০টি আবৃত্তি, ১১০টি গান, ১০৩টি ইংরাজি আবৃত্তি, রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি ও আরও অনেক সম্পদ।
গান আর কবিতার ডিজিটাল সংকলন ছাড়াও গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার নামে আমার একটা বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্সের সিগনেট প্রেস বিভাগ থেকে। ৮৭০ পাতার এই বইটাকে গীতবিতানের আকরগ্রন্থ বলা যায়। বইটা এমনভাবে নির্মান করা হয়েছে যাতে এটি খুললেই দুই মলাটের ভিতরে যেকোনো গানের প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য একনজরে জেনে নেওয়া যায়। কোনো গানের বিষয়ে জানবার জন্য আমাদের অনেক শ্রম ও সময়ের সাশ্রয় ছাড়াও রবীন্দ্রগবেষণা, স্ক্রিপ্ট রচনা, গানের চর্চা, গানের ইতিহাস, নাটক ও সিনেমায় ব্যবহৃত রবীন্দ্রসংগীত, পুরাতন স্বরলিপি সন্ধান ইত্যাদি নানা কাজে গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার একটি অপরিহার্য মাধ্যম। বইটির শুভেচ্ছাবার্তায় কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘আমাদের নিরন্তর রবীন্দ্রচর্চার জগতে এটি একটি জরুরি কাজ হিসাবে গণ্য হবে বলে আমি বিশ্বাস করি’। এইসব কাজ নিয়েই আমার রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ শুধু আমার নয় আমি চেয়েছি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক রবীন্দ্রচেতনা, সবার হাতের মুঠোয় ধরা থাক রবীন্দ্রনাথের গান কবিতার সম্ভার। আগামী প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ হয়ে থাকুক চিরনতুন।
অবশ্যই।রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা,আমাদের সকল ভালোবাসায় তাঁর নাম জ্বলে আছে,আমাদের দুঃখের আশ্রয় এবং একমাত্র সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ।আমাদের জীবনের পরম ধন তো তিনিই।তাঁকে ধরেই তো আমাদের প্রকৃতিপাঠ।সহজপাঠ পড়েই তো শিক্ষার সূচনা।গীতবিতান তো আমাদের চিরপথের সাথি।আপনি সেই রবীন্দ্রসংগীত আর রবীন্দ্রকাব্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য যে বিরাট কর্মযজ্ঞ করেছেন,তার তুলনা নেই।আপনার মঙ্গল হোক,আরো অনেক সমতুল্য কাজ করে চলুন এই শুভকামনা জানাই।সঙ্গে আছি।