কবির চিঠি জগদীশকে 5/5 (2)

(শেষ পর্ব)

ইতিমধ্যে কলকাতার Indian Office জগদীশচন্দ্রের ছুটির Extension বাতিল করে দিলে, হতাশ হয়ে তিনি দেশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে পাঠালেন (পত্র ১২, ৪ জুন ১৯০১), ‘তোমাকে বারম্বার মিনতি করিতেছি – অসময়ে ভারতবর্ষে আসিবার চেষ্টা করিও না। তুমি তোমার তপস্যা শেষ কর- দৈত্যের সহিত লড়াই করিয়া অশোকবন হইতে সীতা-উদ্ধার তুমিই করিবে, আমি যদি কিঞ্চিৎ টাকা আহরণ করিয়া সেতু বাঁধিয়া দিতে পারি তবে আমিও ফাঁকি দিয়া স্বদেশের কৃতজ্ঞতা অর্জন করিব.’ ১৯০১ সালের জুলাই আগস্টে বন্ধুকে উৎসাহ দিয়ে লিখেছেন, ‘তোমার কর্ম কেন সম্পূর্ণ সফল না হইবে? বাধা যতই গুরুতর হউক তুমি যে-ভার গ্রহণ করিয়াছ তাহা সমাধা না করিয়া তোমার নিষ্কৃতি নাই ; সেজন্য যে কোন প্রকার ত্যাগ- স্বীকার প্রয়োজন তাহা তোমাকে করিতে হইবে’।

১৯০১ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাস নাগাদ রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা এসেছিলেন জগদীশচন্দ্রের গবেষণার জন্য মহারাজের কাছে অর্থ-সাহায্যের প্রার্থনা নিয়ে। আগরতলা থেকে বন্ধুকে লিখেছেন, ‘আমি তোমার কাজেই ত্রিপুরায় আসিয়াছি। এইখানে মহারাজের অতিথি হইয়া কয়েক দিন আছি। তোমার প্রতি  তাঁহার কিরূপ শ্রদ্ধা তাহা ত জানই – সুতরাং তাহার কাছে আমার প্রার্থনা জানাইতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ অনুভব করিত হয় নাই। তিনি শীঘ্রই বোধ হয় দুই এক মেলের মধ্যেই তোমাকে দশ হাজার টাকা পাঠাইয়া দিবেন। সে টাকা আমার নামেই তোমাকে পাঠাইব। এই বৎসরের মধ্যেই তিনি আরো দশ হাজার পাঠাইতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন’। সেই চিঠির শেষে বলেছেন,  ‘তুমি যাহা করিয়াছ তাহার জন্যই যদি আমরা কৃতজ্ঞ হইতে না পারি তবে আমাদিগকে ধিক। তুমি যাহা করিয়াছ আমরা তাহার উপযুক্ত প্রতিদান কিছুই দিতে পারি না। আমি যে চেষ্টা করিতেছি তাহা কতটুকু এবং তাহার মূল্যই বা কি’ ? জগদীশচন্দ্রের গবেষণার সাফল্য তথা বিশ্বপরিচিতির অধিকাংশ কৃতিত্বই রবীন্দ্রনাথের, তবুও তাঁর অতৃপ্তি ধরা পড়েছে এই কটি বাক্যের মধ্যে। অথচ মাত্র এক মাস আগেই মৃত্যু হয়েছে (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০১) সর্বাধিক প্রিয় নীতীন্দ্রনাথের, এই শোকের মধ্যেও তিনি বন্ধুর কথা একমুহূর্ত ভুলতে পারেন নি। বস্তুত জাগতিক কোনো শোক রবীন্দ্রনাথকে কোনোদিনই ঈশ্বর-নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত করতে পারে নি।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র ও অন্যান্যেরা

অবশেষে ১৯০২ সালে মার্চ মাসে লণ্ডনের Linnean Society তে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত তথ্য (Electric Response of Metal and Ordinary Plants) বৈজ্ঞানিক মহলের স্বীকৃতি পেয়ে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। সেই সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর বিজয়ে শিশুর মত আনন্দে আত্মহারা  হয়ে এপ্রিল মাসের চিঠিতে লিখলেন, ‘আজ তোমার জয়সংবাদ পাইয়া নবমেঘগর্জনপুলকিত ময়ূরের মত আমার হৃদয় নৃত্য করিতেছে। মাতাল মদের বোতলের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত যেমন পান করে তোমার চিঠির ভিতর হইতে আমি সমস্ত মত্ততাটুকু একেবারে উপুড় করিয়া ধরিয়া চাখিবার চেষ্টা করিতেছি’। বন্ধুপ্রীতির এই নিঃস্বার্থ মানসিক উদারতা একমাত্র রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্বপ্রেমিকের পক্ষেই সম্ভব। এরপরেও ২০ জুন রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রকে আশ্বস্ত করে লিখেছেন, ‘তুমি জর্ম্মনি আমেরিকায় তোমার জয়পতাকা নিখাত করিয়া আসিয়ো। তাড়াতাড়ি করিয়ো না। আমি বোধহয় দুই এক মাসের মধ্যেই তোমাকে কিছু সাহায্য করিতে পারিব তাহার ব্যবস্থা করিয়াছি। এখন আমরা তোমাকে কাছে ডাকিব না। আগে তোমার কাজ সারিয়া আইস – তাহার পরে দীর্ঘ সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলিয়া কেদারা টানিয়া বসা যাইবে।’  

রবীন্দ্রনাথ চিত্রচর্চায় মন দিয়েছিলেন জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তেএসে। কিন্ত  ১৯০০ সালের চিঠিতে জগদীশচন্দ্রকে লিখেছেন একখানা Sketch book নিয়ে বসে বসে ছবি আঁকছি। প্রায় ৭ বছর আগে ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন, “আমি বাস্তবিক ভেবে পাইনে কোন্‌টা আমার আসল কাজ। লজ্জার মাথা খেয়ে সত্যিকথা যদি বলতে হয় তবে এটা স্বীকার করতে হয় যে, ঐ যে চিত্রবিদ্যা বলে একটা বিদ্যা আছে তার প্রতিও আমি সর্বদা হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত করে থাকি কিন্তু আর পাবার আশা নেই, সাধনা করবার বয়স চলে গেছে’। যৌবনে যে বিদ্যার দিকে তিনি ‘হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাতে’ তাকিয়ে থাকতেন বার্ধক্যে সেই বিদ্যাই তাঁকে শ্রেষ্টত্বের আসনে বসিয়েছিল।

পুরীতে রবীন্দ্রনাথের কিছু জমি ও বাড়ি ছিল। তিনি সেটি জগদীশচন্দ্রকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জগদীশচন্দ্র গড়িমাসি করায় তাগাদা দিয়ে লিখেছেন, ‘মশায়, আপনার জন্যে পুরীর জমীটি ঠেকিয়ে রাখতে পারব বলে আশা হচ্ছে না, তার প্রতি ম্যাজিষ্ট্রেটের দৃষ্টি পড়েছে। আপনি যদি এখানে থাকতে থাকতেই বাড়ী আরম্ভ করে দিতে পারতেন তাহলে ও লোকটা দাবী করতে পারত না।’ শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের ঋণমোচনের জন্য সেটি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। আবার ১৯০১ সালে মে মাসের একটা চিঠি মারফৎ ত্রিপুরার যুবরাজের জন্য একজন ভালো ইংরাজি শিক্ষক নির্বাচন করে পাঠাবার অনুরোধ করেছেন। 

জগদীশচন্দ্রের ল্যাবরেটরি

১৯০৩ সালের জুন মাসের চিঠিতে রেনুকার অসুস্থার খবরে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবার চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ বন্ধুকে লিখেছেন, ‘রেণুকার সংশয়াপন্ন অবস্থার টেলিগ্রাফ পাইয়া আমাকে ছুটিয়া আসিতে হইয়াছে। তাহাকে জীবিত দেখিব এরূপ আশমাত্র ছিল না। ডাক্তাররা তাহাকে কেবলই Strychnine ব্রাণ্ডি প্রভৃতি খাওয়াইয়া কোন মতে কৃত্রিম জীবনে সজীব রাখিবার চেষ্টায় ছিল। আমি যেদিন আসিয়া পৌছিলাম সেদিন তাহারা রোগীর জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াছিল। আমি আসিয়াই সমস্ত Stimulants বন্ধ করিয়া দিয়া হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করিতেছি। রক্ত ওঠা বন্ধ হইয়া গেছে – কাশি কম, জ্বর কম, পেটের অসুখ কম – বিকারের প্রলাপ বন্ধ হইয়া গেছে বুকের ব্যথা নাই- বেশ সহজ ভাবে কথাবার্তা কহিতেছে, অনেকটা সবল হইয়াছে। আশা করিতেছি এই ধাক্কাটা কাটিয়া গেল’।

আবার ১৯১৭ সালের চিঠিতে মৃত্যুপথযাত্রী যেমন বেলার কথা জানিয়েছেন তেমনি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার উল্লেখও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বারেবারেই চেয়েছেন ব্যক্তিগত শোকদুঃখ থেকে নিজেকে বিমুক্ত রেখে ঈশ্বর-নির্ধারিত কাজগুলি নীরবে করে যেতে। তাঁর কথায় ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তাহা গ্রহণ করিয়াছি; আরো দুঃখ যদি দেন ত তাহাও শিরোধার্য্য করিয়া লইব – আমি পরাভূত হইব না। ১৯১৮ সাল নাগাদ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী রূপ ধরে সারা পৃথিবীকে গ্রাস করেছিল। দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা আর হোমিওপ্যাথির উপর রবীন্দ্রনাথের ছিল অগাধ আস্থা।  ১৯১৯ এর জানুয়ারিতে শান্তিনিকেতন থেকে একটু গর্ব করেই লিখেছেন, ‘কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাইয়ে আসছি।’

জগদীশচন্দ্রের উদ্ভাবিত যন্ত্র

১৯২৮ সালের পয়লা ডিসেম্বর নিজের ৭০ তম জন্মদিনে  জগদীশচন্দ্র কবির সঙ্গে দেখা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘১লা ডিসেম্বরে অমর ৫০ বৎসর হইবে। সেদিন আমি সমস্ত বোঝাপড়া ঠিক করিব। সেদিন তোমার সহিত দেখা হইলে সুখী হইব। তোমার শুভ ইচ্ছা যেন আমাকে সেদিন বলীয়ান করে। রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের সপ্ততিতম জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে একটি কবিতা (শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু প্রিয় করকমলে) রচনা করে উপহার দিয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন ‘৭০ বছরের অভিনন্দন সভায় নিশ্চয়ই আমি যোগ দিতে যাব। তখন শীতে সময় শরীরে এখনকার চেয়ে বল পাব বলে বিশ্বাস করি।’

১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর গিরিডিতে জগদীশচন্দ্রের জীবনাবসান হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন রয়েছেন শান্তিনিকেতনে। কালের ব্যবধানে এবং কর্মক্ষেত্রের বিভিন্নতা হেতু দুইজনের মধ্যে পূর্বের সেই নিবিড় বন্ধন ক্রমে  শিথিল হয়ে গিয়েছিল। তৎসত্ত্বেও পরস্পর পরস্পরকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কবি লিখে পাঠালেন ‘তরুণ বয়সে জগদীশচন্দ্র যখন কীর্তির দুর্গম পথে সংসারে অপরিচিতরূপে প্রথম যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন ..সেই সময়ে আমি তার ভাবী সাফল্যের প্রতি নিঃসংশয় শ্রদ্ধা দৃষ্টি রেখে বারে বারে গদ্যে পদ্যে তাকে যেমন করে অভিনন্দন জানিয়েছি, জয়লাভের পূর্বেই তার জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছি, আজ চিরবিচ্ছেদের দিনে তেমন প্রবল কণ্ঠে তাকে সম্মান নিবেদন করতে পারি সে শক্তি আমার নেই। আর কিছুদিন আগেই অজানা লোকে আমার ডাক পড়েছিল। ফিরে এসেছি। কিন্তু সেখানকার কুহেলিকা এখনও আমার শরীর মনকে ঘিরে রয়েছে। মনে হচ্ছে আমাকে তিনি ভার অন্তিমপথের আসন্ন অনুবর্তন নির্দেশ করে গেছেন’।  

সমাপ্ত

বসু বিজ্ঞান মন্দির

শনিবারের ব্লগ এর চতুর্থ পর্বের আজ শেষ পোষ্ট। সমস্ত পাঠককে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব শনিবারেরর ব্লগের পঞ্চম পর্ব নিয়ে।  ভালো থাকবেন। ইতি- ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার

Please rate this

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *